শনিবার ● ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২২
প্রথম পাতা » ধর্ম » জীবনের জন্যই ধর্ম,ধর্মের জন্য জীবন নয়
জীবনের জন্যই ধর্ম,ধর্মের জন্য জীবন নয়
প্রভাষক উত্তম কুমার পাল হিমেল :: এই ধরাধামের অনন্য মহিমা যে যুগে যুগে কালে কালে ইহার পূন্য অঙ্গনে মহাজনের আবির্ভাব আজও অব্যাহত আছে। কখন সুর্যোদয় হয়,অন্ধকার পৃথিবী আলোকোদ্ভাসিত হয় এবং সেই আলোকে সকলে আপন আপন চরিত্রকে গঠন করিতে পারে জীবনের আবরনকে নিয়ন্ত্রিত করিতে পারে। লোক শিক্ষার জন্যই এই সব আলোকসামান্য পুরুষের আবির্ভাব ঘটিয়া আর পৃথিবীকে আলোকউজ্জ্বল করতে ধারাধমে এসেছিলে পার্থ সারথী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন আমি বৈকণ্টে থাকি না, যোগীগণের হৃদয়েও বসবাস করি না, আমার ভক্তগণ যেখানে বসে আমার গুনকীর্তন করে আমি সেখানেই অবস্থান করি। ভগবানের এই অমিয় বাণী বাস্তবায়নে আজ পৃথিবীর মানুষজতি নিরলসবাবে তাঁর নামকীর্তন করছে। তেমনিভাবে বাংলাদেশের পাবনা জেলার হেমায়েতপুর গ্রামের পদ্মা নদীর তীরে ১২৯৫ বাংলার ৩০শে ভাদ্র শুভ তাল-নবমী তিথিতে সকালে আবিভূত হয়েছিলেন যুগ পুরুষোত্তম পরম প্রেমময় শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র। তিনি ছিলেন অন্যান্য অবতার পুরুষের চেয়ে আলাদা। তাঁর দৃপ্ত কন্ঠে সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল “মরোনা মেরোনা পারতো মৃত্যুতে অবলুপ্ত করো”। এমন কথা ইতিপূর্বে আর কখনো শোনা যায়নি। পৃথিবীর প্রত্যেক ধর্মই মানব কল্যানের কথা বলে। তেমনি মানব কল্যনের জন্য ঠাকুর অনকুল চন্দ্র বলেছিলেন “ধর্ম যদি নাইরে ফটল জীবন মাঝে নিত্য কর্মে,বাতিল করে রাখলে তারে কি হবে তোর তেমন ধর্মে”। তাই ধর্মের জন্য জীবন,না জীবনের জন্য ধর্ম- এই প্রশ্নের উত্তর আজ বড় প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দিয়েছে। সমগ্র বিশ্বে যেভাবে মৌলবাদ ও সামপ্রদায়িকতাবাদের বিষবাস্প মানুষের হদয়কে অসুস্থ করে তুলেছে,ব্যক্তিসমাজ ও রাষ্টীয় জীবনকে তছনছ করে হিংসা-বিদ্ধেষ-অশান্তির প্রচার ও প্রসার যেভাবে ঘটছে তাতে মনে হচ্ছে শুধু ধর্মের জন্যই জীবনের জন্ম হয়েছে। আর এ বোধ জন্মেছে তাদের-ধর্মকে যারা স্তুল অর্থে গ্রহন ও উপলব্দি করছেন। ধর্মের স্বরুপ ও ব্যাখ্যা হয় তারা বোঝেননি কিংবা বুঝেও স্বার্থান্বেষী চিন্তায় বিভোর থেকে জীবনের সার্থকর্তা ও মূল্যবোধ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ ভেবেছেন। আর এই ঘোর অমানিশার অন্ধকার থেকে মুক্তির জন্য প্রতিটি জীবনের কল্যান ও পরাজয়ের জন্য ধর্মের বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যাখ্যা ও তার বহুল প্রচারের প্রয়েজন।