সোমবার ● ১৩ নভেম্বর ২০২৩
প্রথম পাতা » এক্সক্লুসিভ » স্মৃতি কথা : পর্ব-২
স্মৃতি কথা : পর্ব-২
আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে আরো ৫২ বছর আগে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার মামা বাড়ি নিয়ে এবং আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম কেমন ছিলো তার কিছু স্মৃতি স্মরণ করার চেষ্টা।
পর্ব-১ : ১ নভেম্বর-২০২০ সালে লেখা হয়। ২ বছর ১২ দিন পর স্মৃতি কথা : পর্ব-২ লেখতে বসলাম।
আমি কেবলমাত্র স্মৃতি কথা বলার চেষ্টা করব; কারণ বসতঃ কারো কোন স্মৃতি বলতে গিয়ে ভাষাগত ত্রুটি হলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।
আমি প্রথম পর্বে বলেছিলাম আমার মায়ের বাবার পেশা ও তিনি যে বার্মায় (বর্তমান মায়ানমার) এর আইক্কাব থেকে বিয়ে করেছিলেন তার কথা। আমার বাবা (প্রয়াত রুহিনী রঞ্জন বড়ুয়া-মৃত্যু সাল ২০০৫ ইংরেজি) বর্তমানে ভোটার তালিকায় বাবার নামের রঞ্জন শব্দটি বাদ দিয়ে কেবলমাত্র (প্রয়াত রুহিনী বড়ুয়া), আমার মা (প্রয়াত পুষ্প রানী বড়ুয়া-মৃত্যু সাল ২০০৭ ইংরেজি) কে বিয়ে করেন ১৯৫৮ সালের দিকে তিন কুড়ি (৬০) টাকা দাভা(পণ) দিয়ে অথাৎ মেয়ের বাবাকে যৌতুক বা ২শত মানুষকে প্রীতি ভোজ করানোর জন্য বিয়ের খরচ বাবদ বর পক্ষ কণ্যার পিতাকে সেই আমলে নগদ ৬০/= টাকা পরিশোধ করে বাবা-মাকে বিয়ে করেন।
তৎকালিন রাঙামাটি জেলা শহরের প্রধান বা সরকারি অফিস ছিলো কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনায়। আমাদের ঘর ছিলো তখন রাঙামাটির মানিকছড়িতে। সাম্পানে করে যাতায়ত করতেন বাবা মানিকছড়ি থেকে চন্দ্রঘোনায়।
আমার মায়েরা ছিলেন ৩ ভাই ও ৫ বোন, আমার বড় মামা নাম শান্তি বড়ুয়া, মেজ মামা ধনঞ্জয় বড়ুয়া আর ছোট মামা হিরামন বড়ুয়া (গুরা), আমি মায়ের বড় ১ বোন হোয়রাপাড়া, বড় আরেক বোন শিলক ও ছোট ১ বোন পদুয়াতে দেখেছি।
আমার মায়ের মা অথাৎ আমার দিদিমা যখন মারা যান, তখন বিশাল বড় চায়ের কেতলী দিয়ে চা ও টোষ্ট বিস্কুট দিয়ে আগত অতিথিদের চা বন্টনের স্মৃতি মনে আছে। আমার দিদি মায়ের মৃতদেহ মামা বাড়ির উঠানে খাটের ওপর রাখা হয়। সেই সময়ে আমার মায়ের বোনেরা অথাৎ আমার বড় মাসি ও ছোট মাসিরা সবাই বিলাপ (কান্না-কাটি) করছেন এবং তাদের মায়ের পায়ের তালুতে হলুদ মেখে তারা তাদের মায়ের পায়ের চাপ সাদা কাপড়ে নেয়ার স্মৃতি আমার আদৌ মনে পড়ে।
আমার মা তার মায়ের যে পায়ের চাপ নিয়ে ছিলেন সেই সাদা কাপড় বেশ অনেক বছর স্বযত্নে সংরক্ষণ করতে দেখেছি।
১৯৭১ সালের আগেই মানিকছড়ি থেকে বাবা আমাদের নিয়ে আব্দুল মাবুত মামার কাছ থেকে জায়গা ক্রয় করে ভেদ ভেদীতে এসে ঘরসহ বাগান বাড়ি সৃজন করেন। আর দাদুরা মানিকছড়ি থেকে চলে যান রবার বাগান, ঢালারমূখ এলাকার গোদারপাড়। মানিকছড়ি থাকাকালিন কোন একদিন সন্ধ্যায় পাহাড় থেকে নিজেদের গরু আনতে গেলে দাদরু চোখে কেইচ্ছা গাছের খোছা লেগে দাদুর চোখ নষ্ট হয়। দেশে যুদ্ধচলাকালিন আমার বাবার বাবা আমার দাদু গোদারপাড় ছিলেন।
আমার দাদুর নাম সুরেন্দ্র লাল বড়ুয়া, দাদুর বাবার নাম ছিলো হরিশ চন্দ্র বড়ুয়া, তাঁর বাবার নাম ছিলো নীলাম্বর বলি (গুরান্না মগ), তাদের বাড়ি ছিলো চট্টগ্রামের রাউজান থানার লাম্বুরহাট (মগ্যারটেক), বর্তমান বাগুয়ান ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ুয়া পাড়া।
