শিরোনাম:
●   বৈরী আবহাওয়ায় ও শীতের তীব্রতায় বাড়ছে কৃষকের দুশ্চিন্তা ●   কোন হটকারিতায় গণঅভ্যুত্থানের অর্জন নষ্ট করা যাবেনা ●   তরফভাইখাঁ সমাজকল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ ●   মিরসরাইয়ে শীতার্তের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ ●   ঈশ্বরগঞ্জে জিয়াউর রহমান স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধন ●   লংগদু এস এস সি পরীক্ষার্থীদের শিক্ষা সামগ্রী বিতরন ●   ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৫ এর মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন সম্ভব ●   হালদা থেকে বিপন্ন গাঙ্গেয় প্রজাতির মৃত ডলফিন উদ্ধার ●   খাগড়াছড়ির আলুটিলায় পর্যটকবাহী বাস উল্টে আহত-২০ ●   পানছড়িতে লোগাং জোন এর অনুদান সামগ্রী প্রদান ●   আত্রাইয়ে কুলি-বেদে সম্প্রদায়ের মাঝে জেলা প্রশাসকের কম্বল বিতরণ ●   চুয়েটে স্থাপত্য বিভাগের ১ম জাতীয় কনফারেন্স শুরু ●   বিজিবির অভিযানে খাগড়াছড়িতে ১২ অনুপ্রবেশকারী আটক ●   ঈশ্বরগঞ্জে জাতীয় প্রবাসী দিবস পালিত ●   কুষ্টিয়ায় বালুঘাট দখল নিতে তাণ্ডব চালিয়েছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ●   রাউজানে বিকাশ প্রতারকের ফাঁদে নারী উদ্যোক্তা তানিয়া ●   যোবায়ের-সাদপন্থীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্র ইজতেমা মাঠ : নিহত ৩ ●   মিরসরাইয়ে মধ্য তালবাড়ীয়া স্পোর্টিং ক্লাবের কমিটি গঠন ●   জিয়া কিংবা শেখ মুজিব নয়; জনগণই মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়ক : টিপু ●   নবীগঞ্জে ট্রাকের ধাক্কায় কলেজ ছাত্রের প্রাণহানি ●   জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এর নেতৃত্বে থাকবেন ড. ইউনূস ও আলী রীয়াজ ●   রেডব্রিজ কমিউনিটি ট্রাস্ট ইউকে বিজয় দিবস উদযাপন ●   ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাবের নির্বাচন : সভাপতি আউয়াল, সম্পাদক আতাউর ●   কাউখালীতে মহান বিজয় দিবস উদযাপন ●   দীপংকর তালুকদার এর অবৈধ সম্পদের তদন্তে নেমেছে দুদক ●   ঈশ্বরগঞ্জে বিজয় দিবস পালিত ●   সিলেটে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত -১ ●   ঘোড়াঘাটে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস পালিত ●   সত্যিকার দেশপ্রেম হচ্ছে দেশকে গড়ে তোলার এক নিরন্তর সাধনা : চুয়েট ভিসি ●   রাঙামাটিতে যথাযথ মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস উদযাপিত
রাঙামাটি, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১



CHT Media24.com অবসান হোক বৈষম্যের
শুক্রবার ● ১২ জুলাই ২০২৪
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » বর্তমান প্রেক্ষাপটে ১৯০০ সালের রেগুলেশান, (সংশোধিত) ১৯২০ আইনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরিপন্থি নয় কি ?
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » বর্তমান প্রেক্ষাপটে ১৯০০ সালের রেগুলেশান, (সংশোধিত) ১৯২০ আইনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরিপন্থি নয় কি ?
শুক্রবার ● ১২ জুলাই ২০২৪
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

বর্তমান প্রেক্ষাপটে ১৯০০ সালের রেগুলেশান, (সংশোধিত) ১৯২০ আইনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরিপন্থি নয় কি ?

ছবি : সংবাদ সংক্রান্ত নির্মল বড়ুয়া মিলন :: বাংলাদেশ-এর চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলা রাঙামাটি এর ভৌগোলিক অবস্থান : ২২°২৭’- ২৩°৪৪’ উত্তর অক্ষাংশ ৯১°৫৬’-৯২°৩৩’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগীয় সদর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। এ জেলার দক্ষিণে বান্দরবান জেলা, পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলা ও খাগড়াছড়ি জেলা, উত্তরে ভারত-এর ত্রিপুরা প্রদেশ এবং পূর্বে ভারতের মিজোরাম প্রদেশ ও মিয়ানমার চীন প্রদেশ অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের একমাত্র জেলা, যার সাথে দেশেরই আন্তর্জাতিক সীমা রয়েছে- এই দেশ দুটি হলো- ভারত ও মিয়ানমার।
আয়তন: ৬১১৬.১৩ বর্গকিলোমিটার। আয়তনের বিচারে এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ জেলা।
নদনদী ও খাল বিল : রাঙামাটি জেলার প্রধান নদী কর্ণফুলী। নদীটি ভারতের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে রাঙামাটি উত্তর-পূর্ব সীমান্ত দিয়ে ঠেগা নদীর মোহনা হয়ে এ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। এছাড়া এই নদীর উপর বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সময় বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে সৃষ্টি কাপ্তাই হ্রদ। জনসংখ্যা ও জাতি সত্তা : ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাঙামাটি জেলার মোট জনসংখ্যা ৬,২০,২১৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩,২৫,৮২৩ জন এবং মহিলা ২,৯৪,৩৯১ জন। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১০১ জন। মোট জনসংখ্যার ৩৬.৮২% মুসলিম, ৫.৩০% হিন্দু, ৫৬.০৬% বৌদ্ধ এবং ১.৮২% খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। এ জেলায় চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, চাক, মুরং, ত্রিপুরা, খেয়াং, খুমি, লুসাই, ম্রো, পাংখোয়া, সাঁওতাল, মণিপুরী প্রভৃতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। ভাষাও সংস্কৃতির বিচারে এক জাতিসত্ত্বা অন্য জাতিসত্ত্বা থেকে স্বতন্ত্র হলেও - নৃতাত্ত্বিক বিচারে তাদের সকলেই মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠিভুক্ত। সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে ‘চাকমা’ হচ্ছে প্রধান জাতিসত্ত্বা। তাদের পরেই মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থান। অন্যান্য সাতটি জাতিসত্ত্বার সংখ্যা অতি নগন্য। তারা রাঙামাটি পার্বত্য জেলার মোট জনসংখ্যার ১.২৭% মাত্র।
এতদঞ্চলে বসবাসরত প্রত্যেক জাতিসত্ত্বার রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। এদের মধ্যে চাকমাদের রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা আছে। তবে এরা চাকমার ভাষা লেখার জন্য বাংলা বর্ণই বেশিন ব্যবহার করে। মারমারা বর্মী বর্ণমালায় লেখার কাজ চালায়। চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা সমগোত্রের এবং ভাষা রীতিতে বেশ মিল রয়েছে। দু’টো ভাষাও ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষগোষ্ঠীর ভাষা। পক্ষান্তরে মারমারাদের ভাষা বর্মী ভাষার কাছাকছি। মারমা এবং ম্রোদের ভাষা সিনো তিব্বতীয় পাশা পরিবারের। ত্রিপুরা জাতির ভাষাকে ‘ককবরক’ বলা হয়। এ ভাষাও সিনো তিব্বতীয় পাশা পরিবারের। অন্যদিকে খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া, বম ও খুমীদের ভাষা কুকী-চীন ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
এ জেলায় বাঙালিদের অধিকাংশই মুসলমান। এছাড়া বাঙালি কিছু হিন্দু ও বড়ুয়া বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আছে। ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর অধিকাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং কিছু সংখ্যক হিন্দু এবং খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী আছে।
অর্থকরী ফসল : তিল, ভুট্টা, চিনা বাদাম, সরিষা, মসূর, আলু, মিষ্টি আলু, বারমাসি শিম, ঢেরস, বেগুন, পাহাড়ী মরিচ ইত্যাদি। মসল্লা জাতীয় ফসলের মধ্যে যেমন- আদা, হলুদ, পেঁয়াজ, রসুন, তেজপাতা, ধনিয়া, মরিচ, বিলাতি ধনিয়া পাতা ইত্যাদি।
ফলজ : আনারস,কাঠাল, আম, লিচু,তরমুজ,কমলা, লেবু, মাল্টা, কলা ইত্যাদি।
প্রাকৃতিক সম্পদ: বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, বাঁশ, বেত, পাথর বালি ইত্যাদি।
প্রাণিজ সম্পদ: গরু, ছাগল, হরিণ, ভাল্লুক, বানর, শুকর, গয়াল, হাতি, ইত্যাদি।
