রবিবার ● ৮ অক্টোবর ২০২৩
প্রথম পাতা » খাগড়াছড়ি » খাগড়াছড়িতে দুই দিনব্যাপী পিসিপি’র ২১তম কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলন সম্পন্ন
খাগড়াছড়িতে দুই দিনব্যাপী পিসিপি’র ২১তম কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলন সম্পন্ন
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক থুইলাপ্রু মারমা প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এর ২১তম কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলন গত ৬-৭ অক্টোবর ২০২৩ খাগড়াছড়িতে সম্পন্ন হয়েছে।
সম্মেলনের ১ম অধিবেশনে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ-মূল)এর সংগঠক ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাবেক সভাপতি অংগ্য মারমা নিপীড়িত জাতি ও জনগণের সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে পিসিপি নেতা-কর্মীদেরকে আরো যোগ্য, দক্ষ ও লড়াইয়ে উপযুক্ত সৈনিক হিসেবে গড়ে উঠার আহ্বান জানিয়েছেন।
দু’দিন ব্যাপী প্রতিনিধি সম্মেলনের প্রথম দিন (৬ অক্টোবর) পিসিপির দলীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে দলীয় পতাকা উত্তোলন করে ২১তম প্রতিনিধি সম্মেলন উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, সংগঠনের গঠনতন্ত্র ও দাবিনামা সংশোধন, প্রতিনিধিদের বক্তব্য পর্বসহ ৫টি অধিবেশনে ভাগ করে সম্মেলন সম্পন্ন করা হয়।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন শেষে গত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ দীঘিনালায় সেনা মদদপুষ্ট মুখোশ বাহিনী সন্ত্রাসী কর্তৃক অপহৃত হওয়া কলেজ শিক্ষার্থী কর্নিয়া চাকমা’র মাধ্যমে তিন জনকে ফুলের তোড়া দিয়ে সংবর্ধনা প্রদান করেন পিসিপির সভাপতি অঙ্কন চাকমা।
“লড়াইয়ে উপযুক্ত কর্মী হোন, সংগঠনকে আরও সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করুন” এই স্লোগানে ২১তম কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে ১ম অধিবেশনে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) কেন্দ্রীয় সভাপতি অঙ্কন চাকমা সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট(ইউপিডিএফ-মূল) এর অন্যতম সংগঠক অংগ্য মারমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক পরিণীতা চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রজেন্টু চাকমা। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পিসিপি’র কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শুভাশীষ চাকমা।
সম্মেলনে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন পিসিপি কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক সোহেল চাকমা। শোক প্রস্তাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আদোলনের প্রথম শহীদ ভরদ্বাজ মুনি চাকমা, রুপন, সমর-সুকেশ-মনতোষ, মংশে, ক্যজাই, মিঠুন, তপন, এল্টন, পলাশ চাকমাসহ সারা বিশ্বে নিপীড়িত জাতি ও জনগণের মুক্তি লড়াই আত্মনিবেদনকারী বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে দাঁড়িয়ে ২ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
প্রাকৃতিক বৈরী পরিবেশ মোকাবিলা করে তিন পার্বত্য জেলা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দেড় শতাধিক পিসিপি’র প্রতিনিধি-পর্যবেক্ষক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলনে ১ম দিনের দ্বিতীয় অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক, অর্থ সম্পাদক, দপ্তর সম্পাদকের রিপোর্ট উত্থাপন করা হলে উপস্থিত প্রতিনিধিরা রিপোর্টের ওপরে পর্যালোচনা, সমালোচনা, সংযোজন-বিয়োজন করে করতালির মাধ্যমে পাস করেন।
প্রথম দিনের তৃতীয় অধিবেশনে ১৯৯২-২০১৩ সালের সংগঠনের লড়াই সংগ্রামে ওপর নির্মিত ভিডিও, ২০১৮ সালে ৭ মার্চ মুখোশ প্রতিরোধ দিবস পালন করতে গিয়ে খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর বাজারে সেনা-পুলিশ-বিজিবি হামলা ও অকুতোভয় সহযোদ্ধাদের প্রতিরোধ সংগ্রামের ভিডিও চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
প্রতিনিধি সম্মেলনের ১ম অধিবেশনে ইউপিডিএফ সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, বাস্তব পরিস্থিতিতে পিসিপিকে যথোপযুক্ত ও বাস্তবমুখী কর্মসূচি দিতে হবে। পিসিপি অন্যায়ের কাছে কোনদিন আপোষ করেনি। এখনও পিসিপির প্রতিবাদী ধারা অব্যাহত রয়েছে। ১৯৯২ সালে রাঙামাটিতে ৩য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্যে সুনির্দিষ্টভাবে ‘স্বায়ত্তশাসন’ দাবি উত্থাপন করা হয়। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের এ কর্মসূচিকে ভ-ুল করে দেয়ার জন্যে সেনা প্রশাসন ও দালাল-প্রতিক্রিয়াশীলরা সবসময় তৎপর ছিলেন। সে সময়ে ১২-১৪ ই জুন অনুষ্ঠিত হওয়া প্রথম কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের একক নেতৃত্বে ‘স্বায়ত্তশাসনের’ দাবি তোলা উচ্চাভিলাষী চিন্তা কিনা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল।
তিনি বলেন, আমি মনে করি সেসময়ে যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারা রাজনৈতিক লাইনগতভাবে জয়লাভ করেছিলেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছিল পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ।
তিনি আরো বলেন, আমরা যদি নিজেদের সম্পর্কে জানি, শত্রু সস্পর্কে জানি তাহলে আমাদের কেউ পরাজিত করতে পারবে না। সুতরাং সংগঠনের সংগ্রামী ঐতিহ্য ধারণ করে পিসিপি’র সঠিক রাজনৈতিক আদর্শকে সমুন্নত রাখতে হবে।
পিসিপি’র সভাপতি অঙ্কন চাকমা বলেন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়েও পার্বত্য চট্টগ্রাম ও দেশের জাতীয় ছাত্র রাজনীতিতে আজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে পিসিপি’র আপোষহীন লড়াই-সংগ্রাম শাসকগোষ্ঠীকে সবসময় ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখেছে।