জন্মের আগে কি ছিল আমারা তা জানি না,মৃত্যুর পরে আবার কি হবে তাও জানি না,এর মাঝে পার্থিব যে জীবন সেই জীবনের জন্যই আমাদের সতত লড়াই,চিন্তা ও কর্মকুশলতা। আমরা যা কিছু করছি তার সব কিছুই এই জীবনের জন্যই। সুখ শান্তি ও স্বচ্ছলতা দিয়ে জীবনকে ভরপুর করে তোলার জন্য। তার জন্য করছি লেখাপড়া,ব্যবসা বা চাকুরী ইত্যাদি মাধ্যমে অনভিপ্রেত প্রতিযোগীতার মধ্য দিয়ে অর্থ সম্পদ আহরনে নিজেদের নিমজ্জিত রাখছি। অথ্যাৎ মুলকথা হল,যা কিছুই করছি সব এই জীবনের জন্যই কিন্তু। অথচ মর্মান্তিক পরিতাপ সেখানেই যে,অর্থ সম্পদ যশ সব কিছু করায়ত্ত হওয়া সত্তে¡ও সুস্থ,সুশৃঙ্খল ও মনোরম জীবনের অধিকারী হয়ে উঠতে পারছি না। অশান্তির হাহাকার রব উঠেছে ব্যক্তি বা পারিবারিক জীবনে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? এর প্রধান কারন হল ধর্মের প্রকৃত অর্থটাকে আমরা ভালভাবে উপলব্দি করিনি। আর উপলব্দি করিনি বলেই তা অনুসরন করার কোন প্রশ্নও আসে না। যুযোপযোগী সহজ ও সরল ভাষায় ধর্মের বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যাখ্যা শোনালেন শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র। তিনি বললেন-বাচাঁ বাড়ার মর্ম্ম যা, ধর্ম বলে জানিস তা।’ অথ্যাৎ জীবনের জন্য ধর্ম। জীবনের মঙ্গলমাফিক বাচাঁর জন্য,জীবনের শারিরিক আত্মিক উন্নয়নের জন্য যা যা কর্ম করা দরকার,সেই কর্ম পালনটাই ধর্ম। ধর্ম শব্দটার মধ্যেই উক্ত ব্যাখ্যার সত্যতা ও চিরন্তনতা বিদ্যমান রয়েছে। সংস্কৃত ধৃ ধাতু থেকেই ধর্ম শব্দের উৎপত্তি। ধৃ শব্দের অর্থ হল ধারন,পালন ও পোষন করা। অথ্যাৎ সেই সুকর্ম গুলোই আমাদের জীবনে ধারন ও পালন করতে হবে যে কর্মগুলো জীবনকে সুসংহত,সৃশৃঙ্খল ও মধুময় করে তোলবে। আর এখানেই মনে প্রশ্ন জাগে জীবনের সেই কর্মগুলো কি? সেই উত্তর জানতে হলে প্রথমেই পড়তে হবে জীবনবাদ। আর জীবনের যিনি শ্রষ্টা,জীবনকে যিনি চালনা করেন সেই জীবন সারথীই একমাত্র দিতে পারেন সুন্দর ও ইষ্টময় কর্মের দিক নির্দেশনা। অথচ অদৃষ্টের পরিহাস এমনই যে,সাম্যবাদ সমাজতন্ত্রবাদ,জাতিয়তাবাদ সব বাদই রাজনৈতিক দল ও সরকার জীবনের শান্তির জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে কত পরিকল্পনা গ্রহন করছে। কিন্তু ব্যক্তি জীবন ,দাম্পত্য জীবন পারিবারিক জীবন তথা রাষ্ট্রিয় জীবনের অশান্তি বা হিংসার ক্রমবর্ধমান প্রজ্বলিত অগ্নিকুন্ড নির্বাপিত করতে পারছে