বুধবার ● ২৩ মার্চ ২০২২
প্রথম পাতা » খাগড়াছড়ি » দীঘিনালায় ইউপিডিএফ নেতা শহীদ নবায়ন চাকমা’র শ্রাদ্ধানুষ্ঠান
দীঘিনালায় ইউপিডিএফ নেতা শহীদ নবায়ন চাকমা’র শ্রাদ্ধানুষ্ঠান
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি :: খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সেনাবাহিনীর হেফাজতে হত্যার শিকার ইউপিডিএফ নেতা শহীদ নবায়ন চাকমা মিলন (সৌরভ)-এর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ও স্মরণসভা যথাযোগ্য মর্যাদায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন হয়রানি ও বাধাদানের চেষ্টা সত্ত্বেও বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৫ হাজার মানুষ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
আজ বুধবার ২৩ মার্চ সকাল ৯ টা থেকে বাবুছড়া সহদেব কার্বারী পাড়া (কিয়াংঘাট)-এর নবায়ন চাকমার নিজ বাড়িতে বৌদ্ধ ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ সময় আয়োজিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সকল প্রাণীর হিতোসুখ ও মঙ্গল কামনার্থে ও নবায়ন চাকমার উদ্দেশ্যে বুদ্ধ মূর্তি দান, সংঘ দান, অষ্টপরিষ্কার দান, পিন্ডুদান, হাজারবাতি দানসহ নানাবিধ দানীয় বস্তু দান করা হয়। অনুষ্ঠানে সাধনাটিলা বনবিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ বুদ্ধবংশ মহাস্থবির-এর সভাপতিত্বে ধর্মীয় দেশনা প্রদান করেন পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও লংগদু বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ সুগতলঙ্কার ভান্তে ও বানছড়া সিদ্ধানন্দ বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ চন্দ্রকীর্তি মহাস্থবির। এছাড়া বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারের ধর্মীয় গুরুরাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে সকাল সাড়ে ১০টায় ইউপিডিএফ দীঘিনালা ইউনিটের উদ্যোগে শহীদ নবায়ন চাকমা(সৌরভ)-এর স্মরণে এক স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। স্মরণসভা শুরুতে নবায়ন চাকমার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
এরপর ইউপিডিএফ সভাপতি প্রসীত বিকাশ খীসার পাঠানো শোকবার্তা ও নবায়ন চাকমার সংক্ষিপ্ত সংগ্রামী জীবনী পাঠ করেন যথাক্রমে পিসিপি’র সদস্য জেসি চাকমা ও পিসিপি’র দীঘিনালা উপজেলা সভাপতি অনন্ত চাকমা।
“চূড়ান্ত বিজয় অবধি লড়বো অবিচলভাবে, হয় পূর্ণস্বায়ত্তশাসন, নয় মৃত্যু” এসব স্লোগানে অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় বিশিষ্ট সমাজসেবক অরুণ বিকাশ চাকমার সভাপতিত্বে ও ইউপিডিএফ’র সদস্য আসেন্টু চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন, ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা ইউনিটের সংগঠক বিপুল চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের খাগড়াছড়ি জেলা আহ্বায়ক এন্টি চাকমা, বাবুছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সন্তোষ জীবন চাকমা, স্মরণসভা প্রস্তুতি কমিটি আহ্বায়ক নিরোধ কান্তি চাকমা, দীঘিনালা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রজ্ঞান জ্যোতি চাকমা প্রমুখ।
এছাড়াও মঞ্চে আরো উপস্থিত ছিলেন, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা সভাপতি ক্যামরণ চাকমা ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলা সভাপতি নরেশ ত্রিপুরা।
স্মরণসভায় ইউপিডিএফ সংগঠক বিপুল চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত নির্যাতিত জুম্ম জনগণের ন্যায্য দাবি পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নবায়ন চাকমা মিলন (সৌরভ) শহীদ হয়েছেন। তাঁর এই আত্মবলিদান লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।
তিনি আরো বলেন, জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে আমাদের অবশ্যই পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বিজয় অর্জন করতে হবে। যতই দমন-পীড়ন নেমে আসুক না কেন বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এ লড়াই চলবে। সরকার যদি মনে করে দমন-পীড়ন চালিয়ে, খুন-গুম করে আন্দোলন দমন করবে, তাহলে ভুল করবে।