তিনি রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পাশাপাশি বিভিন্ন সেমিনার, পাঠচক্র, আলোচনা সভা, সিম্পোজিয়াম ইত্যাদির মাধ্যমে কর্মী-সহযোদ্ধাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন ও দক্ষতা অর্জনের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
সম্মেলনে নীতি চাকমা বলেন, আন্দোলন সহজ-সরল নয়। বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। আমাদেরকে শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন ও রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে শত প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে।
তিনি আরো বলেন, শাসকগোষ্ঠী নারী নিপীড়নকে জাতিগত নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নিপীড়ন অব্যহত রেখেছে। ধর্ষণ-খুন-অপহরণ এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হচ্ছে না।
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে নারী নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
নারী নেত্রী পরিণীতা চাকমা বলেন, আমাদের সামনে যতই বাধা আসুক না কেন আমাদেরকে শক্তিশালী মনোবল নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম জারি রাখার আহ্বান জানান তিনি।
যুব নেতা রজেন্টু চাকমা বলেন, যোদ্ধা মানে এই নয় যে আমরা সবসময়ে বিজয়ী হবো, যোদ্ধা হলো সে যে সবসময় আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে থাকে। সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের মাধ্যমে সাইবার সিকিউরিটি আইনে রূপান্তর করেছে সরকার। কিন্তু পূর্বের ন্যায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা বলবৎ রেখে বাক স্বাধীনতা, জনগণের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও অধিকার হরণ করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, সারাদেশে সরকার আইন, শাসন, বিচার বিভাগ কব্জা করে জনগণের উপর স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বজায় রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে দমানোর জন্যেও শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেজন্যে শাসকগোষ্ঠীর পাতানো ফাঁদে পা না দিয়ে আমাদেরকে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন কায়েম করতে হবে।
কলেজ শিক্ষার্থী কর্নিয়া চাকমা সংবর্ধনা শেষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে অপহরণের ঘটনা ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, সেদিন দীঘিনালায় সিএনজি আটকিয়ে মুখোশরা আমাদের অপহরণ করেছিল। অপহরণের সময় প্রথম দিকে ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু পরে আমরা সাহসের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা ও ভয়কে জয় করেছি। তিনি বলেন, আজকে আমরা অপহরণের শিকার হয়েছি, হয়তো পরে আরো অনেকে এ ধরণের ঘটনার শিকার হবে। তাই ভয়ে ভীত না হয়ে জাতির দালাল, প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
দ্বিতীয় দিনের ১ম অধিবেশনে গঠনতন্ত্র ও দাবিনামা সংশোধনের প্রস্তাব পেশ করেন গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা ও সংশোধন কমিটির সদস্য রোনাল চাকমা। গঠনতন্ত্র নিয়ে প্রতিনিধিরা দিনব্যাপী আলোচনার পর গঠনমূলক মতামত ও সংগঠনকে আরো গতিশীল করার লক্ষ্যে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। পরে করতালি ও হাত উঁচিয়ে গঠনতন্ত্র পাস করে নেন।
গঠনতন্ত্রে পূর্বের সংশোধিত রাজনৈতিক দাবিনামার সাথে নতুন কিছু সম্পূরক দাবি যুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো:
১.স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের আরোপিত দমনমূলক ‘১১ নির্দেশনা’ বাতিল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে র্যাব ও মাউন্টেন পুলিশ মোতায়েন বাতিল করতে হবে।
২. সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগত সেটেলার বাঙালি ও রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।
৪.পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা-সেটেলার কর্তৃক নারী ধর্ষণ, গুম, অপহরণ, খুন বন্ধসহ নারী নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের বিচার করতে হবে।
৫. বান্দরবানে বম জাতিসত্তার জনগণের উপর সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মিজোরামে আশ্রিত শরনার্থীদের দেশে ফেরত এনে যথাযথ পুনর্বাসন করতে হবে।
৬. পার্বত্য চট্টগ্রামের বন-পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসকারী সীমান্ত সড়ক নির্মাণ বন্ধ ও উন্নয়নের নামে পাহাড়িদের ভূমি বেদখল করে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন বন্ধ করতে হবে।
৭. পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে সেনা-গোয়েন্দা নজরদারি বন্ধ করে শিক্ষার গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
৮. ৫টি জাতিসত্তার মাতৃভাষায় চালুকৃত প্রাথমিক শিক্ষায় পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ শিক্ষা বোর্ড চালু করতে হবে।
৯. পার্বত্য জেলা পরিষদের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের ঘুষ বাণিজ্য ও দুর্নীতি বন্ধ করে যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকদের নিয়োগ প্রদান করতে হবে।
১০. পাহাড়ি জাতিসত্তাসমূহের প্রধান উৎসব ‘বৈসাবি’ উপলক্ষে সরকারিভাবে ৫দিনের ছুটি প্রদান করতে হবে।
দু’দিন ব্যাপী প্রতিনিধি সম্মেলনে সংগঠনের গতিশীলতা ও ভিত্তি গড়ে তুলতে কর্মসূচিও গ্রহণ করা হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ।