বৃহস্পতিবার ● ২৪ মার্চ ২০১৬
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » সোহাগী জাহান তনু হত্যার বিচার চাই
সোহাগী জাহান তনু হত্যার বিচার চাই
ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম :: সোহাগী জাহান তনু। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ২০ মার্চ সোমবার কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকা থেকে তনু’র (২০) লাশ উদ্ধার করা হয়।
বাংলাদেশে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগ তুলে কুমিল্লা এবং রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন সংগঠন বিক্ষোভ করেছে। তাঁর পরিবারও ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার দাবি করেছে।
সোহাগী জাহান তনুর বাবা কুমিল্লা সেনানিবাসে বোর্ডে একজন বেসামরিক কর্মচারী।সেই সুবাদে সেনানিবাসে কোয়াটারে তাদের বসবাস ।তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট সোহাগী জাহান তনু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ইতিহাস বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। তাঁকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ তুলে তাঁর কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বুধবার কুমিল্লায় বিক্ষোভ করেছে।
সোহাগী জাহান তনু লেখাপড়ার পাশাপাশি তাঁর কলেজে নাটকসহ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও জড়িত ছিলেন।
টানাটানির সংসারে তিনি কুমিল্লা সেনানিবাসের ভিতরেই টিউশনি করে নিজের খরচের কিছুটা যোগাতেন। তাঁর বড় ভাই নাজমুল হোসেন বলেছেন, গত রোববার ২০শে মার্চ বিকেলে তাঁর বোন টিউশনি করতে গিয়েছিল। কিন্তু রাত আটটাতেও না ফিরলে তাদের মা খুঁজতে রাস্তায় খুঁজতে যান।খবর পেয়ে বাবা মেয়ের লাশ খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই খুঁজে পান মেয়ের ছেড়া চুল, তারপর জুতা, আরেকটু দূরে মোবাইল… তারপর তনুর লাশ, বাবা চিৎকার করে ওঠেন- ‘মা, মা, মা, মা আমার…’।
প্রতিদিনকার মত টিউশনিতে গিয়ে সেদিন (২০ মার্চ রোববার) আর ফিরে এলো না। ফিরে এলো তার ক্ষত-বিক্ষত লাশ। কি বীভৎস! অনেক খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে ময়নামতি সেনানিবাসের অভ্যন্তরে পাওয়ার হাউসের পানির ট্যাংক সংলগ্ন স্থানে সোহাগীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। গলাকাটা মৃতদেহ নগ্ন অবস্থায় কালভার্টের পাশে ঝোপঝাড়ের ভেতর পড়েছিলো। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিলো। মোবাইল ফোনটিও পড়েছিল পাশে।
বর্ণনাটা ভয়ানক। আরও ভয়ানক ব্যাপার হল, এমনটা আমাদের খুব কাছের মানুষের সাথেও হতে পারে। এই ঘটনাটি বর্তমানে দেশে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনা থেকে তো কোন পৃথক ঘটনা নয়। এরকম ঘটনা তো আমাদের দেশে হরহামেসা ঘটছেই। মাত্র এক মাসের কম সময়ের মধ্যেই কুমিল্লার সদর দক্ষিণ ও মনোহরগঞ্জে তিন শিশুকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে।
সোহাগী জাহান তনুকে যারা হত্যা করেছে, হত্যার আগে তার হীন লোভাতুর কায়েমী স্বার্থ চারিতার্থ করেছে বা করার চেষ্টা করেছে আমার দৃষ্টিতে তারা মানুষ না, বখাটে না, দূর্বৃত্ত্ব না। তারা মানুষ নামের কুলাঙ্গার, জানোয়ার, নর্দমার কীট। যে কোন স্বাভাবিক সমাজে তাদের বেঁচে থাকার কোন নৈতিক এবং নাগরিক অধিকার নেই।
সেনানিবাসে কি করে এত বড় একটি অপরাধ ঘটল সে নিয়ে তো প্রশ্ন থেকেই যায়। ভাবা যায়- চারপাশে গোলা বারুদ ও বিদেশী অস্র দিয়ে নিরাপত্তায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেও মানুষ খুন হয়। চলে ধর্ষণ, গলা কেটে হত্যা করে নগ্ন করে রেখে যাওয়া! আর লাশ পাওয়া যায় ক্যান্টনমেন্টের বনে! হায়রে দেশ!! হায়রে সমাজ!! হায়রে আমাদের স্বাধীনতা!!!
