বুধবার ● ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম » ইরাক প্রবাসী ফাহিমের ১ মাস ধরে হদিস নেই
ইরাক প্রবাসী ফাহিমের ১ মাস ধরে হদিস নেই
মিরসরাই (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি :: চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ইরাক প্রবাসী ফাহিম উদ্দিনের ১ মাস ধরে হদিস মিলছে না। ছেলের হদিস না পেয়ে কাঁদছেন ফাহিমের বাবা আবদুল মান্নান নিজামী, মা জয়নবসহ পরিবারের সদস্যরা। ফাহিম মিরসরাই উপজেলার ৫ নং ওচমানপুর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের আজমপুর গ্রামের আবদুল মান্নান নিজামী ও জয়নব দম্পত্তির একমাত্র পুত্র। জীবিকার তাগিদে ২০১৮ সালে ইরাকে পাড়ি জমান ফাহিম। দীর্ঘ ৬ বছর ধরে ইরাকে চাকুরিরত ফাহিম। সেখানে একটি প্রতারক চক্র তাকে জিম্মি করে নির্মম নির্যাতন ও মোটা অংকের চাঁদা দাবী করে আসছে পরিবারের কাছে। ফাহিমের পরিবার দাবীকৃত চাঁদা দিতে না পারায় এরপর থেকে তার কোন হদিস মিলছে না। এই ঘটনায় ফেনী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ফেনী সদর আমলী আদালতে একটি সিআর মামলা করেন ফাহিমের বাবা।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ইরাক প্রবাসী ফাহিম উদ্দিনের উপর নির্মম নির্যাতন ও চাঁদা দাবীর বিষয়ে চলতি মাসের ৫ ডিসেম্বর ফেনী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ফেনী সদর আমলী আদালতে সিআর মামলা (নং-১৪৯০) করেন ফাহিমের বাবা আবদুল মান্নান নিজামী। মামলায় ফেনী জেলার ফেনী সদর উপজেলার খাইয়ারা সুবলপুর গ্রামের মৃত নুর ইসলামের পুত্র পেয়ার আহাম্মদ, পেয়ার আহাম্মদের কন্যা ফ্লোরা আক্তার জুতি, শহিদ হোসেন প্রকাশ ছোটনের স্ত্রী ফারহানা আক্তার, শহীদ হোসেন প্রকাশ ছোটন, সোনাগাজী উপজেলার ১ নং ওয়ার্ডের মহেশচর এলাকার রফিক উল্ল্যাহর পুত্র আবু বক্কর ছিদ্দিক মিনার, মৃত নুরুল ইসলামের পুত্র রফিক উল্ল্যাহ, কালা মিয়ার পুত্র জসিম, বাদামতলী এলাকার সুমন প্রকাশ ডলার সুমনকে আসামী করা হয়েছে। আসামীদের বিরুদ্ধে মানব পাচার, জিম্মি করে চাঁদা দাবী, মানি লন্ডারিং ও আটক রেখে নির্যাতনের অভিযোগ তোলা হয়। ২০১৭ সালে আতœীয়তার সূত্রে ফাহিমের সাথে মামলার আসামীদের সম্পর্ক গড়ে উঠার পর ফাহিমের নামে জমি কেনার কথা বলে ১০ লক্ষ টাকা আতœসাত করে তারা। ২০১৮ সালে ফাহিম জীবিকার জন্য ইরাকে যান। ইরাকে পাড়ি জমানোর কয়েক বছরপর দেশে ফিরে পুনরায় ইরাক যাওয়ার প্রস্তুতিকালে আসামী জসিম কিছু পণ্য ইরাকে পাঠানোর কথা বলে চলতি বছরের ২৩ আগস্ট সোনাগাজী নিয়ে যান ফাহিমকে। সোনাগাজীতে জসিমসহ আরো ৬-৭ জন ফাহিমকে আটকে রেখে তার বাবা আবদুল মান্নান নিজামীকে মুঠোফোনে কল করে চাঁদা দাবী করেন। পরদিন ২৪ আগস্ট আবদুল মান্নান নিজামী ফাহিমের মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের বারইয়ারহাট শাখার একাউন্ট নং-১৩১২৭৭৫২২৭১১৪৪৩, চেক নং-সিএ৩০৬৮০৫৪ এবং আবদুল মান্নান নিজামীর কাছ থেকে ৪ টি ৫০ টাকামূল্যের, ৪ টি ১০০ টাকামূল্যের খালি স্ট্যাম্পে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নিয়ে নেয় আসামীরা। ওইদিন আবদুল মান্নান নিজামী জীবিকার উদ্দেশ্যে ফাহিমকে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ইরাকে পাঠিয়ে দেন। ইরাকে পৌঁছার কয়েকদিনপর শহিদ হোসেন প্রকাশ ছোটন, আবু বক্কর সিদ্দিক মিনার ও সুমন প্রকাশ ডলার সুমন ফাহিমকে একটি নির্মানাধীন ভবনে আটকে রেখে মারধর ও অমানুষিক নির্যাতন করে সেগুলো ভিড়িও কলের মাধ্যমে ফাহিমের বাবাকে দেখিয়ে ৫০ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবী করেন। ফাহিমের বাবা দাবীকৃত টাকা না দিলে নির্যাতন অব্যাহত রাখে। তখন ছেলের উপর চালানো নির্যাতন বন্ধ করতে ফাহিমের বাবা আবু বক্কর সিদ্দিক মিনারের একাউন্ট ২০৫০৭৭৭০২৮০৭৩৪৪১৬ এ ইসলামী ব্যাংক জোরারগঞ্জ এজেন্ট ব্যাংকিং থেকে দুই ধাপে ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৮ শত টাকা প্রদান করেন। ওই টাকা প্রদানের পর দাবীকৃত চাঁদার বাকি টাকা প্রদানের জন্য জোর করতে থাকেন আসামীরা। একপর্যায়ে ৩০ সেপ্টেম্বর ফাহিমের বাবাকে ১৬ লক্ষ টাকা নিয়ে আসামী রফিক