আমার দাদু সেই সময়ে মেট্টকুলেশন পাশ ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম-আইক্কাব-রেঙ্গুন ও চট্টগ্রাম-কলকাতা নৌপথে ইষ্টিমারে কেরানীর কাজ করতেন, সময় পেলে কুস্তি (বলি) খেলা আর ফুটবল খেলা খেলতেন। দাদু নৌপথে ইষ্টিমারে কেরানীর চাকুরী ছেড়ে দিয়ে লাল পাগড়ি পড়া পুলিশের চাকুরী নেন। পুলিশের চাকুরীতে থাকাকালিন আমার দাদু হিটলারের পক্ষে সৈনিক হিসাবে ২য় বিশ^যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন।
দাদু আমাকে তাঁর নিজের মূখে বলেছেন, ২য় বিশ্বযুদ্ধে তাদের প্রথমে নৌপথে চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে ট্রেন যোগে ভারত সীনান্তে তার পর দুর্গম পাহাড় দিয়ে হেঁটে চীন সীমান্তে গিয়ে তাদের জাপানী সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়, তাদের সাথে ভারতীয় সৈন্যরাও যুদ্ধে ছিলেন। তাদের যুদ্ধ যেমন ছিলো ; তাদের পক্ষের কমান্ডার ১টি উচুস্থানে দাঁড়াতেন কমান্ডারের পাশে একজন সৈন্য বিগল বাজালে বাংকার থেকে যোদ্ধারা বের হয়ে আসে তারপর কমান্ডার তার হাতে থাকা লাঠি নীচের দিকে ইশারা করলে সৈন্যরা বাংকারে লাফ দিয়ে ভিতরে চলে যায়, কমান্ডার লাঠি ওপর দিকে ইশারা করলে সৈন্যরা বাংকার থেকে ওঠে আসে আবার কমান্ডার তার হাতে থাকা লাঠি সামনের দিকে ইশারা করলে সৈন্যরা গুলি ছোড়েন। এভাবে যুদ্ধকয়েক ঘন্টা চলার পর উভয় যোদ্ধাদের মাঝখানে সাদা পতাকা উত্তলন করা হয়, তার পর যুদ্ধ বিরতী। তখন না-কি উভয়যোদ্ধা এক ক্যান্টিনে নাস্তা খেতেন। দাদু বলেছেন, তাদের যুদ্ধ শেষ হলে তারা দুর্গম পাহাড় দিয়ে হেঁটে আবারও চীন সীমান্ত আর ভারত সীমান্ত হয়ে গভীর জঙ্গল দিয়ে মাসের পর মাস হেঁটে আড়াই মাস পর দেশে আসেন। তাদের পানির পিপাসা লাগলে তাঁরা হাতির পায়ের ছাপে মাটির গর্তে জমে থাকা বৃষ্টির পানি খেতেন, কলা গাছ কেটে খেতেন, পাহাড়ের ফল-মুল আর লতা-পাতা খেতেন, মাঝে-মধ্যে হেলিকপ্টার থেকে রান্না করা খাবার, ছাতু ও বিস্কুট জঙ্গলে ফেলতেন আর সৈন্যরা তা নীচ থেকে কুড়িয়ে খেতেন এবং তাদের জীবন রক্ষা করতেন। দাদু বলেছেন সেই সময়ে ম্যালেরিয়া, সাপের কামড় ও অসুখে পথমধ্যে তাদের সাথের অনেক সৈন্য মারা পড়েছেন। দাদু প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তাঁর সাথে যোদ্ধা মারা যাওয়ার ফলে মনের কষ্টে-ক্ষোপেতিনি আর সেই পুলিশের চাকুরীতে যোগদান করেননি।
২য় বিশ্বযুদ্ধের বিশ্বব্যাপী ১৯৪২-১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে দাদু লাম্বুরহাট থেকে সাম্পান নিয়ে স্বস্ত্রীক পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙামাটি (হেরিকেন) চলে আসেন, সেই সময়ে আমার বাবা (রুহিনী রঞ্জন বড়ুয়া) বয়স ছিলো ১৩ বছর। দাদু পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙামাটি এসে চাকমা রাজবাড়িতে খাজাঞ্চি হিসাবে দায়িত্ব পালনের কথা বলেছিল। সেই সময়ে চাকমা রাজার রাজ্য রাঙামাটি,রাঙ্গুনিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ছিলো। তৎকালিন পার্বত্য অঞ্চলে রাজপ্যুনায় চান্দির ১০ টাকার নোট দেখাতে টেকনাফ থেকে লোক আসতেন।