সোহাগী জাহান তনু হিজাব পড়তেন। এ ধরণের ছবি সামাজিক নেটওয়ার্কে প্রকাশ হয়েছে।
ঘটনাটিকে ঘিরে সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুকে কিছু তৎপরতা দেখা যায়। মুল ধারার সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে সেভাবে খবর চোখে পড়েনি।
মনে কষ্ট লাগলেও আমাদের সমাজে এটা একটা নিত্য-নৈমত্তিক অংশ। এই নিয়তি আমাদের মেনে নিতে হয়। কেননা সমাজ থেকে এভাবে প্রতিদিন শত শত সোহাগী ধর্ষিতা হয়ে নগ্ন অবস্থায় খুন হয়ে ডোবায় কিংবা জঙ্গলে পড়ে থাকে। বিচার করার কেউ নাই। প্রহসনের এই দেশে বিচার নামক শব্দটিই আজ আকাশের চাঁদের মতো অনেক দূরে দুর্লভ বস্তু হয়ে গিয়েছে, যা আমাদের ধরা দেয় না। আর্থিক অবস্থা দুর্বল হলেতো বিচার কল্পনাতীত হয়ে বসে রয়।
মেনে নিতে হয় কিছুদিন মানববন্ধন, ব্যানার-ফেস্টুন টাঙ্গানো, লেখালেখি, ঢাকঢোল পিটিয়ে একটা রব উঠা এরপর সব নিঃতেজ। এভাবে আমাদের দেখতে হয় সোহাগীদের চলে যাওয়া। দেখতে হয় ধর্ষণকারীরা ধরা পড়লেও আইনের মারপ্যাঁচে বীরদর্পে সমাজে চলাফেরা করে।
সোহাগীর হত্যা- কারা এই দুর্বৃত্ত? কি তাদের পরিচয়? কার কাছে বিচার চাইবো? বিচারহীনতার সংস্কৃতির এই দেশে বিচার কি কখনো হবে? নাকি প্রতিনিয়ত গুনতে হবে আরো সোহাগীর লাশ?তনুর বিভৎস মৃতদেহের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। তাহলে ততোধিক বিভৎস ধর্ষক ও হত্যাকারীদের কি করে ধারণ করে এই সমাজ? আমরা পত্রিকায় লিখছি, ছাত্ররা মিছিল, মানববন্ধন করছে হয়তো আরো কয়েকদিন করবে । এরপর এক পর্যায়ে পত্রিকার সংবাদ বন্ধ হয়ে অন্য সংবাদ বেরুবে পাঠকও ঐ সংবাদ পড়ার নেশায় থাকবে। হারিয়ে যাবে মেধাবী সোহাগী জাহান তনুর ঘটনাটি। হয়তো ধামাচাপা পড়ে যাবে পুরো ঘটনাটি। কিন্ত তনুর পরিবারের কি হবে?
আমরা এমনই এক দেশের নাগরিক, যে দেশে হাজার হাজার সোহাগীরা প্রতিনিয়ত নিকৃষ্ট কিছু হায়েনার লোভের শিকার হয়। আর কিছু ক্ষমতাশালীর পোষা কুকুর হবার সুবাদে তারা ছাড়া পেয়ে যায়, হয়না তাদের কোনো বিচার। এর ফলস্বরূপ তারা আরো অনেক সোহাগীর সাথে এমনই করে। ধূলায় চাপা পড়ে যায় সোহাগীদের পরিবার থেকে করা মামলার ফাইলগুলো।
বাকী থাকে শুধু সোহাগীদের কাছে ক্ষমা চাওয়া। ক্ষমা করো সোহাগী- আমরা পুরুষরা এতটা লোভী যে শুধু একটি নারীর শরীরের জন্য আমরা হিংস্র হয়ে উঠি। ভুলে যাই জাত, কূল, ধর্ম। ভুলে যাই আমিও যে কারো ভাই, কারো সন্তান, কারো বাবা। শুধু একটি নারীর শরীরের জন্য।
এভাবে আর কত সোহাগী জাহান তনুরা কুলাঙ্গার পুরুষদের লালসার শিকার হয়ে অকালে জীবন দিবে ? এই বেদনা দায়ক গল্পের কি পূনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। এর কি কোন শেষ নেই। এভাবে একটি সমাজ, একটি দেশ চলতে পারে না। মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই সম্পন্ন হল আস্তর্জাতিক নারী দিবস। এই নারী দিবসে সমাজের, রাষ্ট্রের অঙ্গিকার ছিল নারীদের সুরক্ষা দেওয়ার।
প্রিয় সোহাগী, অনেক কথা বলার ছিল, বলতে পারছি না, লেখার ছিল লেখতেও পারছি না। কেন যে পারছি না সেটাও জানাতে পারছি না। এটা আমার, আমাদের দূর্ভাগ্যজনক সীমাবদ্ধতা। এই সীমাবদ্ধতার জন্য ক্ষমা চাই সোহাগী তোমার কাছে।
আর মাত্র ২ দিন পরেই আমরা মহা আনন্দে পালন করব আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন দিন স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। দেখতে দেখতে ৪৫টি বছর কেটে গেল। কিন্ত স্বাধীনতার মূল যে চেতনা সেই চেতনা আজো আমরা খুঁজে বেড়াই। সেই চেতনা যদি থাকত তাহলে আজ সোহাগী জাহান তনুকে এভাবে চলে যেতে হতো না। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যে লাল সবুজ পতাকা আমরা পেয়েছিলাম সেই পতাকা কেন বিজয়ের ৪৫ বছর পরেও আমাদের নারীদের সুরক্ষা দিতে পারছে না। একটা স্বাধীন স্বার্বভৌম দেশে একজন নারী কতটুকু নিরাপদে বসবাস করছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজের মেধাবী ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর অকালে জীবন চলে যাওয়া এ লেখায় তার সর্বশেষ উদাহরন হয়ে থাকবে।
সোহাগী, নর্দমার পাপিষ্ট কীটরা তোমাকে যেখানে পাঠিয়ে দিয়েছে, আমরা দোয়া করি মহান আল্লাহ যেন তোমাকে সেখানে ভাল রাখে। তুমিও আমাদের এই পাপেধরা অবক্ষয় সমাজের জন্য দোয়া করিও, আর যেন তোমার মত সোহাগী জাহান তনুকে এভাবে বড্ড অসময়ে চলে যেতে না হয়। সমাজ এবং রাষ্ট্রের যেন বোধোদয় ঘটে।
লেখক : ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম, কলামিষ্ট,সমাজ সেবক চার্টাড ইনস্টিটিউট অব লিগ্যাল এক্সিকিউটিভের মেম্বার।