শনিবার ● ৪ মে ২০২৪
প্রথম পাতা » খাগড়াছড়ি » কল্পনা অপহরণ মামলা খারিজের প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে গণবিক্ষোভ
কল্পনা অপহরণ মামলা খারিজের প্রতিবাদে বিভিন্ন স্থানে গণবিক্ষোভ
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এন্টি চাকমা প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, কল্পনা অপহরণ মামলা খারিজের প্রতিবাদে খাগড়াছড়ি সদরে গণবিক্ষোভ ও বিচারের নামে প্রহসনে লিপ্ত কুচক্রীদের জুতাপেটা-কুশপুত্তলিকা দাহ কর্মসূচি পালন করেছে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত দুই নারী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ।
আজ শনিবার ৪ মে-২০২৪ সকাল ৯টার সময় খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর বাজার এলাকা থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে চেঙ্গী স্কোয়ারে অবস্থান নেয়। একই সময়ে রাঙামাটি-মহালছড়ি-মানিকছড়ি-গুইমারা-রামগড়ের দিক থেকেও শ্লোগান দিতে দিতে মিছিলকারীদের দল চেঙ্গী ব্রীজ দিয়ে সমাবেশস্থলে পৌঁছায়। অন্যদিকে দীঘিনালা-সাজেক থেকেও প্রতিবাদী নারীদের মিছিল খাগড়াছড়ি প্রধান সড়ক দিয়ে চেঙ্গীস্কোয়ারে এসে মিলিত হয়। এতে সেখানে এক বড় সমাবেশে রূপ নেয়।
মিছিলকারীরা অপরাধীদের প্রতীকী হিসেবে কুশপুত্তলিকাও বহন করে আনে। মিছিল ও সমাবেশ থেকে ‘অপরাধীদের রক্ষার রায় মানি না; অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের বিচার চাই; বিচারের নামে প্রহসনে লিপ্ত কুচক্রীরা হুঁশিয়ার সাবধান!’…ইত্যাদি মুহুর্মুহু শ্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এ সময় উৎসুক পথচারী ও আশেপাশের লোকজনও সমাবেশে এসে জড়ো হয়।
বিক্ষোভে খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৭ শ জনের অধিক ছাত্রী ও নারী অংশগ্রহণ করেন।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি কণিকা দেওয়ান। হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক রিতা চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমা।
তপ্ত রৌদ্রে আয়োজিত সমাবেশে অংশগ্রহণকারীগণ ছিলেন সংগ্রামী চেতনায় উদ্দীপ্ত। প্রকৃতির উত্তাপের চেয়েও পরিস্থিতির উত্তাপ তাদেরকে আন্দোলিত করেছে, তারা রাজপথে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হন।
সভায় পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান অন্যায় অবিচার ও দমন-পীড়নের বিভিন্ন ঘটনাবলী উত্থাপিত হলে সমবেতরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, মুহুর্মুহু শ্লোগান দেয়। কল্পনা অপহরণ মামলা নিয়ে প্রশাসনের গড়িমসিতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সমাবেশের এক পর্যায়ে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন বিচারের নামে প্রহসনে লিপ্ত কুচক্রীদের প্রতিকৃতিতে জুতা পেটা ও কুশপুত্তলিকা দাহ করে।
সভাপতির বক্তব্যে কণিকা দেওয়ান বলেন, দেশে বিচারের নামে প্রহসন চলছে মন্তব্য করে সরকার ও দালালদের সমালোচনা করে বলেন, ‘তার দায় সম্পূর্ণ আওয়ামী লীগ সরকারের। এই যে কথায় কথায় নারীর অধিকার-ক্ষমতায়ন, উন্নয়নের কিচ্ছা শুনানো হচ্ছে, অথচ অপহরণের মতো ঘটনার সুষ্ঠু বিচার করতে পারছে না। দেশ-বিদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী কল্পনা অপহরণ মামলা খারিজ করে সরকার চিহ্নিত অপহরণকারীদের রক্ষার চেষ্টা করছে। এ রায়ের মাধ্যমে সরকারের লক্ষ্য পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্যায় উসকে দেয়া, অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়া তা স্পষ্ট হয়। আওয়ামী লীগ একটানা ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘ ১৫ বছরেও কল্পনা অপহরণের তদন্তের রিপোর্ট প্রদান করতে পারেনি। জনগণের দুশমন তথাকথিত জনপ্রতিনিধি দীপঙ্কর তালুকদার সরকারের নীল নকশা বাস্তবায়নে নিরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, বিচারের নামে প্রহসনের রায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ তথা নারী সমাজ মনে নেবে না। কল্পনা চাকমার অপহরণ মামলার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌসগংদের বিচার নিশ্চত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন।
