বুধবার ● ১৫ মে ২০২৪
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » আগামীতে কারা দেশ চালাবে ? …সাইফুল হক
আগামীতে কারা দেশ চালাবে ? …সাইফুল হক
থাইল্যান্ড সফর শেষে গেল ২ মে ২০২৪ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বামপন্থী ধারার রাজনীতিকদের উদ্দেশ্য করে জানতে চেয়েছেন তারা সরকার উৎখাত করে কাকে ক্ষমতায় আনতে চান।তারা কিভাবে নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গেছে!এর আগে ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় তিনি বলেছিলেন, অতি বাম, অতি ডান এক হয়ে সরকার উৎখাত করতে চায়। তিনি প্রশ্ন করেছেন তার অপরাধটা কি?
এর আগেও প্রধানমন্ত্রী এই ধরনের প্রশ্ন রেখেছেন এবং তিনি তার মত করে এসব প্রশ্নের এক ধরনের উত্তরও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন সাজাপ্রাপ্ত ও অসুস্থ, তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন দন্ডপ্রাপ্ত ও বিদেশে পালিয়ে আছে।তাদের তো কোন নেতাই নেই।তাহলে মানুষ কেন তাদেরকে ভোট দেবে? আসলে নির্বাচনে হেরে যাবে বলেই তারা নির্বাচনে আসেনা।
শুরুতেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এবারকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য একটি অবাধ,নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। তার জন্য আন্দোলনরত বিরোধী দল ও জোটসমূহ সরকারকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল, জোট ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সাথে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে।কারণ দলীয় সরকারের অধীনে যে অবাধ,নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের কোন কোন সুযোগ নেই ২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারী আর এক নজিরবিহীন ডামি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা আরও একবার সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
২০১৮ সালে দীর্ঘ এক সংলাপের প্রেক্ষিতে সরকার ও সরকারি দলকে বিশ্বাস করে বিএনপিসহ বিরোধী দলসমূহ
নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে বিরোধী দলকে নির্বাচনী নাঠে দাঁড়াতেই দেয়া হয়নি।এরপরও সেই নির্বাচনে দিনের ভোট অনেকটা আগের রাতেই সেরে ফেলার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
এবার ভোটের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশু রাজনৈতিক দাবির পাশাপাশি জবাবদিহিহীন ও চরম অগণতান্ত্রিক সমগ্র রাষ্ট্রব্যাবস্থা ও সংবিধানের গণতান্ত্রিক রুপান্তরের ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়েই বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে রাজপথে আন্দোলনের ঐক্য গড়ে উঠেছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ তাদের স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ণ রেখেই একেবারে ন্যুনতম ঈস্যু বা জনদাবিতে যুগপৎ ধারায় আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
চলনানএই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও দেশপ্রেমিক ধারার রাজনৈতিক দল ও জোট যুক্ত রয়েছে,যারা বামপন্থী, ডানপন্থী ও মধ্যপন্থী হিসাবেও পরিচিত। ।বাস্তবে পরিস্থিতি রাজনৈতিক দল ও জনগণকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ চরম কর্ত্বতৃবাদী দুঃশাসন দেশের ক্রিয়াশীল সকল রাজনৈতিক দলকে একসাথে রাজপথে নামতে বাধ্য করেছে। এই কৃতিত্ব অনেকখানি সরকার ও সরকারি দলের। এখানে অন্য কোন ম্যাজিক নেই। আর এই আন্দোলনে অতিবাম কারা আছে তা আমাদের জানা নেই। তবে সরকার ও সরকারি দলের রাজনৈতিক পরিমন্ডলের বাইরে থাকা বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল ঘরানার প্রায় সমস্ত দল স্বাধীনভাবে নিজেদের মত করে দল ও জোটগতভাবে গণতান্ত্রিক এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
আর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে কারা সরকার গঠন করবে প্রজাতন্ত্রের মালিক হিসাবে দেশের মানুষ, বিশেষ করে ভোটারেরাই তা নির্ধারণ করবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এর অন্যথা হবার কোন অবকাশ নেই।একটা অবাধ, নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সরকার বা তাদের দল যদি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন তা নিয়ে তখন কারও আপত্তি থাকবেনা।কিন্তু কেউ যদি মনে করেন তারা ছাড়া আর কেউই ক্ষমতায় আসতে পারবেনা বা দেশ চালাতে পারবেনা - এটা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।