উল্ল্যাহ সোনাগাজী যেতে বলেন। এসময় তিনি সোনাগাজী গেলে তার ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ২০৫০৭৭৭০২৫৩৩৩১৫১০ একাউন্টের চেক নং-এমসিআই ১৫৭২৪৪০ এ ১৬ লক্ষ টাকা স্বাক্ষর নিয়ে নেয় এবং ১ টি মিথ্যা বানোয়াট ঘটনা সাজিয়ে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। একইদিন ফাহিমের একাউন্টের ৩ ব্যাংকের ৬ টি চেক মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড এর ১৩১২৭৭৫২২৭১১৪৪৩ এর ২ টি চেক সিএ ৩০৬৮০৫৫, সিএ ৩০৬৮০৫৬, ইসলামী ব্যাংকের ২০৫০২৫২০২০২৩৫৭২১৬ এর ২ টি চেক এমসিই ৬২১৭৩৭৫, এমসিই ৬২১৭৩৭৬, উত্তরা ব্যাংক লিমিটেডের ০০১১১০০০০০৬৮৪ এর ২ টি চেক নং-৫৬৭০২৮৭, ৫৬৭০২৮৮ বø্যাঙ্ক চেক জোর করে নিয়ে নেয়। এরপরও আসামীরা ফাহিমকে না ছেড়ে দিয়ে অজ্ঞাত স্থানে আটক রেখে মানসিকভাবে হয়রানি করতে থাকে এবং ফাহিমের পরিবারকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিসহ তার পরিবারের সদস্যদের প্রাণনাশের হুমকি প্রদান করছে। এমতাবস্থায় ফাহিম ও তার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
এদিকে ফাহিমের পরিবারের বিরুদ্ধে ফেনী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে চলতি বছরের ১৩ জুলাই পেয়ার আহাম্মদের কন্যা ফ্লোরা আক্তার জুতি বাদী হয়ে ফাহিম উদ্দিন, তার বাবা আবদুল মান্নান নিজামী, মা জয়নব, দুই বোন ইয়াসমিন আক্তার ও মারজানা আক্তারকে বিবাদী করে মামলা (নং-২৪৪) দায়ের করেন। মামলাটি ফেনী জেলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করেন। তদন্ত শেষে ২৭ আগস্ট ফেনী পিবিআই’র এসআই গাজী মো. জিয়াউল ৫ পাতার প্রতিবেদনসহ ২৯ পাতা দাখিল করেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘বাদিনীর অভিযোগে বর্ণিত বিবাদীদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ৩০ ধারার অপরাধে সহিত জড়িত থাকার বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। এমনকি বাদিনী উক্ত বিবাদীরা ঘটনার সহিত জড়িত থাকার বিষয়ে আমার অনুসন্ধানে সুনির্দিষ্ট কোন সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেন নাই।’
ইরাক প্রবাসী ফাহিমের বাবা আবদুল মান্নান নিজামী বলেন, ‘গত ১ মাস যাবত আমার ছেলের কোন খোঁজ পাচ্ছি না। আমি আমার ছেলেকে চাই। আমার ছেলের উপর অমানুষিক নির্যাতন, অর্থ আত্নসাতের পাশাপাশি আমার পরিবারকে হয়রানী করতে ফেনী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পেয়ার আহাম্মদের কন্যা ফ্লোরা আক্তার জুতি বাদী হয়ে মামলা (নং-২৪৪) দায়ের করেন। এতে আমার ছেলে ফাহিম উদ্দিন, স্ত্রী জয়নব, দুই মেয়ে ইয়াসমিন আক্তার ও মারজানা আক্তারসহ আমাকে বিবাদী করা হয়। মামলায় উল্লেখিত ঘটনা পুরোপুরিভাবে মিথ্যা। মূলত মিথ্যা মামলাটি দায়ের করেন আমার ছেলে ফাহিম থেকে আত্নসাত করা টাকা ফেরত না দেওয়ার জন্য। আমি মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারসহ আমার কাছ থেকে জোরপূর্বক যেসব স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর এবং চেক নিয়েছে সেগুলো উদ্ধারে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করছি।’
অভিযুক্ত পেয়ার আহাম্মদ জানান, আমি এসব ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানি না। এসব অভিযোগ মিথ্যা।
ফেনী সদর উপজেলার ১৩ নং ফরহাদনগর ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল আমিন বলেন, ‘ঘটনার সমাধানে আমার এলাকায় এক সালিস বৈঠকের আয়োজন করি। এতে সালিসের সিদ্ধান্ত না মানায় পরবর্তীতে ফেনী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেন ফ্লোরা আক্তার জুতি। মামলাটি ফেনী পিআইবি তদন্ত করছেন।’
ফেনী জজ কোর্টের এডভোকেট শামসুন নাহার সুমি বলেন, ‘চলতি মাসের ৫ ডিসেম্বর ফেনী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও ফেনী সদর আমলী আদালতে ইরাক প্রবাসী ফাহিম উদ্দিনের বাবা আবদুল মান্নান নিজামী একটি মামলা (ফেনী সিআর মামলা নং-১৪৯০) দায়ের করেছেন। মামলায় ৮ জনকে আসামী করা হয়েছে। আসামীদের বিরুদ্ধে মানবপাচার, জিম্মি করে চাঁদা দাবী, মানি লন্ডারিং ও আটক রেখে নির্যাতনের অভিযোগ তোলা হয়।’