মঙ্গলবার ● ২২ আগস্ট ২০২৩
প্রথম পাতা » খুলনা বিভাগ » সুন্দরবনে চলছে হরিণ শিকারের মহোৎসব : চলতি বছরে ৫০ জন হরিণ শিকারী আটক
সুন্দরবনে চলছে হরিণ শিকারের মহোৎসব : চলতি বছরে ৫০ জন হরিণ শিকারী আটক
এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট প্রতিনিধি ::বিশ্ব ঐতিহ্য পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ মায়াবী চিত্রল হরিণের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। থেমে নেই চোরা শিকারী ও পাচারকারীদের অপতৎপরতা। চোরা শিকারীদের কবলে পড়ে মারা পড়েছে অসংখ্য হরিণ। অসাধু বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে এসব হরিণ শিকার করছে পাচারকারীরা। এতে একদিকে যেমন সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ হরিণ অস্তিত্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ হওয়ায় বনের ইকো সিস্টেম নষ্ট হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সুন্দরবনের হরিণসহ সকল বন্য সম্পদ রক্ষায় আরও কঠোর ভাবে নজরদারি বাড়াতে হবে।মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে বনে প্রবেশ করে হরিণ শিকার : বন সংগলগ্ন বাসিন্দারাই বেশি জড়িত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আবারও খুলনার কয়রা থেকে হরিণের ৫৩ কেজি মাংস উদ্ধার করেছে পুলিশ। বুধবার ভোরে উপজেলার ৪নং কয়রায় শাকবারিয়া খালের পাশে অভিজান চালিয়ে এ মাংস উদ্ধার করা হয়। খালে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যায় পাচারকারী।
উপজেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রা উপজেলায় হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম সব চেয়ে বেশি। গত তিন মাসে এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫৩২ কেজি হরিণের মাংস, একটি গলাকাটা হরিণ, পাঁচটি চামড়া ও মাথা জব্দ করে প্রশাসন। এ সময় মামলা হয়েছে ১০টি, গ্রেফতার হয়েছেন ৬ জন। গত এক বছরে এক সংখ্যা ৫০ জনের বেশি। স¤প্রতি তিন মণ হরিণের মাংসসহ এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ অবস্থার মধ্যে গত ২৫ এপ্রিল কয়রা উপজেলা পরিষদের সম্মেলন কক্ষে উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় নির্বিচারে হরিণ নিধনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ পায়।
জানা যায়, বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এই চিত্রা হরিণ। কিন্তু দিনের পর দিন প্রশাসনের রেড এলাডসহ বিভিন্ন অভিযানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হরিণ নিধন করে যাচ্ছে পাচারকারীরা।
স্থানীয়রা বলছে, সুন্দরবনসংলগ্ন উপজেলা ও আশপাশের এলাকায় দাম কম হওয়ায় এই বন্যপ্রাণীর মাংসের চাহিদা বেড়েছে। এ সুযোগে গত কয়েক মাস ধরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চোরাশিকারিরা। বিভিন্ন উৎসব-পার্বনে এসব চোরাশিকারিদের দৌরাত্ম আরও বেড়ে যায়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় কয়েকটি চক্র অনেক আগে থেকেই হরিণ শিকারের সঙ্গে জড়িত। বনবিভাগের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে অগ্রিম ‘দাদন’ নিয়ে জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে বনে ঢুকে চোরা শিকারিরা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে ‘এজেন্ট ব্যবসায়ীদের’। এই এজেন্টদের মাধ্যমে কখনও অগ্রিম, আবার কখনও মাংস এনেও বিক্রি করা হয়। এই চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানেও পৌঁছে যায় হরিণের মাংস।