চাকমা রাজবংশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ; ১৯০৭ সালে কুমার ভুবন মোহন সাবালক হয়ে সিংহাসন আরোহণ করেন। রাজা ভুবন মোহন রায়ের মৃত্যুর পর যুবরাজ নলিনাক্ষ রায় ১৯৩৫ ইংরেজীর ৭ই মার্চ, বিভাগীয় কমিশনার মিঃ টুইনাম আই. সি. এস. মহোদয় কর্তৃক রাজা গদীতে অভিষিক্ত হন।
রাজা নলিনাক্ষ রায় বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইংরেজী সাহিত্য এম. এ. পর্যন্ত অধ্যায়ন করেন। রাজ কুমার বিরূপাক্ষ রায় ডিস্ট্রিক্ট কন্ট্রোলার হিসাবে চাকুরী করার পর অবসর গ্রহণ করেন। তিনি গভর্নমেন্ট প্রদত্ত রায় বাহাদুর উপাধি প্রাপ্ত হন।
রাজা নলিনাক্ষ রায় মাত্র ১৬ বছর রাজত্ব করেন। ১৯৩৯ সালের ৮ জুন সম্রাট ষষ্ঠ জর্জের জন্মদিবস উপলক্ষে সম্রাট জয়ন্তীতে তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি প্রদান করা হয়।
রাণী বিনীতা রায় একজন সাহিত্য সেবী ও স্বশিক্ষিত মহিলা। তাঁর আগ্রহে ও সাহায্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র পত্রিকা “গৈরিকা” একসময় পরিচালিত হতো। রাজা নলিনাক্ষ রায়ের সময়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্থান স্বাধীনতা লাভ করে।
১৯৫১ সালের ৭ অক্টোবর তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তিনি সফলভাবে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৫৩ সালে ত্রিদিব রায় রাজ্যভার গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজা ত্রিদিব রায় বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্থানের পক্ষাবলম্বন করার অভিযোগে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে তিনি পাকিস্থানে চলে যান।
সেকারণে তাঁর ছেলে বর্তমান চাকমা সার্কেল চিফ রাজা দেবাশীষ রায় ১৯৭৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর ৫১তম রাজা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়ের জন্ম ১৯৫৯ সালের ৯ এপ্রিল। চাকমা রাজার শাসন ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা জানা যায় বিশাল পার্বত্য রাজ্য গঠনের পর পরই। রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বর্তমান চাকমা রাজা। সূত্র : জুম্ম জার্নাল ব্লগ থেকে)।
১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাধ হওয়ার পর কাপ্তাই লেকে তখনকার পুরাতন চাকমা রাজবাড়ি ডুবে যায় পানির নিচে। সেটা ছিলো একটি মর্মান্তিক ঘটনা তৎকালীন পূর্ব বাংলার ইতিহাসে। শুধু রাজবাড়ি না আশেপাশের হাজারো মানুষের ঘর, ফসলি জমি সব পানির নিচে চলে যায় সেই বাধ হওয়ার পর। সব কিছু হারিয়ে প্রায় ৪০ হাজার লোক ভারতে চলে যায় শরনার্থী হয়ে নিজেদের ঘর বাড়ি ছেড়ে। বাসস্থান হারায় আশেপাশের এলাকার ১ লাখ লোক। কোন প্রকার সুনির্দিষ্ট ক্ষতিপূরণ ছাড়াই কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। খুব সামান্য কিছু লোক ক্ষতিপূরণ পায়, যা পায় তার পরিমাণও ছিলো সামান্য। এত মানুষের সব কিছু উজাড় করে, ঘরবাড়ি তলিয়ে দিয়ে সেনাশাসক আইয়ুব খানের তাদের যথাযথ পুনর্বাসন না করার এই ধরনের সিদ্ধান্ত ছিলো অমানবিক। দুঃখের বিষয় তখনকার চাকমা রাজা এর জোরালো বিরোধিতা করেননি, নিজের রাজবাড়িটিও