বুধবার ● ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
প্রথম পাতা » খাগড়াছড়ি » অপহরণ ঘটনা সম্পর্কে এন্টি চাকমার বিবৃতি
অপহরণ ঘটনা সম্পর্কে এন্টি চাকমার বিবৃতি
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি :: গত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ আমি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ৯১তম আত্মাহুতি দিবস উপলক্ষে সাজেকে আয়োজিত আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ শেষে খাগড়াছড়ি ফিরে আসছিলাম। আমার সাথে ছিলেন খাগড়াছড়ি কলেজের ছাত্রী কর্ণিয়া চাকমা ও এস এস সি পরিক্ষার্থী নিশা চাকমা। আমাদের মহেন্দ্র গাড়ি দিঘীনালা ক্যান্টনমেন্ট পার হওয়ার পর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে মাইনী রিসোর্ট এলাকায় পৌঁছলে ঠ্যাঙাড়ে নব্য মুখোশ বাহিনীর ৬ জন সদস্য আমাদের আটকায়। তাদের একজন আমাদের গাড়িতে ওঠে এবং ব্যাগ চেক করে। তার হাতে ছিল একটি পিস্তল। বাকিরা আমাদের গাড়ির সামনে ও পেছনে দু’টি মোটর সাইকেলে পাহারা দিয়ে আমাদের গাড়ির চালককে কলেজ পাড়া ও থানা বাজার অতিক্রম করে দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি সড়ক থেকে দূরে একটি পাড়ায় নিয়ে যেতে বাধ্য করে এবং সেখানে ইউনিসেফ পরিচালিত একটি পাড়া কেন্দ্রে আমাদেরকে বন্দী করে রাখে। তবে রাতে আমাদের তিন জনকে দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি সড়কের পাশে এক ঠ্যাঙাড়ের বাসায় রাখা হয়। ঠ্যাঙাড়েরা সর্বক্ষণ আমাদের পাহারা দিয়ে রাখে, যাতে আমরা কোনভাবে পালিয়ে যেতে না পারি।
ঠ্যাঙাড়েরা আমরা কোথায় গিয়েছি, কেন সংগঠনের কাজ করছি ইত্যাদি বিষয়ে জিজ্ঞেস করে। অনেকের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত রূঢ়। তাদের কয়েকজনকে আমি চিনি, কারণ তারা বর্তমানে সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট ভাড়াটে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীতে কাজ করলেও ইতিপূর্বে ইউপিডিএফের সাথে জড়িত ছিল।
মাইনী রিসোর্ট এলাকায় আমাদের আটকের পর থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত পুরো সময় আমরা নিদারুণ ভয়, উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের মধ্যে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ছিলাম অত্যন্ত শঙ্কিত।
কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় আমার মনে হয়েছে, ঠ্যাঙাড়েরা তাদের মদদদাতাদের নির্দেশে আমাদের অপহরণ করেছে। প্রথমত, তারা কাদের নির্দেশে ও মদদে পরিচালিত তা সবাই জানেন। কোন শক্তিশালী মহলের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া দীঘিনালা থানা সদর এলাকায় সশস্ত্রভাবে ঘোরাফেরা করা ও দিন দুপুরে অপহরণের মতো ঘটনা সংঘটিত করা আদৌ সম্ভব হতে পারে না। তাছাড়া এখানে একটি সেনানিবাস রয়েছে এবং সাজেকে আসা-যাওয়া করা পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য এই সড়কে সচরাচর কড়া টহল দেয়া হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, আমরা ছাড়া পাওয়ার পর জানতে পেরেছি যে, আমাদের উদ্ধারের ব্যাপারে সেনাবাহিনী ও সিভিল প্রশাসন কোন পদক্ষেপ নেয়নি, তারা ছিল একেবারে নির্লিপ্ত। আমাদের সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা দীঘিনালা থানার ওসির সাথে ফোনে যোগাযোগ করেছিলেন, কিন্তু তিনি তার ফোন রিসিভ করেননি। একই থানার এএসপি মাহবুবাকে ফোন করা হলে তিনি থানা কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করবেন বলে ফোন রেখে দেন। তৃতীয়ত, আমরা বন্দী থাকার সময় আমাদের অপহরণকারীরা আমাদের নিয়ে কী করবে সে বিষয়ে জানার জন্য সব সময় ফোনে অন্য কারোর সাথে যোগাযোগ করে পরামর্শ চাইত। চতুর্থত, আমাদের অপহরণ করে ঠ্যাঙাড়েদের কোন লাভ হতে পারে এমন কোন বিষয় ছিল না। তারা আমাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ কিংবা অন্য কোন স্বার্থ দাবি করেনি। এসব কারণে এটা মনে করা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত যে, তারা তাদের মদদদাতাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাদের নির্দেশে আমাদের অপহরণ করে থাকতে পারে। যেমনটা ২০১৮ সালের ১৮ মার্চ রাঙামাটির কুদুকছড়ি থেকে আমাদের হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রী মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছিল।
আমাদের তিন জনকে জোরপূর্বক অপহরণ করে বন্দী করে রেখে ঠ্যাঙাড়েরা আমাদের ব্যক্তি ও নাগরিক স্বাধীনতা হরণ করেছে, যা গুরুতর অপরাধ। গণতান্ত্রিক ও সভ্য দেশে এ ধরনের ঘটনা সহ্য করা হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে পাহাড়ি জনগণের বিরুদ্ধে এবং বিশেষত আমরা যারা ন্যায্য অধিকারের জন্য লড়াই করছি তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হলে তার কোন ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না। মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমার অপহরণ এবং তার আগে ১৯৯৬ সালে কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনা তার জাজ্জ্বল্য দৃষ্টান্ত । তাদের অপহরণকারীদের আজ পর্যন্ত গ্রেফতার কিংবা শাস্তি হয়নি।
তারপরও আমাদের ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই অব্যাহত থাকবে। সে কারণে আমি সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে সরকারের কাছে নিন্মোক্ত দাবি তুলে ধরছি :
অবিলম্বে আমাদের অপহরণের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।
যারা অপহরণে মদদ দিয়েছে তাদেরকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হোক।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী ভেঙে দিয়ে তাদের দ্বারা সংঘটিত খুন, গুম ও অপহরণ ঘটনার বিচার করা হোক এবং দোষীদের শাস্তি দেয়া হোক।
পাহাড় ও সমতলে নারীদের নিরাপত্তার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।