সমাবেশে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা বলেন, কল্পনা চাকমাকে নিয়ে দুর্বৃত্তরা অনেকভাবে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। বাঙালিদের মতো আমাদের পাহাড়িরাও অনেকে গুজবখেকো, বিভ্রান্ত হয়। কল্পনাকে অপহরণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে শাসকগোষ্ঠী নানা ষড়যন্ত্র করে। যারা চক্রান্তকারী এবং জনগণের দুশমন-শত্রু তারা তাদের অপরাধ ঢাকতে নানাভাবে কাল্পনিক কাহিনী বানিয়ে মিথ্যাচার করে।’
নীতি চাকমা অপপ্রচারকারীদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘কল্পনা তো সাধারণ ছিলেন না। তিনি সংগ্রামী আদর্শে বিশ্বাসী এক রাজনৈতিক কর্মী। কেন তিনি প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যাবেন? ষড়যন্ত্রকারীরা বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য এরকম গুজব রটায়। ফলে তাদের অপপ্রচারণায় আমাদের মধ্যেও দুর্বলচিত্ত কারোর কারোর দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল।
নীতি চাকমা তার নিজের স্মৃতি চারণ করে বলেন, ‘যখন কল্পনা চাকমার ডায়েরি পড়ি, রাজনৈতিক পাড়ায় তাকে নিয়ে আলাপ হয়, তার সাহসী বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ভূমিকার কথা যখন শুনি, তখনই আমি নিশ্চিত হই যারা তাঁকে নিয়ে গুজব ছড়িয়েছে, তাদের চেয়ে দুশমন নিকৃষ্ট মানুষ আর নেই। অযথা মিথ্যাচার, গালগল্প করে ধুম্রজাল সৃষ্টি করে জনগণকে ব্যস্ত রাখে, যাতে জনগণ মূল দাবি তুলতে না পারে।’
তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, ‘কল্পকাহিনী বানিয়ে মিথ্যাচার করে দুষ্কৃতকারীরা পার পাবে না। তারা যতই গালগল্প-মিথ্যাচার করুক না কেন, আমরা বিভ্রান্ত হ নি। কল্পনা অপহরণের ২৮ বছরে বিচার করতে পারোনি। এই আদালতে লে. ফেরদৌস ও তার গং সালেহ আহমেদ, নুরুল হক তারা তো অপরাধীই। তাদের অনেক মামলা হতে পারে। যেমন, দরজা ভেঙে জোরপূর্বক বাড়িতে ঢুকা, বিনা অনুমতিতে বাড়িতে প্রবেশ, অপহরণ। আরেকটি গুরুতর অপরাধ হচ্ছে নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করা। লে.ফেরদৌস ছাড়া আরো অনেক অপরাধ আছে। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনও অপরাধী। একজন ভোটারকে নিরাপত্তা দেয়া নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। সে সময়কার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হাবিবুর রহমানও এই অপরাধে অপরাধী। নির্বাচনের কয়েক ঘণ্টা আগে অপহরণ সংঘটিত করে লে. ফেরদৌস সুষ্ঠু নির্বাচনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে।’
সরকার ও প্রতিক্রিয়াশীলদের কঠোর সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন,‘শেখ হাসিনা ৯৬’এ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েও এতো বছর পরেও বিচার করেনি। মামলা খারিজ করে আরো অপরাধের মাত্রা বাড়িয়েছে। তারা গালগল্প, মিথ্যাচার, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ধামাচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। এ অপকর্মে সহযোগী হয়েছে জেএসএস। আন্দোলনের নামে জনগণের সাথে বেঈমান করে সরকারের সহযোগী লেজুড়ে পরিণত হয়েছে। একইসাথে জনগণর দুশমন দীপঙ্কর তালুকদার নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।’
নারী নেত্রী নীতি চাকমা সরকারের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘আমরা কোন দেশে বসবাস করছি, স্বাধীন দেশে বাড়িতে ঘুমাতে পারি না। ১৯৯৬ সালে ১২ জুনে নিজের বাড়িতে বিনা অনুমতিতে একজন ঘুমন্ত মানুষকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে অপহরণ করে, এখনও তার কোনো হদিস নেই। প্রশাসন এতো টালবাহানা করে যে, তাঁর ভাইয়েরা মামলা করতে গেলে সাধারণ জিডি নিতেও প্রশাসন নিতে চায়নি ‘
