মঙ্গলবার ● ২৮ মে ২০২৪
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » রাঙামাটিতে শিশু ধর্ষণের অপরাধে একজনকে আমৃত্যু সশ্রম কারাদন্ড
রাঙামাটিতে শিশু ধর্ষণের অপরাধে একজনকে আমৃত্যু সশ্রম কারাদন্ড
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রাঙামাটি শিশু ধর্ষণের অপরাধ প্রমানিত হওয়াতে আসামী মো. মোজাম্মেল হককে আমৃত্যু সশ্রম কারাদন্ড এবং এর অতিরিক্ত এক লক্ষ টাকা জরিমানার দন্ড প্রদান করা হয়েছে।
মঙ্গলবার ২৮ মে-২০২৪ তারিখ দুপুর ১২টায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বিচারক এ. ই. এম. ইসমাইল হোসেন, (জেলা ও দায়রা জজ) এ রায় প্রদান করেন।
নারী ও শিশু মামলা নং- ৬/২০১৯, (জি.আর মামলা নং- ৬৬/২০১৮, কোতয়ালী (রাঙামাটি সদর) থানার মামলা নং- ৭, তারিখঃ ২১-০৩-২০১৮, ধারা- নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯ (১) হতে উদ্ভূত) মামলায় আসামির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগের সংক্ষিপ্ত বিবরণে জানা যায়, এজাহারকারী ফাতেমা বেগম রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কোতয়ালী থানার রিজার্ভ বাজার পুরান বস্তি এলাকায় ভাড়া গৃহে বসবাস করেন। আসামি মোঃ মোজাম্মেল হক এজাহারকারীর পাশর্^বর্তী জনৈক আবদুল হকের ভাড়াটিয়া। এজাহারকারীর ১৩ বছর বয়সী কন্যা এই মামলার ভিকটিম। ঘটনার সময় তিনি রাঙামাটি সিনিয়র মাদ্রাসায় ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন। গত ২১-০৩-২০১৮ তারিখ সকাল অনুমান ১১টার সময় তিনি মাদ্রাসা হতে বাড়ীতে আসেন। দুপুর অনুমান ১২টার দিকে তিনি আসামির ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আসামি তাকে ডেকে ২ টি পেঁয়াজ কেটে দিতে বলে। ভিকটিম সরল মনে আসামির ঘরে প্রবেশ করলে আসামি ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। ভিকটিম চিৎকার করতে চাইলে আসামি তার মুখে কাপড় গুজে দিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে জোরপূর্বক ধর্ষন করে। ইতিমধ্যে এজাহারকারী ভিকটিমকে না দেখে আশে পাশে খুঁজতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি আসামির বসত ঘরে যান। সেখানে ভিকটিমের গোঁ গোঁ শব্দ শুনে তিনি আসামিকে দরজা খুলতে বলেন। আসামি দরজা না খোলায় তিনি তার প্রতিবেশী জহুর আলীসহ আশেপাশের লোকজন নিয়ে আসামির ঘরে যান এবং আসামিকে দরজা খুলতে বলেন। আসামি তাদের ডাকে সাড়া না দেয়ায় তারা লাথি মেরে আসামির ঘরের দরজা খুলে ফেলেন এবং দেখেন যে, আসামি ভিকটিমকে ধর্ষন করছে। সাক্ষীগণ ভিকটিমকে উদ্ধার করেন এবং আসামিকে আটক করেন। রাঙামাটি সদর থানার পুলিশ সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে আসামিকে হেফাজতে নেয়। পরে এজাহারকারী এই মামলা রুজু করেন।
রাঙামাটি সদর থানার এসআই নুরুন্নবী চৌধুরী ও এস.আই মোঃ শাহজালাল উদ্দিন মামলাটি তদন্ত করেন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯ (১) ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তদন্তকালে ডিএনএ পরীক্ষায় ঘটনার সময় ভিকটিমের পরিহিত সালোয়ার ও কামিজে আসামির বীর্য সনাক্ত হয়।