বাচাতে পারেননি। ১৯৬২ সালে চাকমা রাজার রাজবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পর দাদুর ধর্মভাই ১০২ রাঙাপানি মৌজার তৎকালিন হেডম্যান যোগেন্দ্র দেওয়ানের সাথে ঝগড়াবিল পরে মানিকছড়ি চলে যান। এসময় যোগেন্দ্র দেওয়ানের ২য় ঘরের সন্তান সুজিত দেওয়ান জাপান রাঙামাটি বোর্ডিং স্কুলে (বর্তমান রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) লেখা পড়া করতেন আমার বাবা মাঝে-মধ্যে বোর্ডিং স্কুলে সুজিত দেওয়ান জাপান কাকাকে দেখতে যেতেন, তখন সুজিত দেওয়ান জাপান কাকার বন্ধু চিত্তকিশোর চাকমার ছেলে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা (মন্জু) ও জ্যোতিরিন্দ্রবোধিপ্রিয় লারমা প্রকাশ সন্তু লারমার সাথে বাবার ঘনিষ্টতা তৈরী হয়। ২০০১ সালে আমি তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ক্রীড়া সংস্থার সাধারন সম্পাদক, সুজিত দেওয়ান জাপান কাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ক্রীড়া সংস্থার সহসভাপতি, জ্যোতিরিন্দ্রবোধিপ্রিয় লারমা প্রকাশ সন্তু লারমা ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, পদাধিকার বলে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ক্রীড়া সংস্থার একটি কাজে আমি আর জাপান কাকা জ্যোতিরিন্দ্রবোধিপ্রিয় লারমা প্রকাশ সন্তু লারমা মহোদয়ের কল্যাণপুর বাসভবনে যাই, বাবা আমাদের সাথে গেলে লারমা স্যার, জাপান কাকা আর বাবা ওনাদের তিজনের সেই ছোটবেলার গল্প শোনে আমি তো হতভাগ। বাবা যতবার সন্তু লারমা স্যারের বাসভবনে গিয়েছিলেন লারমা স্যার বাবাকে একজন মুরব্বী হিসাবে সম্নান দিতেন । যাক ১৯৬২ সালে পর দাদু চোখ নষ্ট হওয়ার ফলে চাকমা রাজবাড়ির সাথে দাদুর কোন যাতায়ত বা যোগাযোগ ছিলোনা। দাদুর বিষয়ে রানী বিনীতা রায় বাবার কাছ থেকে খোঁজ খবর নিতেন। সেই সময়ে পহেলা বৈশাখ বা বিঝু উপলক্ষে রাজবাড়িতে (এই পাড়ে) বেড়াতে গেলে রানী বিনীতা রায় (১৯৮০ সালের পরে রানী বিনীতা রায় রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা ছিলেন) আমাদের সামনে বসে পাচন, আটকরেয়া (চাউল ভাজা, নাড়ু,মুড়ি,খৈই), জিলাপী ইত্যাদি আপ্যায়ন করতেন এবং কৌশল বিনিময় করতেন।
রানী বিনীতা রায় পাকিস্থানে চলে যাওয়ার পর সেই ভবনে থাকতন জনি স্যার, জনি স্যার মারা যাওয়ার পর রাজবাড়ির সাথে আর তেমন যোগাযোগ আমাদের পরিবারের সাথে নেই বলা চলে।
বর্তমান চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় তো বড়ুয়া জনগোষ্ঠীর সাথে সর্ম্পক রাখতে হয়তো পছন্দ করেন না। চাকমা রাজা বা চাকমা সার্কেল চীফ এর পারিবারিক-সামাজিক অনুষ্ঠানে বড়ুয়াদের আমন্ত্রণ পর্যন্ত করা হয়না। চাকমা সার্কেল চীফ এর দপ্তরে বড়ুয়া জনগোষ্ঠীর সদস্যদের স্থানীয় সার্কেল চীফের সনদপত্র ইস্যু করা হচ্ছে বাঙ্গালীদের ফাইল থেকে।
এক সময়ে চাকমা রাজা পরিবারের দাপ্তরিক, খাজনা আদায়ের হিসাব-নিকাশ, নিরাপত্তা ও রান্নাসহ প্রায় সকল কাজে বড়ুয়া জনগোষ্ঠীর সদস্যরা নিয়োজিত ছিলেন।
বড়ুয়া জনগোষ্ঠীর সাথে চাকমা রাজা পরিবারের সর্ম্পকের মধ্যে এখন অনেক দুরত্ব তৈরৗ হয়েছে। জানি না বড়ুয়া জনগোষ্ঠীর সাথে চাকমা রাজা পরিবারের সর্ম্পকের বিশাল দুরত্ব আদৌ কমবে কি-না !
