বুধবার ● ৩১ আগস্ট ২০২২
প্রথম পাতা » সকল বিভাগ » আফিয়া খুনের নেপথ্যে কথিত স্বামী নিয়াজ
আফিয়া খুনের নেপথ্যে কথিত স্বামী নিয়াজ
বিশ্বনাথ প্রতিনিধি :: আফিয়া বেগম সামিহাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে (খুন করতে) মাজেদা খাতুন মুন্নীকে বিদেশে নেওয়ার প্রস্তাব দেন নিহতের কথিত স্বামী নিয়াজ খান। সঙ্গে আরো ২ লাখ টাকা দেওয়ারও প্রস্তাব দেন। পাওনা টাকা নিয়ে আফিয়ার উপর এমনিতেই ক্ষুব্ধ ছিলেন মুন্নী।তার এই ক্রোধকে আরো উস্কে দেন নিয়াজ। কিন্তু হত্যার পর মুন্নী রাতে এবং পরদিন সকালে নিয়াজকে হোয়াসঅ্যাপে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
রোববার (২৮ আগস্ট) বিকেলে সিলেট মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ৩য় আমলি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে এমন তথ্য দেন খুনের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত মাজেদা খাতুন মুন্নী।
শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুন্নীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, জবানবন্দি গ্রহণের পর আদালতের নির্দেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া নিহতের কথিত স্বামী নিয়াজ খানকে ৪ দিনের রিমান্ শেষে কারাগারে পাঠানো হয়। তবে সে হত্যার বিষয়ে তথ্য এড়িয়ে যায়। অবশ্য মুন্নী তার জবানবন্দিতে আফিয়াকে হত্যায় নিয়াজের প্রলোভনের কথা জানান।
মুন্নীর স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে আদালত সূত্র জানায়, আফিয়ার সঙ্গে সাবলেট থাকতেন তিনি।মাসে অন্তত ১৫/১৬ দিন ওই বাসায় থাকতেন। সে সুবাদে আফিয়ার সঙ্গে তার ভাল সম্পর্ক ছিল।তার কাছ থেকে কথিত স্বামী নিয়াজের বিরুদ্ধে মামলা চালাতে পর্যায়ক্রমে টাকা ধার নেন আফিয়া। ক্রমশ; পাওনা টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ হাজারে। কিন্তু টাকা খুঁজতে গেলে সে অস্বীকার করে। তাতে রাগ হয় তার।
জবানবন্দিতে তিনি জানান, বালুচরের ওই ভাড়া বাসায় তারা অসামাজিক কার্যকলাপ চালাতেন।তাদের সহযোগিতা করতেন আফিয়ার কথিত স্বামী নিয়াজ। এক পর্যায়ে আফিয়ার সঙ্গে লেনদেন নিয়ে তারও বিবাদ সৃষ্টি হয়। আর নিয়াজের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না আফিয়ার।এ অবস্থায় নিয়াজের প্রস্তাবে ও নিজের আক্রোশ মেটাতে আফিয়াকে খুন করেন মুন্নী। কিন্তু আফিয়াকে হত্যা করলেও নিয়াজ আর ফোন ধরেননি। পরে র্যাবের হাতে তিনি ধরা পড়েন।
মুন্নী জবানবন্দিতে জানায়, গত ১৮ আগস্ট তিনি বাসায় যান।২০ আগস্ট রাত ১০টার দিকে পাওনা টাকা নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। রাত ১২টার দিকে রান্নাঘর থেকে পাটার শীল নিয়ে আফিয়ার মাথার বাম পাশে সজোরে পরপর ২টি আঘাত করেন জানিয়ে মুন্নী আদালতকে বলেন, আঘাতের কারণে বিছানায় লুটে পড়ে, তবে মরে যাওয়ার জন্য মারেননি, সে মারা যাবে ভাবিনি।
জবানবন্দিতে মুন্নী আরো জানায়, আফিয়া জ্ঞান হারানোর পর রাতে বাসার কলাবসিবল গেইট বন্ধ থাকায় বেরিয়ে যেতে পারেননি। পরদিন (২১ আগস্ট) ভোর আনুমানিক সোয়া ৫টার দিকে ভোরবেলা গেইট খুললে রিকশা ডেকে মালামাল নিয়ে বাসার দরজা তালাবদ্ধ করে চলে যান।