না। আসলে যে জীবনের কল্যানের জন্য বিশ্বে এতো ভিন্ন ভিন্ন বাদ এর উৎপত্তি মূলতঃ সেই জীবনবাদ এর জন্য নেই কোন নির্দেশিকা,নেই কোর ও জীবনবাদী নেতা। জীবনকে আদর্শ পরায়ন ,সুশৃঙ্খল ও কল্যানমুখী করার জন্য যে জীবন চর্চ্চা ও অনুশীলনের প্রয়োজন সেই পাঠ্যভ্যাাস আজ কারো মধ্যে নেই। এই সর্বনাশা বিশাল ঘাটতির কথা রন করিয়ে দিতেই প্রকৃত জীবনবাদী পরম প্রেমময় শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র বললেন,
‘যে বাদেরই তুই হোস না বাদী,জীবনবাদী আসলে তুই,জীবনটাকে করতে কায়েম চল চষে সব জীবন ভুই।’ বাল্য জীবন,কৈশোর জীবন ,দাম্পত্য জীবন,বার্ধক্য জীবন এ ধারাবাহিকতায় প্রতিটি স্তরকে সুন্দ,সুঠাম,সুনির্মল ও সুধাময় করে তুলতে হলে জীবন চলার দিকগুলো জানতে হবে। কৃষিজ জ্ঞানকে অনুসরন করে যেমন ফুল ফল ফলাতে হয়,তেমনি জীবন উদ্যানকে ফুলে ফলে ভরিয়ে তুলতে হলে জীবনটাকে তেমনভাবে কর্ষন করতে হবে কোনও জীবনবাদীকে অনুসরন করে। আর সেই জীবনবাদী পুরুষই হলেন একমাত্র যুগপুরুষোত্তম। সৌর জগতের দিকে থাকালে আমারা দেখতে পাই গ্রহ-উপগ্রহ যে যার কক্ষ পথে তীব্র গতিতে ঘুরছে কিন্তু কেউ ছিটকে পড়ছে না,কারও কোর সমস্যা হচ্ছে না। কারন তাদের কেন্দ্রে আছে সুর্য।সুর্যকে কেন্দ্র করেই তারা আবর্তিত হচ্ছে। যাকে যেভাবে টেনে রাখা দরকার সুর্য তাকে সেইভাবেই টেনে রাখছে। তাই তাদের আবর্তের পথে কোরও সমস্যা নেই। ঠিক তেমনি জীবনের কেন্দ্রে যদি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান এমন কোনও মহাজীবনকে স্থাপন করা যায় তা হলে জীবনও সুসংহত সুশৃঙ্খলিতভাবে অতিবাহিত হয়,ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় না। মহাজীবনের সংস্পর্শে এসে এবং তাকে জীবনে গ্রহন করে তাঁর অনুশাসনকে অনুসরন করে জীবন চলনার দক্ষতা অর্জন করা যায়। আমরা সচরাচর দীক্ষা গ্রহন করি জীবনের শেষ বেলায়। যখন আমাদের মধ্যে বার্ধক্য এস যায়। এটা ঠিক না। দীক্ষার অর্থ হলো দক্ষতা অর্জন করা। তা কিসের দক্ষতা? বাল্য থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত জীবন চলনার দক্ষতা। ব্যক্তিজীবনকে কেমন ভাবে উন্নয়নমুখী করতে হবে,দাম্পত্য জীবনকে কিভাবে মধুময় করে তোলতে হবে,পারিবারিক জীবনকে কেমনভাবে স্বর্গীয় সুধায় ভরিয়ে দিতে হবেÑতারই অনুশীলনে নিজেকে দক্ষ করে তোলা। সারাটা জীবন কুকর্ম আর অসততায় নিমজ্জিত থেকে শেষ জীবনে হাতের জল শুদ্ধির জন্য দীক্ষা গ্রহন করে জীবনের বা জগতের কারও কোন কল্যান হয় না। দর্শের নামাবলি গায়ে দিয়ে সিধুর চন্দন শরীরে মেখে কিছু