সুন্দরবন এ্যাকাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, “বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ চিত্রা হরিণ শিকার করছে কয়েকটি চক্র। যে পরিমাণ হরিণের মাংস ও চামড়া জব্দ হয়, তার থেকে কয়েকগুণ বেশি হরিণ শিকার হয়।শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সুন্দরবন থেকে ৩০ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করেছে বন বিভাগ। পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের তেরকাটি খাল এলাকা থেকে এসব হরিণের মাংস উদ্ধার করা হয়। বন বিভাগের টহল টের পেয়ে হরিণ শিকারিরা বনের ভেতরে গা ঢাকা দেন। তাই এ সময় শিকারিদের কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। তবে নৌকা ও বন বিভাগের দেওয়া একটি পাস উদ্ধার করেছে বন বিভাগের সদস্যরা।
রবিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সুন্দরবন থেকে ডিঙি নৌকা, হরিণ শিকারের ফাঁদসহ ২০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করে বন বিভাগ। সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ইসহাকের ছিলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে এসব হরণির মাংস জব্দ করা হয়। এ সময় কাউকে আটক করতে পারেননি বনরক্ষীরা।
শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জ থেকে ১২ কেজি হরিণের মাংসসহ চারজনকে আটক করে বন বিভাগ। বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের টহল দলের সদস্যরা সুন্দরবনের বঙ্গবন্ধুর চর থেকে এসব হরিণের মাংস বিক্রির সময় তাদের হাতেনাতে আটক করেন।
আটকরা হলেন- সজীব মিয়া (৩৫), নওশের আলী (৩২), ইদ্রিস আলী (৪০) ও নূর আলী (৩৮)। তারা সবাই খুলনার বাসিন্দা।
সোমবার (২৩ জানুয়ারি) বাগেরহাটের শরণখোলায় বসত বাড়ি থেকে হরিণের দুটি চামড়া জব্দ করে বন বিভাগ। শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের তানজির বয়াতির বাড়ি থেকে চামড়া দুটি উদ্ধার করা হয়। তবে এ সময় কাউকে আটক করতে পারেননি বনরক্ষীরা।
এর আগে রোববার (২২ জানুয়ারি) সুন্দরবন থেকে হরিণের মাংসসহ দুই শিকারিকে আটক করে বন বিভাগ। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের ডিমেরচর এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়। এ সময় ১৬ কেজি হরিণের মাংস, আটকদের ব্যবহৃত ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ১৫০টি ফাঁদ ও ২৫০ ফুট নাইলন সুতা জব্দ করেন বনরক্ষীরা।
আটক দুই হরিণ শিকারি হলেন- পিরোজপুরের পাথরঘাটা উপজেলার চরলাঠিমারা গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে মো. নিজাম (৪৫) ও করমজাতলার রতন আলীর ছেলে ইদ্রিস আলী (৪০)।
এদিকে মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) সুন্দরবন থেকে হরিণের মাংসসহ চার জেলেকে আটক করে বন বিভাগ। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের দুবলার চর শুঁটকি পল্লী সংলগ্ন নাড়িকেলবাড়িয়ার চর থেকে সাড়ে চার কেজি হরিণের মাংস জব্দসহ তাদের আটক করা হয়।
আটক চার জেলেরা হলেন- খুলনার পাইকগাছা উপজেলার প্রতাপকাঠি গ্রামের আহসান আলী খানের ছেলে সাফায়েত খান, হরিঢালি গ্রামের জরিব গাজীর ছেলে হোসেন আলী গাজী, কড়ইখালী গ্রামের আ. গফুর গাজীর ছেলে রনোকুল গাজী এবং নোয়াকাঠি গ্রামের সোহরাব গোলদারের ছেলে খলিলুর রহমান। আটক জেলেরা দুবলার চরে শুঁটকি আহরণে নিয়োজিত ছিলেন।
এর আগে ২০২২ সালেও সুন্দরবনের হরিণ শিকারিরা ছিল ব্যাপক তৎপর। প্রায় বছরজুড়েই হরিণ নিধনের খবর ছিল।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক ও সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা এম কে এম ইকবাল হোছাইন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি কম থাকে এ কারণে সহজে বনের মধ্যে ঢুকে যায় শিকারিরা। এ সময়ে হরিণ শিকারও একটু বেড়ে যায়। তবে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, সুন্দরবনের মধ্যে যদি কেউ হরিণ শিকারি ধরিয়ে দিতে পারেন তাহলে তাকে ২০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়। আর বনের বাইরে ধরিয়ে দিতে পারলে রয়েছে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার। যা গেজেটে উল্লেখ রয়েছে।