এদিকে, হত্যা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে নিয়াজের অপকর্ম বেরিয়ে আসতে থাকে। নিহত আফিয়া এক নারী চিকিৎসকের বাসার গৃহকর্মী ছিলেন। পরে তাকে আশরাফুল নামে এক যুবকের কাছে বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু নিজের স্ত্রী-সন্তান রেখে আফিয়াকে নিয়ে পালিয়ে যান নিয়াজ। তাকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া করে ও হোটেলে নিয়ে থাকেন। আফিয়ার সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূতভাবে তাকে নিয়ে রাত যাপন করেন। এরমধ্যে তাদের ঔরসে আসে একটি কন্যা সন্তান। কিন্তু আফিয়াকে স্ত্রী করে নিতে টালবাহানা করেন।
অর্থ উপার্জনে তাকে জোরপূর্বক অসামাজিক কাজে লিপ্ত করান। এ কারণে ২০২০ সালের ১২ জুলাই আফিয়া কোতোয়ালি থানায় ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামলা করেন। ওই বছরের ডিসেম্বরে মামলার চার্জশীট দেওয়া হয়।তদন্তকারী কর্মকর্তা ইমিগ্রেশনে চিঠি দিয়ে অবহিত করে রাখেন। কিন্ত তার আগেই নিয়াজ যাতে দেশ ত্যাগ করেন। গত জুন মাসে দেশে আসলে চার্জশীটভূক্ত আসামি হিসেবে ঢাকাস্থ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেফতার হন নিয়াজ।
তার গ্রেফতারের খবর সিলেট কোতোয়ালি মডেল থানাকে জানানো হলে মামলার চার্জশীট হওয়াতে তাকে না আনায় ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হলে পরে ওই মামলায় তাকে সিলেটের কারাগারে প্রেরণ করা হয়। গত ২ আগস্ট জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বের হন নিয়াজ খান। এরপর তিনি ওই বাসায় আসা-যাওয়া করতেন।পরে মুন্নীর সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় এবং আফিয়াকে সরিয়ে দিতে পরিকল্পনা করেন। তিনি মুন্নীকে বিদেশে নেওয়ার ও ২ লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেন।
২৪ আগস্ট রাত ১২টার দিকে নগরীর উত্তর বালুচর বাবর তপাদারের মালিকানাধীন ফোকাস-৩৬৪ সিকান্দর মহলের পাঁচতলা ভবনের নিচতলার বাসায় দরজার তালা ভেঙে আফিয়া বেগমের (৩০) মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় মরদেহের কাছ থেকে আলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া নিহতের আড়াই বছরের কন্যা শিশুকেও উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধারের প্রায় ৭৬ ঘণ্টা আগে আফিয়াকে খুন করা হয় বলেও ধারণা করেছিল পুলিশ। গত ২৪ আগস্ট নিহতের মা কুটিনা বেগম বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশের পাশাপাশি মামলার ছায়া তদন্তে নেমে গত বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) ভোরে আফিয়া হত্যায় জড়িত মাজেদা খাতুন মুন্নিকে হবিগঞ্জ তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে র্যাব-৯ সদস্যরা।গ্রেফতারকৃত মুন্নী (২৯) হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানার সারংপুর গ্রামের আব্দুল গনির মেয়ে। আর নিহত আফিয়া গোয়াইনঘাটের জাঙ্গাইল গ্রামের আজির উদ্দিন ও কুটিনা বেগম দম্পতির মেয়ে।
এছাড়া হত্যাকান্ডের ঘটনায় ২৪ আগস্ট রাতে দক্ষিণ সুরমার বরকান্দি থেকে নিহতের কথিত স্বামী ইসমাইল নিয়াজ খানকে আটক করে পুলিশ। আটক ইসমাইল নিয়াজ খান বরইকান্দি এলাকার ইসমত খানের ছেলে। তাকেও ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও হত্যার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা এড়িয়ে যায়।