ফুল বেল পাতা দেবতার পায়ে ছুয়ে দিলেই সেই ব্যক্তিকে দর্ধ পরায়ন বলা যায় না। হয়তো দেখা গেল সেই ব্যক্তিই সংসার জীবনে তার ভাইয়ের সম্পত্তি ফাকিঁ দিয়েছে,না হয় প্রতিবেশীকে বিভিন্নভাবে হেনস্থা করছে। নতুবা অসৎ উপায়ে প্রচুর পরিমান অর্থ উপার্জন করে চলছে। কোন ডাকাত যখন ভক্ত সেজে সাড়ম্বরে কালীপূজা করে পরের অর্থ সোনাদানা লুট করছে কিংবা কাউকে খুন করছে –তখন ডাকাতকে কি আমরা ধর্ম পরায়ন বলব? কিন্তু কিছু মৌলবাদী ধর্মের নাম করে ঠিক এমন ভুমিকাতেই আজ অবতীর্ণ। আর এই ধর্মের ধ্বজাধারীদের জন্যই জীবনের জন্য ধর্ম এই মধুর উপলব্দি থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। ধর্মের নামে ভাবের ঘুঘু সেজে ঐ তথাকথিত ধার্মিকরা সংসারে মানুষকে ধোকা দিচ্ছে। শ্রী শ্রী ঠাকুর অনকুল চন্দ্র তাই সতর্ক করলেন মানুষকে। বললেন ‘যাতেই তুমি নিয়োজিত করছো তুমি যা/ভগবানের দৃশ্টি তাতেই,ভাব বা চিন্তায় না’। লোকচক্ষুকে ফাঁকি দেওয়া যায় কিন্তু অন্তর্যামী সেই পরম সত্ত¡াকে ফাকি দেওয়া যায় না। ঠাকুর ঘরে,মন্দিরে,মসজিদে কিংবা গির্জার অভ্যন্তরে সাজিয়ে রাখার জন্য ধর্ম নয়। জীবনের দৈনন্দিন কর্মের মধ্যেই আচরনের মধ্যে ধর্মকে ফুটিয়ে তুলতে হয়। ধর্ম মানে কী এমন এক ভক্তের প্রশ্নের উত্তরে শ্রী শ্রী ঠাকুর বললেন, ইব এড়ড়ফ, ধহফ ফড় এড়ড়ফ. ভাল হও এবং ভাল কর। তাই ধর্ম। তাই সুনিয়ন্তিত আচরন বিধি শিক্ষার জন্যই প্রয়োজন জীবন্ত আচার্য্যরে সান্নিধ্য। দীক্ষা গ্রহন করে তার নির্দেশিত পথেই জীবনটাকে চালিত করার মাঝেই আছে নিজের ও জগতের কল্যান। প্রচুর অর্থ,প্রতিপত্তি,যশ থাকা সত্তে¡ও প্রায়ই মানুষের মাঝে আজ অশান্তি আর দুঃখের উক্তি শোনা যায়। জীবনের এই ব্যাধি মুক্ত হওয়ার সবচেয়ে জোরালো ও স্বতঃসিদ্ধ উক্তি দিয়ে গেলেন শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র। তিনি বললেন ‘ইষ্টে রাখো ভক্তি অটুট/শক্তি পাবে বুকে/তাঁরই কর্মে রাঙ্গাও স্বভাব/পড়বে নাকো দুঃখে।’ হতাশা আর নৈরাজ্য ভরা ক্লান্তিকন জীবনে অফুরন্ত শক্তি আসে তখনই যখন ইষ্টের প্রতি বিশ্বাসে মন ঠগবগিয়ে উঠে। যুগত্রাতা আপূরয়মান বৈশিষ্টপালী শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের ঐশী শক্তির ধারক ও বাহক বিশ্ব সৎসঙ্গের বর্তমান আচার্য্য দেব শ্রী শ্রী দাদার লোকশিক্ষার আলোকে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ আজ পাচ্ছে জীবনে বাচাঁর দিশা,ও সঠিক পথের পতাকাবাহী নিশানা।
লেখক : উত্তম কুমার পাল হিমেল
সাবেক সভাপতি,নবীগঞ্জ প্রেসক্লাব,হবিগঞ্জ।