রবিবার ● ২৬ মে ২০২৪
প্রথম পাতা » গুনীজন » শাহরাস্তিতে যথাযথ মর্যাদায় ড. এম.এ. সাত্তারের ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন
শাহরাস্তিতে যথাযথ মর্যাদায় ড. এম.এ. সাত্তারের ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন
চাঁদপুর প্রতিনিধি :: (জন্ম: ১ জুন ১৯৩২ মৃত্যু : ২৬ মে ১৯৯২) যথাযথ মর্যাদায় চাঁদপুরের শাহরাস্তি পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নাওড়া গ্রামের ঐতিহাসিক নাওড়া পাটোয়ারী বাড়ির বাসিন্দা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক (সিএসপি অফিসার) সচিব, সমাজ সেবক ড. এম.এ.সাত্তারের ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। ২৬ মে (রবিবার) বেলা সাড়ে এগারোটায় মরহুমের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত ‘করফুল্লেরনেছা সরকারি মহিলা কলেজে’র অডিটোরিয়ামে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে সমাধিতে পুস্পস্তবক অর্পণ, মিলাদ মাহফিল ও দোয়া এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ মোশারফ হোসেন এর সভাপতিত্বে এবং কলেজের সিনিয়র প্রভাষক কৃষ্ণ কান্ত পালের সঞ্চালনায় উক্ত অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
অনুষ্ঠানের মরহুম ডঃ এম.এ.সাত্তারের কর্মময় জীবনের উপর এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় মরহুমের কর্মময় জীবনের উপর অনেক অজানা তথ্য সমৃদ্ধ তথ্যাদি উপস্থাপন করেন আলোচকবৃন্দ। উক্ত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন, অনুষ্ঠানের সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ মোশারফ হোসেন, স্বাগত বক্তব্য রাখেন, অনুষ্ঠানের সঞ্চালক কৃষ্ণ কান্ত পাল, প্রদর্শন মোঃ সেলিম পাটোয়ারী এবং গনমাধ্যমকর্মী মোঃ রুহুল আমিন।
বর্ণিত অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন, কলেজের সিনিয়র প্রভাষক শিল্পী হাওলাদার, সিনিয়র প্রভাষক ফৌজিয়া সুলতানা, প্রদর্শক ইমাম ফয়সাল এবং প্রদর্শক অমল কুমার সূত্রধর প্রমূখ। উক্ত অনুষ্ঠানে কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীগন উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, দিনের কর্মসূচি সমূহের শুরুতে প্রথমে মরহুমের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ অর্পণ করেন, কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ মোশারফ হোসেনে নেতৃত্বে কর্মরত শিক্ষক ও প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীবৃন্দ। অতঃপর কলেজ অডিটোরিয়ামে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভার শুরুর পূর্বে প্রথমে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন, কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নুসরাত সুলতানা। এসময় মরহুমের স্মৃতির স্বরণে ১ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। তারপর মরহুমের আত্মার শান্তি ও মাগফেরাত কামনা করে মিলাদ মাহফিল ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। মিলাদ মাহফিল ও দোয়া পরিচালনা করেন, স্থানীয় নাওড়া জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন হাফেজ তোফাজ্জল হোসেন।
উল্লেখ্য, একইদিন মরহুমের প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি এডুকেশন (বেইস) ও তার ‘এমসিপি’ প্রকল্পের শাহরাস্তি উপজেলা অফিস তাদের নিজস্ব উদ্যোগে যৌথভাবে মরহুমের সমাধিতে পুস্পস্তবক অর্পণ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে ‘বেইস’ এর পক্ষে মোঃ মাসুম ইকবাল অধ্যক্ষ ডক্টর শামসুর রহমান গনবিদ্যালয় এবং এমসিপি প্রকল্পের শাখা ব্যবস্থাপক গিরিশ চন্দ্র রায় তাদের স্ব-স্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে নিয়ে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
এদিকে রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মরহুম ডঃ এম. এ. সাত্তারের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহ তাদের নিজস্ব উদ্যোগে মরহুমের ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনে কোরআন খতম, মিলাদ মাহফিল ও দোয়া এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠানের আয়োজনের খবর পাওয়া গিয়াছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃতি সন্তানদের মধ্যে একজন ছিলেন ড. এম.এ. সাত্তার। তিনি ছিলেন, বাংলাদেশ গনশিক্ষা সমিতি, বেসরকারি সংস্থা বেইস এর প্রতিষ্ঠাতা, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব(সিএসপি), বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, বাংলাদেশে নারী শিক্ষার অগ্রদূত, বর্তমানে নারী শিক্ষা বিস্তারে চলমান উপবৃত্তি প্রকল্পের প্রবক্তা, মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষার রুপকার এবং বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক।
