সোমবার ● ১১ এপ্রিল ২০১৬
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » বৈশাখ মিশে আছে বাঙালির হৃদয়ে-অন্তরে
বৈশাখ মিশে আছে বাঙালির হৃদয়ে-অন্তরে
লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল :: পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ, চৈত্রের শেষ বৈশাখের শুরু ৷ এই শেষ চৈত্র আর পহেলা বৈশাখ নিয়ে যে উত্সব আয়োজন, তা বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি ৷ বাঙালির নতুন বছরের প্রথম দিন ৷ মোঘল সম্রাট আকবর তার শাসনামলে ফসলের খাজনা তোলার সুবিধার্থে বাংলা বছরের হিসাব শুরু করেন ৷ সেই থেকে বাংলা নববর্ষ বরণ শুরু হয় ৷ পহেলা বৈশাখ ধর্ম বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে সকল সম্প্রদায়ের এক মিলনের স্মারক ৷ সময় পরিক্রমায় নববর্ষ আজ পরিণত হয়েছে বাঙালির জীবনের সার্বজনীন সবচেয়ে বড় উত্সবে ৷ বাঙালি জাতি সারাটা বছর অধীর আগ্রহে এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে ৷ পহেলা বৈশাখ প্রকৃতির নিয়মে ঘুরে আসে ৷ দেশজ সংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করে একটা সুস্থ ও সচেতন মানস গঠনের দায়িত্ব নেয় ৷ সংস্কৃতির মধ্যে অবগাহন করেই মানুষ নিজের ব্যক্তিত্বের স্পষ্ট একটি রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করেন ৷ নিজের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা যে কোন জাতিকে বড় হওয়ার প্রাথমিক দীক্ষা দেয়৷ বাঙালির জীবনে বাংলা নববর্ষ একটি সচেতন প্রতিফলন ৷ মূলত বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকে ৷ বাংলা নববর্ষের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান ৷ সচেতন জাতির পরিচয় প্রকাশিত হয়, বিচিত্র সাংস্কৃতির রূপের মধ্য দিয়ে৷ বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির সেই পরিচয়বাহী৷ নববর্ষ মানুষকে সচেতন করে তার সাংস্কৃতিক চেতনার স্বপন্দনে ৷ জাতীয় জীবনে বর্ষ বরণের প্রথম দিনে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর অর্থ নতুনকে বরণের সাগ্রহ মনোভাব ৷ বাঙালি একটি ভাষাভিত্তিক জাতি৷ যাদের জন্ম বঙ্গে, মাতৃভাষা বাংলা, মূলত তারাই বাঙালি ৷ এই বাঙালির বড় উত্সব বাংলা নববর্ষ ৷ বিগত বছরের দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, উত্সবের স্মৃতিচারণ পরিহার করে নতুন বর্ষকে স্বাগত জানানো হয়৷ বৈশাখে উত্সবের ঢল নামে ৷ মেলা বসে গ্রামে গ্রামে৷ নানা ধরনের হাতের তৈরী দ্রব্য ও খাবারের মেলা যেন গ্রামবাংলার মানুষের প্রতিচ্ছবি ৷ তাদের জীবন যেন গ্রামবাংলার মানুষের প্রতিচ্ছবি ৷ তাদের জীবন যেন খন্ড খন্ড হয়ে ধরা পড়ে তাদের হাতের কারু কাজে ৷ মাটির পুতুল, পাটের শিখা, তালপাতার পাখা, সোলার পাখি, বাঁশের বাঁশি, ঝিনুকের ঝাড়, পুঁতিমালা, কত না অদ্ভুত সব জিনিসের সমাবেশ ঘটে সে মেলায় ৷ চোখে না দেখলে যেন বিশ্বাসই হয় না বাংলার মানুষের জীবন এত সমৃদ্ধশালী ৷ বাংলার মানুষ গরীব হতে পারে, দারিদ্র্যের নিস্পেষণে তারা জর্জরিত হতে পারে কিন্তু এসব দুঃখ কষ্ট তাদের জীবনকে আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে পারে না ৷ নববর্ষ বছরটির জন্যে আশার বাণী বহন করে নিয়ে আসে৷ তাই নববর্ষ আমাদের প্রাণে জাগায় আশার আলো ও উদ্দীপনা ৷ এ জন্য আমাদের কাছে পহেলা বৈশাখ, পারসিকদের কাছে নওরোজ এবং ইংরেজদের কাছে Happy New Year বিশেষ আনন্দময় দিবস৷ বাঙালি জীবনে যেমন ছিল পূণ্যাহ অনুষ্ঠান তেমনি হালখাতা অনুষ্ঠান ৷ জমিদারি প্রথা বাতিলের সাথে পূণ্যাহ অনুষ্ঠান বিলুপ্ত হয়েছে কিন্তু হালখাতা অনুষ্ঠান সগৌরবে বিরাজমান ৷ নানা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে উদযাপিত হয় হালখাতা উত্সব৷ বিগত বছরের ধার-দেনা শোধের পর্ব শুরু হয় এই দিনে ৷ এর মধ্যে শুধু ব্যবসায়িক লেনদেন নয় হৃদয়ের বিনিময়ও ঘটে৷ ব্যবসায়িক লেনদেনের মধ্য দিয়ে পহেলা বৈশাখে মানুষে মানুষে সৌহার্দ্যতা বাড়ে ৷ আজকাল পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে বিশেষ করে নাগরিক জীবনে ৷ শহরে শহরে মুক্তাঙ্গণে কবিতা পাঠ, আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি কর্মসূচী পালিত হয়৷ ঢাকায় রমনার বটমূলে এই অনুষ্ঠান বিশেষ ব্যাপকতা লাভ করেছে৷ শুধু নাচ-গানই নয়, বাঙালির বহুকালের অভ্যাস, পান্তা ভাত ও ইলিশ ভাজি খাওয়া ওখানে চালু আছে বহু বছর থেকে ৷ বৈশাখের তথা বাংলা নববর্ষের চেতনা বাঙালির হৃদয়ে অন্তরে মিশে আছে, কিন্তু পরিতাপের বিষয় বাংলা নববর্ষের ব্যবহারিক প্রয়োগ আমাদের জীবনে প্রায় অনুপস্থিত ৷ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বাংলা সন কিংবা বাংলা তারিখের ব্যবহার নেই বললেই চলে৷ স্কুল, অফিস, আদালত, ব্যাংক-বীমা, বিদেশ ভ্রমণের তারিখ নির্ধারণ ইত্যাদি কোন পর্যায়েই বাংলা তারিখ ব্যবহৃত হয় না৷ পৃথিবীর বুকে একমাত্র যে দেশের মানুষ তাদের ভাষা রক্ষার জন্যে আন্দোলন করে জীবন দিয়েছে, যে দেশে প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ পালিত হয় জমজমাট পরিবেশে, আনন্দঘন উত্সবে৷ সে দেশেই বাংলা সন ও বাংলা তারিখ উপেক্ষিত ! এই অবস্থায় পহেলা বৈশাখের চেতনা তথা বাঙালির সংস্কৃতি আমাদের আদালতসহ দেশের সর্বত্র চালু করা প্রয়োজন ৷ সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ও বাংলা তারিখ ব্যবহার করা অপরিহার্য৷
লেখক : লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল
শিক্ষক, কলাম লেখক, প্রাবন্ধিক ও সমাজ সেবক
ই-মেইল :[email protected]