বিপুল চাকমা বলেন, সেনা হেফাজতে শুধু নবায়ন চাকমা মিলন (সৌরভ)-কে হত্যা করা হয়েছে তা নয়, এই দীঘিনালায় ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট ইউপিডিএফ’র তিন সদস্য নবীন জ্যোতি চাকমা, ভুজেন্দ্র চাকমা ও রুচিল চাকমাকে রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে কথিত ’বন্দুকযুদ্ধের’ নামে গুলি করে বিচার বহির্ভুতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল রাঙামাটির নান্যাচরে কলেজ ছাত্র রমেল চাকমাকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ৯ এপিল ইউপিডিএফ সংগঠক মাইকেল চাকমাকে গুম করা হয়েছে। এছাড়া এ পর্যন্ত আরো বহু নেতা-কর্মিকে বিচার বহির্ভুতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সকল বিচারবহির্ভুত হত্যার ঘটনায় জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।
বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসন ও রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, একজন মানুষকে ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যার মতো অমানবিক ঘটনা আর কী হতে পারে! কেউ যদি অপরাধ করে থাকে তাহলে বিচারের মাধ্যমে তার শাস্তি হবে। কিন্তু তা না করে কাউকে আটকের পর হেফাজতে নিয়ে তাকে নির্যাতন করে কিংবা গোলাগুলির নাটক সাজিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যা করা দেশের বিচার ব্যবস্থা ও আইনের পরিপন্থী, সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সামিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের উপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এই বিচার বহির্ভুত হত্যার চর্চা এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে বলে তারা মন্তব্য করেন।
বক্তারা আরো বলেন, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার পাহাড়ি-সংখ্যালঘু দরদী সেজে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পাহাড়িদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চক্রান্ত জারি রেখেছে। অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, রাত বিরাতে ঘরবাড়ি তল্লাশির নামে হয়রানি, খুন, গুম, ভূমি বেদখল এখন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আজও নবায়ন চাকমা সৌরভের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে আসার সময় একজনকে ক্যাম্পে আটক করে নিয়ে গিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থনে চেকপোস্ট বসিয়ে অনুষ্ঠানে আগত লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নানা হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে বলে বক্তারা অভিযোগ করেন।
বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিরাপত্তার নামে নিপীড়নমূলক কার্যকলাপ চালিয়ে সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে ও জনমনে ভীতি সঞ্চার করছে বলেও অভিযোগ করেন। তারা বলেন, শুধুমাত্র নিরাপত্তার চশমা পড়ে পার্বত্যাঞ্চলকে দেখলে চলবে না। এখানে যে সমস্যা বিরাজমান রয়েছে তার সঠিক সমাধানে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
স্মরণসভা থেকে অবিলম্বে সেনা হেফাজতে নবায়ন চাকমা মিলন (সৌরভ) হত্যার ঘটনা সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িত সেনা সদস্যদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি এবং সেনাশাসন প্রত্যাহারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন ও বিচার বহির্ভুত হত্যা বন্ধ করার দাবি জানান। একই সাথে বক্তারা দমননীতি পরিহার করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত ১৫ মার্চ ২০২২ ভোররাত আনুমানিক সাড়ে ৩টার সময় দীঘিনালা সেনা জোন থেকে একদল সেনা সদস্য দীঘিনালা উপজেলার ৪নং দীঘিনালার ইউনিয়নে ১নং ওয়ার্ডের মনিভদ্র কার্বারি পাড়া থেকে ইউপিডিএফ সংগঠক নবায়ন চাকমা মিলন (সৌরভ)-কে আটক করে মধ্যযুগীয় কায়দায় অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালায়। এতে তার শরীরের অবস্থা খারাপ হলে সেনারা তাকে নিয়ে এসে দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করালে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।