তিনি ১৯৯২ সালের মে মাসের চতুর্থ সপ্তাহে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত পরিবার পরিকল্পনা সহ বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা আইকমের মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরস্থ আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান হিসেবে যোগদান করতে যান এবং মে মাসের ২৬ তারিখে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারনে মৃত্যুবরণ করেন । তাঁর মৃত্যুটি অনেকে রহস্যবৃত মনে করেন।
ড. এম.এ. সাত্তার ১৯৩২ সালের ১ জুন তৎকালীন বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার বর্তমান চাঁদপুর(পরে মহকুমা থেকে জেলায় উন্নীত) জেলাধীন শাহারাস্তি পৌরসভা ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নাওড়া গ্রামের ঐতিহাসিক পাটওয়ারী বাড়িতে (এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আজিজুর রহমান পাটওয়ারী (আজিজ খলিফা) ও মায়ের নাম করফুলেন্নেছা। বাবা আজিজুর রহমান পাটওয়ারী ছিলেন দিব্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ এবং মা ছিলেন একজন বিদ্যুৎসাহী মহিলা।
ড.এম.এ. সাত্তার শাহারাস্তির নিউ স্কিম হাই মাদ্রাসায় (বর্তমানে শাহারাস্তি সরকারি বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়) অধ্যয়ন করেন এবং জুনিয়র বৃত্তি লাভ করেন। তারপর তিনি চট্টগ্রামে হাই মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং ঐ মাদ্রাসা হতে ১৯৫১ সালে প্রথম স্থান অধিকার করে মেট্রিক পাস করেন।
তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে বোর্ডের মেধা তালিকায় সপ্তম স্থান অধিকার করে আইএ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৬ সালে তিনি অর্থনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি লোক প্রশাসনে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন এবং একই সাথে সিএসপি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সারা পাকিস্তানে প্রথম স্থান অধিকার করে লাহোর সিভিল সার্ভিস ট্রেনিং একাডেমিতে যোগদান করেন।
দীর্ঘ এক বছর ট্রেনিং শেষে তিনি যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোক প্রশাসনে ডিপ্লোমা ডিগ্রি লাভ করেন ।
১৯৬০ সালে সিএসপি অফিসার হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। তাঁর প্রথম কর্মস্থল ছিল বৃহত্তর সিলেট জেলার মৌলভীবাজার মহকুমা প্রশাসক হিসেবে। অতঃপর তিনি রংপুর নারায়ণগঞ্জ সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারের হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬২ সালে ব্রিটিশ নাগরিক ড. এলেন মেরি হেরিংটনের সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । বিয়ের পূর্বে তিনি বিলেতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহনকালে মেরির সাথে পরিচিত হন, পরিচয় থেকে পরবর্তীতে বেশ কয়েক বছর মেরির সাথে প্রেম করেন। অতঃপর তিনি নারায়নগঞ্জ মহাকুমা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি মেরিকে বিয়ে করেন। তাঁর বিয়ে পড়ান জ্ঞান তাপস ড. মোঃ শহীদ উল্লাহ। তার বিয়ে হয় ইসলামী রীতিনীতি মেনে কিন্তু আংটি বদল হয় খ্রিস্টান ধর্মীয় রীতিতে।
ড. সাত্তার ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়াম কলেজ থেকে ডেভলপমেন্ট ইকনমিক্সে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টাফটস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ।
১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করায় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি হন তিনি।
ড. সাত্তার ব্যক্তি জীবনে চার জন পুত্র সন্তানের জনক ।
তারা সবাই সুশিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত, বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। তার ৪ ছেলেই বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। তারা কেউ বাংলাদেশে বসবাস করেন না।
ড. সাত্তারের অবদানের ফলশ্রুতিতে চাঁদপুরের শাহারাস্তি উপজেলার শিক্ষার হার ৯৬% ভাগে উন্নীত হয়েছে । তাঁর নাম চাঁদপুরের শাহরাস্তি তথা সারা দেশবাসীর হৃদয়ে চিরদিন অমলিন হয়ে থাকবে।
আমরা জাতির এই সূর্যসন্তানকে তাঁর ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে তাঁকে স্বরণ করি।