বুধবার ● ১৪ ডিসেম্বর ২০২২
প্রথম পাতা » গাজিপুর » ১৫ ডিসেম্বর গাজীপুর মুক্ত দিবস
১৫ ডিসেম্বর গাজীপুর মুক্ত দিবস
মুহাম্মদ আতিকুর রহমান (আতিক), স্টাফ রিপোর্টার :: ১৫ ডিসেম্বর, গাজীপুর মুক্ত দিবস। এ দিন গাজীপুর মহানগরের ছয়দানা এলাকায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর বড় ধরনের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্র ও যানবাহন ধ্বংস এবং বহু সেনা নিহত হয়। রাজধানী ঢাকার সন্নিকটে গাজীপুরে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে দখলদার পাকবাহিনীর ব্যাপক বিপর্যয় ও ক্ষয়ক্ষতি তাদের পতন ও আত্মসমর্পণকে ত্বরান্বিত করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে গাজীপুরবাসীর রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই ১৯ মার্চ দেশের বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে এই গাজীপুরের মাটিতে সর্বপ্রথম হয়েছিল পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। সে সময় সারা দেশে স্লোগান উঠেছিল ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। আবার বিজয় লাভের পূর্বক্ষণে ১৫ ডিসেম্বর এই গাজীপুরের মাটিতেই সংঘটিত হয়েছিল হানাদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর সর্বশেষ বড় ধরনের সম্মুখ যুদ্ধ।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জয়দেবপুরের ভাওয়ালের রাজবাড়ীতে ছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট। অডিন্যান্স ফ্যাক্টরী, মেশিনটুলন্স ফ্যাক্টরীও ছিল তাদের দখলে। অবস্থানগত কারণে রাজধানীর পাশের জেলা গাজীপুরে পাক বাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি হিসেবে বহাল থাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায় পর্যন্ত।
২৫ মার্চের পর গাজীপুরের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, ছাত্র, কৃষক-শ্রমিক ও স্বাধীনতাকামী জনগণ ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়। প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা গাজীপুর জেলার বিভিন্ন পয়েন্টে যুদ্ধে অংশ নেন। ১৭ সেপ্টেম্বর মাজুখান রেল ব্রিজে পাঞ্জাবী সেনা ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দুকযুদ্ধ হয়। ১১ অক্টোবর ধীরাশ্রম এলাকায় এক যুদ্ধে কিছু পাঞ্জাবী সেনাকে মুক্তিযোদ্ধারা ধরে নিয়ে ডেমোরপাড়ায় আটকে রাখে। ১৪ অক্টোবর রাতে ধীরাশ্রমে প্রায় এক মাইল রেল লাইন উঠিয়ে ফেলা এবং ভোর রাতে জয়দেবপুর জংশনের দক্ষিণে সিগন্যাল সংলগ্ন সেতুতে মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
মূলত নভেম্বর মাস থেকে গাজীপুরে মুক্তিযোদ্ধারা সংঘবদ্ধ আক্রমণ শুরু করে। তারা বেশ কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে তৎপরতা শুরু করেন। গাজীপুর সেনানীবাস, সমরাস্ত্র কারখানা, রাজেন্দ্রপুর অর্ডিন্যান্স ডিপোসহ পাকবাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানে মুক্তিবাহিনী পরিকল্পিত আক্রমণ চালায়। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা গাজীপুরা রেল স্টেশনের কাছে মাইন বিস্ফোরেণ ঘটিয়ে ঢাকাগামী অস্ত্র গোলাবারুদবাহী একটি ট্রেনের কয়েকটি বগি ফেলে দেয়। এখানে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। ১৩-১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা গাজীপুরে সেনানিবাসে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনী জয়দেবপুরে টিকতে না পেরে ঢাকা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
উত্তর রণাঙ্গন অর্থাৎ ময়মনসিংহ-জামালপুর-টাঙ্গাইল থেকেও পাকবাহিনী মিত্র ও মুক্তিবাহিনী এবং বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনীর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পিছু হটে সড়কপথে ঢাকার দিকে হঠতে শুরু করে। এরা জড়ো হতে থাকে জয়দেবপুরের চান্দনা-চৌরাস্তায়। পিছু হটে আসার পথে পাকবাহিনী ব্রিজ কালভার্টসহ অনেক কিছু ধ্বংস করে দিয়ে আসে। পিছন থেকে মিত্র ও মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে। পিছু হটে আসা পাকবাহিনী ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কড্ডা ব্রিজটি ধ্বংস করে দিয়ে এলে ধাওয়া করা মিত্র ও মুক্তিবাহিনী গতিপথ পরিবর্তন করে কাশিমপুর গিয়ে অবস্থান নেয়। অপরদিকে, গাজীপুর সেনানীবাস, সমরাস্ত্র কারখানা এবং অর্ডিন্যান্স ডিপো থেকেও পাকসেনারা ৪-৫টি ট্যাংকসহ বিপুল অস্ত্রশস্ত্র সাজোয়া যানবাহনসহ পিছু হটে ঢাকা যাওয়ার পথে জড়ো হয় চান্দনা-চৌরাস্তায়।
পাকিস্তানীবাহিনী চৌরাস্তায় সমবেত হওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা ও মিত্রবাহিনী কাশিমপুর থেকে কামান-মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্র এনে বাসন, ভোগড়া, মোগড়খাল, শরীফপুর ইত্যাদি গ্রামে রাস্তার (ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের) দুপাশে অসংখ্য ব্যাঙ্কার খনন করে অবস্থান নেয়।
১৫ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর ২৫-২৬টি গাড়ীবহর সহকারে বিরাট একটি কনভয় চান্দনা-চৌরাস্তা থেকে রওনা হয় ঢাকার পথে। পুরো গাড়ি বহর ফাঁদপাতা অ্যাম্বুসে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কাশিমপুর থেকে মিত্র ও কাদেরিয়া বাহিনী তাদের উপর কামান ও মর্টারের শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। একই সঙ্গে সড়কের দুই পাশে অবস্থান নেওয়া মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর প্রবল গুলিবর্ষণে পাক হানাদার বাহিনী একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ধ্বংস হয় ট্যাংক, কামান, মর্টার, যানবাহন ও গোলাবারুদ। হতাহত হয় অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ঢাকার কাছে এটাই ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।
গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রোড, ভোড়া হাজীবাগ এলাকার বাসিন্দা যুদ্ধকালীন প্লাটুন কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ফুল মিয়া জানান, ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা নাগাদ গাজীপুর শত্রুমুক্ত হয়। পরে রাতে মানুষ উল্লাস করে জেলা শহরে প্রবেশ করে। ছয়দানা যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর চারজন শহীদ হন। পরে তাদের এখানেই শেষকৃত্য হয়।