জানা যায়, সুন্দরবনের ৩০০ প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আর্কষণীয় প্রাণী হচ্ছে চিত্রা হরিণ। সুন্দরবনের আর্কষণীয় প্রাণীদের মধ্যে বাঘ ও চিত্রা হরিণ অন্যতম। বাঘের সংখ্যা কম হলেও হরিণের সংখ্যা প্রচুর; দেড় লাখের ওপরে। ফলে সুন্দরবনে যত্রতত্র হরিণের সাক্ষাৎ ঘটে পর্যটকদের। তাই বাঘের দেখা না পেলেও হরিণ দেখে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন পর্যটকরা।
যেভাবে চলে হরিণ শিকার: চলমান শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে ঝাঁকে ঝাঁকে হরিণের দেখা মিলছে। খাল বা নদীর ধারে দল বেধে হরিণের চলাফেরার দৃশ্য এখন হরহামেশাই চোখে পড়ে। যেসব এলাকায় হরিণের বিচরণ বেশি সেসব স্থানে নাইলনের জাল পেতে, বিষ মাখিয়ে, স্প্রিং বসানো ফাঁদ পেতে, কলার সঙ্গে বড়শি ঝুলিয়ে, চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে ও তীর অথবা গুলি ছুড়ে হরিণ শিকার করা হয়।
মাছ ধরার পারমিট নিয়ে হরিণ শিকারিরা রাতের আঁধারে গোপনে বনে ঢোকে। নাইলনের দড়ির এক ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করেন তারা। হরিণের নিয়মিত যাতায়াতের পথে এগুলো পাতা হয়। যাতায়াতের সময় হরিণগুলো আটকে যায়। এক রাতে ফাঁদ পেতে আসা হয়। পরের রাতে গিয়ে আবার ফাঁদ দেখা হয়। অনেক সময় এসব ফাঁদে আটকে হরিণ মারাও যায়। আবার অনেক সময় ফাঁদে পা আটকে জালে জড়িয়ে থাকে।
এসব ফাঁদ বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, বঙ্গবন্ধুর চর, কটকা, তালপট্টি, কচিখালি, দুবলা চান্দেরশ্বর, বগি, চরখালি এলাকায়। বিভিন্ন উপলক্ষে চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায় এসব এলাকায়। শিকারিরা বনের ভেতর থেকে হরিণ শিকার করে এনে লোকালয়ে থাকা সহযোগীদের হাতে পৌঁছে দেয়। বিভিন্ন জায়গায় হাতবদল হয়ে হরিণ পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
হরিণের মাংস চড়া দামে বিক্রি হয়। ক্রেতারাও অনেক সময় প্রতারণা ভেবে হরিণের মাংস কিনতে চান না। তাই তাদের প্রমাণ দেখাতে চোরা শিকারিরা জীবন্ত হরিণ লোকালয়ে এনে জবাই করে থাকেন।
প্রতি কেজি হরিণের মাংসের দাম পড়ে এক হাজার ৫০০ টাকা। আর আস্ত একটি জীবিত হরিণের দাম চাওয়া হয় ১৫ হাজার টাকা।
হরিণের চামড়া-শিং সৌখিন ব্যক্তিরা সংগ্রহ করে ড্রইংরুম সাজায়। এছাড়া বনাঞ্চল এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিরা হরিণের মাংস খেয়ে উৎসবও পালন করেন। কোনো বড় ধরনের স্বার্থসিদ্ধির জন্যও কর্তাব্যক্তিদের খুশি করতে গোপনে হরিণের মাংস সরবরাহ করেন; এমন তথ্যও পাওয়া গেছে।
শিকারি দমনে র্যাবের অভিযান দাবি: সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, বন্য প্রাণী হলো সুন্দরবনের আকর্ষণ। বাঘ বাঁচাতে হলে হরিণকে বাঁচাতে হবে। বনে বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ। তাই হরিণ না থাকলে বাঘও থাকবে না। সুন্দরবনের ইকো সিস্টেমের ভারসাম্য রাখতে সব প্রাণীরই প্রয়োজন। এ থেকে কোনো একটি না থাকলে সিস্টেম নষ্ট হয়ে যায়। সুন্দরবনের বন্য প্রাণী রক্ষায় সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। ২০০ বছর আগের ব্রিটিশদের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি দিয়ে এখনও চলছে বন। তখন তো জলবায়ু পরিবর্তন ছিল না, বনে এত পর্যটক ঢুকতো না। তাই বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে আধুনিক বন রক্ষার ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে হবে।
তিনি বলেন, সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ বাঘ ও হরিণ। বাঘের সংখ্যা তেমন না থাকলেও হরিণের সংখ্যা রয়েছে বেশি। তাই সুন্দরবনের যত্রতত্র হরিণের সাক্ষাৎ ঘটে পর্যটকদের। বাঘের দেখা না পেলেও হরিণ দেখে তারা আনন্দ পান। সেই হরিণ যদি শিকারিদের কারণে কমে যায় তাহলে বনের প্রতি আকর্ষণ কমে যাবে। র্যাব যদি সারা দেশের জঙ্গি দমন করতে পারে তাহলে সুন্দরবনের শিকারি দমন করতে পারবে না এটা তো হতে পারে না।
বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী যা বললেন: পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বলেন, হরিণ শিকার হচ্ছে বিষয়টি না জানার কিছু নয়। প্রতি পয়েন্টে পয়েন্টে তো লোক দিতে পারি না। সীমিত লোকবল ও জলযান নিয়ে সুন্দরবনের হরিণ রক্ষায় চেষ্টা করা হচ্ছে। এতটুকু জানি আমি প্রচেষ্টা চালিয়েছি। তবে পারিপার্শ্বিকতার কারণে সফল হতে পারিনি।
অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির আরও বলেন “মাঝে-মধ্যে দু-একটি অভিযানে হরিণের মাংস, চামড়া, মাথা জব্দ হলেও মূল চোরাশিকারি ও পাচারকারীরা থেকে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাংস বহনকারীরাই ধরা পড়ে। তারা দুর্বল আইনের কারণে কয়েক দিন পর জেল থেকে ফিরে একই কাজে লিপ্ত হন।
তিনি আরও বলেন, বনে বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ। সুন্দরবনের ইকো সিস্টেমের ভারসাম্য রাখতে সব প্রাণীরই প্রয়োজন। কোনো একটি না থাকলে সিস্টেম নষ্ট হয়ে যায়।
কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের বাসিন্দা সোলায়মান গাজী বলেন, সুন্দরবন প্রভাবিত কয়রার গ্রামগুলোতে বেশির ভাগই শ্রমজীবী মানুষের বসবাস। এসব গ্রামের প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ সুন্দরবন কেন্দ্রিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ উপজেলার ৩০টির বেশি চোরাশিকারি চক্র নির্বিচারে সুন্দরবনের হরিণ নিধন করছে।
কয়রার ইউএনও মোঃ মমিনুর রহমান বলেন, সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রায় সুন্দরবন কেন্দ্রিক অপরাধ প্রবণতার চিত্র তাদের উদ্বিগ্ন করেছে। তিনি আরও বলেন, বিশেষত হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম রুখতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বন বিভাগকে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেনের ভাষ্য, অল্প জনবল দিয়ে এত বড় বনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হয় বনবিভাগের। তারপরও হরিণ শিকার আগের তুলনায় অনেকাংশে কমেছে। র্যাব, কোস্ট গার্ড, বিজিবি ও বনবিভাগের নিয়মিত টহলের কারণে এখন বনে হরিণ শিকারের সুযোগ কম।
মোহসিন বলেন, বনে জলদস্যুরাই বেশি হরিণ শিকার করে খেত। ২০১৮ সালে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ায় পর এবং গত কয়েক বছর রাসমেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বনে হরিণ শিকার কমেছে।
তাছাড়া স¤প্রতিক বন্যপ্রাণী রক্ষায় অপরাধে জড়িতদের তথ্য প্রদানকারীকে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণার ফলে চোরাশিকারিদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ তথ্য দিতে উৎসাহিত হয়েছে। এখন মাংসসহ হরিণ শিকারি বেশি ধরা পড়ছে।প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস সহ নানা প্রকৃতিক দুর্যোগে নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মায়ের মতো উপকূলীয় কোটি-কোটি মানুষকে নিরাপদে আগলে রাখা সেই সুন্দরবন নিজেই এখন ভালো নেই। জলবায়ু পরিবর্তনে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, পরিবেশ দূষণ, জীববৈচিত্র ধ্বংসকারী চোরা শিকারি ও কাঠ পাচারকারীদের কারণে ম্যানগ্রোভ এই বন অস্তিত্ব সংকটে। যদিও বনবিভাগ বলছে, আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট প্যাট্রোলিংসহ সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি সুরক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
বন বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, ২০০১ সাল থেকে সুন্দরবনে অদ্যাবধি ৫৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। যারমধ্যে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু হয়েছে মাত্র ১৭টির। চোরা শিকারিদের বাঘ শিকার নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এক শ্রেণির জেলেরা আবার সুন্দরবনের মৎস্য ভান্ডারকে ঠেলে দিয়েছে মারাত্মক হুমকির মুখে। কেননা তারা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি মাছ ধরতে খালে বিষ প্রয়োগ করে মৎস্য আহরণ করে থাকে।