এটা একটা অদ্ভুত বিষয় যে, যারা সরকারে থাকেন তারা এই প্রচার চালাতে পছন্দ করেন যে তারা ছাড়া আর কেউই দেশ চালাতে পারবেনা। এর মনসতাত্বিক উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের মধ্যে সরকারের শাসন সম্পর্কে এক ধরনের সম্মতি তৈরী করা।এতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দমন পীড়নসহ নানা নিবর্তনমুলক ব্যবস্থা গ্রহণের রাস্তা প্রসারিত হয়।সরকার ও সরকারি দল বিএনপিসহ তাদের রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে এখন এই কৌশল অবলম্বন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী গত ক’মাসেও বেশ কয়েকবার জানতে চেয়েছেন তার সরকারের অপরাধটা কি?এটা বলে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের গত ১৫ বছরে তার সরকারের গৃহীত উন্নয়ন তৎপরতার বিস্তারিত বর্ননাও দিয়েছেন। বিরোধীদের কাছে এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা রয়েছে। এই সংক্রান্ত দীর্ঘ ফিরিস্তির মধ্যে কেবল রাজনৈতিক তিনটি বিষয়ে উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রথমত ঃ সরকার পরিবর্তনের নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক পথ প্রকারান্তরে রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে বাস্তবে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। তৃতীয়তঃ দেশের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ দূর্বল ও ভংগুর করে দিয়ে দেশের অবশিষ্ট বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক কাঠামোকে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এসব তৎপরতার মধ্য দিয়ে দেশকে গভীর এক অনিশ্চয়তা ও ভয়ংকর বিপর্যয়ের পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারী ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল হিসাবে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর দেশকে সম্ভাব্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে এখন প্রধানমন্ত্রীর সরকার ও তার দল আওয়ামী লীগকে একটা অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে তাদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দেয়া দরকার। গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতিতে নির্বাচন ছাড়া জনগণের দিক থেকে বিকল্প বেছে নেওয়ারতো আর কোন পথ নেই। আওয়ামী লীগ একটানা সরকারে থেকে আশু ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং দেশের মানুষ যদি তার সুফল পেয়ে থেকে তাহলে একটা অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আশংকার কোন কারণ দেখিনা।
এটা সত্য যে, গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে নির্বাচনকেন্দ্রীক রাজনৈতিক সংকটের কোন সমাধান হয়নি; বরং রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।বিরোধীদেরকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করতে না পেরে সরকার গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন দমন নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে।সরকারের ‘ দমন করে শাসন’ করার এই নীতি কৌশল রাজনীতিতে বিরোধ - বিভাজন, প্রতিহিংসা - প্রতিশোধের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। এই ধারা চলতে দিলে দেশ অনিবার্য বিপর্যয়ের খাদে নিপতিত হবে।
৭ জানুয়ারীর নির্বাচনকে সাংবিধানিক দিক থেকে অবৈধ বলবার বিশেষ অবকাশ নেই সত্য , কিন্তু কথিত এই ডামি নির্বাচন সরকারকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার রাজনৈতিক ও নৈতিক বৈধতাও দেয়নি। সে কারণে এই সরকার যত প্রলম্বিত হবে দেশের বহুমাত্রিক সংকট তত বৃদ্ধি পাবে।
আমরা আশা করব কালক্ষেপণ না করে বিদ্যমান গভীর রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে সরকার ও সরকারি দল প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে অচিরেই কার্যকরি বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
সাইফুল হক
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।