রাষ্ট্রপক্ষ মামলা প্রমাণের জন্য এজাহারকারী, ভিকটিম, চিকিৎসক, তদন্তকারী কর্মকর্তা ও স্থানীয় সাক্ষীসহ মোট ১১ জন জন সাক্ষী উপস্থাপন করে। এই সাক্ষীগণের মৌখিক সাক্ষ্য, দালিলিক সাক্ষ্য, মেডিক্যাল সাক্ষ্য, ফরেনসিক সাক্ষ্য ও পারিপার্শি¦ক সাক্ষ্য পর্যালোচনায় আদালতের সুনিচিন্তিত সিদ্ধান্ত এই যে, আসামি মোঃ মোজাম্মেল হক, গত ২১-০৩-২০১৮ তারিখ দুুপুর অনুমান ১২টার সময় ঘটনাস্থল, রাঙামাটি পার্বত্য জেলার রাঙামাটি সদর থানাধীন রিজার্ভবাজার পুরানবস্তিতে অবস্থিত আসামির বাসগৃহে এজাহারকারীর ১৩ বছর বয়সী মেয়েকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করার ঘটনা রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং, আসামি মোঃ মোজাম্মেল হক -কে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯(১) ধারার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হল। আসামী মোঃ মোজাম্মেল হক, (বয়স- ৪০ বছর), পিতা- মৃত আতাউল হক, মাতা- মর্তুজা বেগম সাং- মনেয়াবাদ, ০৮ নং ওয়ার্ড, মৃত আতাবুল হকের বাড়ী, পুরানগড় ইউপি, থানা- সাতকানিয়া, জেলা- চট্টগ্রাম, বর্তমান সাং- রিজার্ভ বাজার, পুরান বস্তি, আব্দুল হকের ভাড়াটিয়া, ওয়ার্ড নং- ০১, থানা- কোতয়ালী (রাঙামাটি সদর), জেলা- রাঙামাটি পার্বত্য জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯(১) ধারায় আসামীকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯ (১) ধারার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হলে এবং উক্ত অপরাধের দায়ে তাকে আমৃত্যু যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড এবং এর অতিরিক্ত এক লক্ষ টাকা জরিমানার দন্ড প্রদান করা হয়।
এ রায়ে আরো বলা হয়, ঘটনার সময় ভিকটিম রাঙামাটি সিনিয়র মাদ্রাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন। তিনি তার শৈশবে ৪০ বছর বয়সী আসামি মোঃ মোজাম্মেল হকের হাতে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ভিকটিমের সাক্ষ্যে উঠে এসেছে যে, ঘটনার পর সমাজের লোকজন উল্টো তাকে ও তার মাকে ঘটনার জন্য দায়ী করে এবং তাদেরকে এলাকা ছাড়তে বলে। তখন এজাহারকারী বাধ্য হয়ে ঘটনার কয়েক মাসের মধ্যেই ভিকটিমকে দূরবর্তী স্থানে বিবাহ দেন। সেখানে ভিকটিমের একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে। পরবর্তীতে ভিকটিমের স্বামী ঘটনা জেনে ভিকটিমকে তালাক দিয়ে দেন। প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এই ঘটনার ফলে ভিকটিম বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছেন। তার শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়েছে। তার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে। তার জীবন ওলটপালট হয়ে গেছে। এমতাবস্থায়, ভিকটিমের মতো অন্যান্য শিশুদেরকে ভবিষ্যতে আসামির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তাকে আমৃত্যু কারাগারে অন্তরীন করে রাখা প্রয়োজন মর্মে সাব্যস্ত হয়।
রাষ্ট্র পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবী ছিলেন এ্যাডভোকেট মোঃ সাইফুল ইসলাম অভি, বিজ্ঞ বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর।
আসামি পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবী ছিলেন এ্যাডভোকেট মোখতার আহম্মদ। আসামি পক্ষে আইনজীবী এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল কবরেন বলে জানান।