এদিকে গত কয়েক বছরের জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে সুন্দরবনে। উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ না থাকায় জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রেপানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও পূর্ণিমা ও অমাবস্যার জোয়ারে সুন্দরবনের সব থেকে উঁচু এলাকা করমরজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে পর্যন্ত ২ থেকে ৩ ফুট পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। এতে করে নষ্ট হচ্ছে নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণির ডিম। করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির জানান, পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কুমিরসহ যেসকল বন্যপ্রাণী ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে বংশবিস্তার করে তা ব্যাহত হচ্ছে।
সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন গবেষক ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের উপর পর্যটকদের চাপ কমানোসহ ইসিএ ভুক্ত এলাকায় নতুন করে শিল্প কলকারখানা নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। এই ম্যানগ্রোভ বনে লোকবলসহ নৌযানের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনের ওপর জীবিকায় নির্ভরশীলদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ চোরা শিকারি, কাঠপাচারকারী ও বনে আগুন দিয়ে সম্পদ লুটকারীদের দমন করতে পারলেই বহুলাংশে রক্ষা পাবে সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন নানা সংকটের মাঝেও আশার কথা জানিয়ে বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট প্যাট্রোলিংসহ সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি সুরক্ষার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি ১৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পের কাজ শুরু হলে দ্রুতই পুনরায় সব বন্যপ্রাণীর জরিপ কাজ শুরু হবে। বন্যপ্রাণীর সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে আগামী জুন মাসের মধ্যে ৮৪টি পুকুর খনন ও পুনঃখনন কাজ শুরু হবে । পাশাপাশি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে সুন্দরবনকে সুরক্ষিত করা হবে বলেও জানান তিনি।
সুন্দরবন সকল ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেমন ক্ষতবিক্ষত হয়ে মায়ের মতো উপকূলীয় কোটি-কোটি মানুষসহ দেশকে নিরাপদ রাখে তেমনি এ জনপদের লাখ-লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন হিসেবেও কাজ করে। তাই সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি রক্ষায় সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এখন উপকূলীয় কোটি মানুষের প্রাণের দাবী।
প্রসঙ্গত, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৫২ ভাগই এখন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। বনের মোট আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগই হচ্ছে জলাভূমি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই জলাভূমি ‘রামসার’ এলাকা হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বের অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বনের তুলনায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র আবার অধিকতর সমৃদ্ধ। সুন্দরীসহ এই বনে রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড। বাঘ, হরিণ, কুমির, কিং কোবরা, বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতিসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ২১০ প্রজাতির মৎস্য সম্পদ।