সমাবেশে নীতি চাকমা আরও বলেন, কল্পনাকে উদ্ধারের দাবিতে রূপন চাকমা আত্মাহুতি দিয়েছে, সমর-সুকেশ-মনোতোষ গুমের শিকার হয়েছে।
জনসংহতি সমিতির দিকে ইঙ্গিত করে নারী নেত্রী নীতি চাকমা বলেন, ‘যারা এক সময় আন্দোলন করেছিল, সেই সন্তু লারমাও ১৯৯৮ সালে অস্ত্র সমর্পণের সময় কল্পনা অপহরণকে বিতর্কিত বলে মন্তব্য করেছিলেন। যদিও পরবর্তীতে দায় এড়ানোর জন্য কিছু কর্মসূচি দিলেও এখনো পর্যন্ত মামলা খারিজের পরেও তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি।’
নীতি চাকমা দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘কল্পনা অপহরণ মামলা যে খারিজ করে দেয়া হলো, এটি এইচডব্লিউএফ মানবে না। কল্পনার সন্ধান করতে গিয়ে রূপন আত্মাহূতি দিয়েছে, সমর-সুকেশ-মনোতোষ গুমের শিকার হয়েছে। শুধু কল্পনা নয়, তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে সাহসের সাথে রূপন আত্মাহুতি দেয়, তাকে আমরা স্যালুট করি। যদি সাহসের সাথে আত্মবলিদানকারী কোনো সহযোদ্ধা নাম বলি, তাহলে প্রথম সারিতে রূপনের নাম আসবে ইতিহাসে। বীরত্বের সাথে বোনের সন্ধান করতে জীবন উৎসর্গ করে।’
প্রতিবাদ সমাবেশে নীতি চাকমা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, ‘কল্পনা অপহরণ মামলার খারিজের রায় মানি না। এটা সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত কঠোর কর্মসূচি জারি থাকবে। আওয়ামী লীগ-হাসিনা সরকার-প্রশাসন-পুরো সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের কাছে অপরাধী, জনতার কাঠগড়ায় আসামী। জনগণ এবং এইচডব্লিউএফ আদালতে তারা অপরাধী। তাদের যতই ক্ষমতা থাক না কেন, তাদের বিচার একদিন জনগণ ও এইচডব্লিউএফ আদালতে হবে। দুনিয়ার কোনো দুষ্কৃতকারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েও পার পায়নি। দুষ্কৃতকারীদের শাস্তি অনিবার্য।’
সমাবেশ থেকে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাহাড় থেকে সেনা সেটলার প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলা খারিজ করে দেয়ার মাধ্যমে চিহ্নিত অপরাধীদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে
অবিলম্বে কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গঙদের গ্রেফতার ও সাজার দাবিতে ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণস্বায়ত্তশানের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র সংগঠন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)।
আজ শনিবার (৪ মে ২০২৪) বিকাল ৫টায় ঢাকায় শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
“অপরাধীদের দায়মুক্তির প্রহসনমূলক রায় মানি না, বাতিল কর” এই দাবি সম্বলিত শ্লোগানে আয়োজিত সমাবেশে বক্তারা বলেন, দীর্ঘ ২৮ বছর কালক্ষেপন করে গত ২৩ এপ্রিল ২০২৪ রাঙামাটি জেলার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাতেমা বেগম মুক্তা তার আদালতে কল্পনা চাকমা অপহরণের মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন। এ রায়ের মাধ্যমে কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস, নুরুল হক, সালেহ আহমেদ গঙদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে। প্রহসনমূলক এ রায় আমরা মানি না। আমরা এ রায় প্রত্যাখ্যান করছি।
তারা আদালত কর্তৃক মামলা খারিজের যে আদেশ দেয়া হয়েছে অবিলম্বে তা বাতিল করে কল্পনা অপহরণ ঘটনার পুনঃ তদন্ত ও চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবি জানান।
এছাড়াও সমাবেশ থেকে বক্তারা মাইকেল চাকমাসহ গুম হওয়া সকল ব্যক্তিদের সন্ধান দাবিসহ দেশের বিচারহীনতা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
পিসিপি’র সভাপতি অঙ্কন চাকমার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরা সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সদস্য রূপসী চাকমা এবং সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. হারুনুর রশিদ, বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের সভাপতি সীমা দত্ত ও বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নুজিয়া হাসিন রাসা।