ফিরে আসি নিজ পরিবারের কথায়; আমরা ৫ ভাই ৩ বোন, ভাই বোনদের মধ্যে আমি ছিলাম ৩য়। সবার বড় ভাই, তার পর বোন, তার পর আমার জন্ম হয়। আমার বড় ১ ভাই ও ১ বোন জন্মের কয়েকমাসের মধ্যে মৃত্যুবরন করেছে বলে বাবা-মা আমাদের জানায়। আমরা ৫ ভাই ৩ বোন জন্ম গ্রহন করি। ধনুষ্টংকার রোগে না-কি ৩ ভাই ও ২ বোন মৃত্যু বরন করেছে। তার মধ্যে আমাদের সবার বড় পরিমল বড়ুয়া সৎ ভাই ছিলো, তার মায়ের নাম ছিলো কানন বালা বড়ুয়া, তিনি চন্দ্রঘোনা রেয়ন মিল এ চাকুরী করতেন, বাবার সাথে উনার না-কি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। পরিমলদাকে আড়াই বছরের সন্তান কোলে নিয়ে বাবা-মাকে বিয়ে করেন। আমার জীবনে পরিমলদার মাকে দেখেছি। পরিমালদা যেন আমাদের পরিবারে না আসেন সেই জন্য পরিমলদাকে মারমা বৈদ্য দিয়ে তাবিজ করা হয়। যার কারণে পরিমলদা অর্ধপাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন আর যাকে সামনে পেতেন তার কাছ থেকে ২টাকা চাইতেন। ১৯৮৮ সালের দিকে পরিমলদার মা কানন বালা বড়ুয়া মৃত্যুবরন করেন। তিনি মারা যাওয়ার আগে সোনালী ব্যাংক, চন্দ্রঘোনা শাখায় পরিমলদার নামে ১০,০০০/= (দশ হাজার) টাকা ফিক্স ডিপোজিট করে টাকা রেখে যান। পরিমলদা তার মা মৃত্যুবরন করার পর অর্ধপাগল অবস্থায় আমাদের বাড়িতে চলে আসেন। পরিমলদা ঠিক মতো ঘরে থাকতেন না, ঘর থেকে একবার বের হয়ে গেলে প্রায় ৭-১০দিন পর ঘরে আসতেন, না হলে খোজে খোজে তাকে ঘরে আনতে হতো। বর্তমান ভেদ ভেদী গ্রামে আমাদের যে মাটির ঘর আছে, সেই ৮০-৯০ দশকে মাটির ঘরের কদর বেশী ছিলো।
১৯৯১ সালের ঘুর্ণি ঝড়ের পরে বর্তমান মাটির ঘরটি র্নিমানে ওপরে বাঁশ আর ছনের ছাউনি দিয়ে খরচ পড়েছে ১০ হাজার টাকা। ১০ হাজার টাকার মধ্যে পরিমলদার ব্যাংক থেকে উত্তলন করা টাকা থেকে অনেকটা বাবার ওপর চাপপ্রয়োগ করে ৫ হাজার টাকা বাকি (স্ত্রী শুভ্রার মা- মায়া দেবী সরকার) আমার শাশুড়ি আমাকে দেয়া স্বর্ণের আংটি ও গলার চেইন (মাছ ব্যবসায়ী আনন্দ বড়ুয়ার নিকট) বিক্রয় করে ৫ হাজার টাকা মোট ১০ হাজার টাকা ঘরের মিস্ত্রী ভেদ ভেদী এলাকার মিজ্জির ছেলে জাকির ও তার সাথের আরেকজন মিস্ত্রীকে পরিশোধ করি। পরে সেই মাটির ঘরে কাঠ দিয়ে টিন লাগায় ছোট ভাই সুকুমার বড়ুয়া। যত্নের অভাবে পরিমলদা ১৯৯৮ সালের দিকে কাপ্তাইয়ের বড়ইছড়ি এলাকায় মৃত্যুবরন করেন। চলবে ….
লেখক : নির্মল বড়ুয়া মিলন
মূখ্য সম্পাদক
সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম
তারিখ : ১২ নবেম্বর-২০২৩ ইংরেজি।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।