প্রশাসন : এই জেলার উপজেলার সংখ্যা ১০টি। এগুলো হলো- সদর, কাপ্তাই, কাউখালি, নানিয়ার চর, রাজস্থলী, বরকল, লংগদু, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও বাঘাইছড়ি । এই জেলায় রয়েছে মোট ১২টি থানা। এগুলো হলো- কাপ্তাই, কাউখালি, চন্দ্রঘোনা, জুরাছড়ি, নানিয়ার চর, বরকল, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, রাঙামাটি কোতোয়ালি, রাজস্থলী, লংগদু ও সাজেক। রাঙামাটির ইতিহাস
ভৌগোলিক ভাবে হিমালয় অঞ্চলের দক্ষিণে দিকের শাখা প্রশাখায় বিস্তৃত পাহাড়ী এলাকা নিয়ে যে বিশাল অংশ গড়ে উঠেছে, এই জেলা তারই অংশ।
যতদূর জানা যায় এ (পার্বত্য চট্টগ্রাম) অঞ্চলের রাজা যুজা রূপা (বিরা রাজা) ৫৯০ খ্রিষ্টাব্দের পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজাকে পরাজিত করে রাঙামাটিতে রাজধানী স্থাপন করেন। আবার ঐতিহ্যগত মতানুসারে, পার্বত্য ত্রিপুরার রাজা উদয়গিরি, কিলয় ও মংলয় নামের দু’ভাইকে রিয়াং এলাকার শাসক নিয়োগ করেন। তারা মাতামুহুরী নদীর দক্ষিণে পাহাড়ী অঞ্চলে শাসন করতেন। ৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান রাজা সুলা তাইং সান্দ্র (Tsula Taing Tsandra ৯৫১-৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম দখল করেন। পরবর্তীতে ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিপুরার রাজা পুনরায় এ অঞ্চল দখল করেন।
এই সময় বঙ্গদেশে মুসলিম শাসন চলছিল। সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ (১৩৩৮-৪৯ খ্রিষ্টাব্দে) চট্টগ্রাম (সম্ভবত পার্বত্য চট্টগ্রামের অংশসহ) জয় করেন। ১৪০৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মিয়ানমারের লেম্ব্রো সাম্রাজ্যের লাউঙ্গগায়েত রাজবংশের যুবরাজ, মিন সো মোন মাত্র ২৪ বছর বয়সে পিতার সিংহাসনে আরোহণ করেন। লেম্ব্রো নদীর তীরে লাঙ্গিয়েত তাঁর রাজধানী ছিল। এই সময় মিন সো মোন-এর রাজ্যের পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী আভা এবং পেগু রাজ্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করছিল। এদের দ্বারা প্রভাবিত রাজ্যের আমত্যবর্গ রাজ্যের অবস্থা অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। এই অবস্থার ভিতরে আভা রাজ্যের রাজা ‘মিনখায়ুং প্রথম’ ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে মিন সো মোন-এর রাজ্যের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সেনাবাহিনী পাঠান। ২৯শে নভেম্বর এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে, মিন সো মোন বঙ্গদেশে পালিয়ে যান। তাঁর অপর ভাই মিন খায়ই পালিয়ে যান পেগু রাজ্যে।
মিন সো মোন বঙ্গদেশের সুলতান জালালউদ্দীন মুহম্মদ শাহের কাছে আশ্রয় পান এবং বঙ্গের সুলতানের সহায়তায় রাজ্য উদ্ধারের উদ্যোগ নেন। ইতিমধ্যে ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা রাজা মউন স্নী বৌদ্ধ মতাদর্শের প্রতি অশ্রদ্ধাজ্ঞাপনের অভিযোগে বার্মার থেকে বিতাড়িত হন। তিনি তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের আলীকদম নামক স্থানে মুসলিম অফিসারের অধীনে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং রামু ও টেকনাফে চাকমাদের বসতি স্থাপনে সহায়তা করেন। এই সময় রাঙামাটি ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে চাকমা এবং বাঙালিদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ইতিমধ্যে বঙ্গের সুলতানের সহায়তায় মিন সো মোন রাজ্য উদ্ধারের উদ্যোগ নেন। ১৪২৯ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারির/মার্চ মাসের দিকে রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি যাত্রা করেন। এই যুদ্ধে জয় লাভ করে তিনি রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। এরপর সুলতানের সেনাপ্রধান ওয়ালি খানের সাথে তাঁর বাক বিতণ্ডায় জড়িয়ে পরেন। এই সূত্রে ওয়ালি খান তাঁকে গ্রেফতার করেন। এই ঘটনাটি ঘটেছিল মিন সো মোন-এর পালিয়ে থাকা ভাই মিন খায়ই-এর এলাকার কাছে। এই ভাইয়ের সহায়তায় মিন সো মোন কৌশলে পালিয়ে সুলতানের কাছে ফিরে যান। এরপর সুলতান দ্বিতীয় বার রাজ্য উদ্ধারের জন্য সৈন্য দেন। ১৪২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল সিংহাসন উদ্ধারে সক্ষম হন। এরপর তিনি ধীরে শক্তি বৃদ্ধি করেন। তিনি রাজ্য পরিচালনার সুবিধার্থে ল্যাঙ্গিয়েৎ থেকে রাজধানী সরিয়ে আনেন এবং নতুন নগরী মারায়ুক-উ-কে রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেন। এই সময় রাঙামটি আরকানের অধীনে চলে যায়।
১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দে হোসেন শাহ বাংলার সুলতান হোন। তিনি চট্টগ্রামের অধিকার নিতে গেলে-ত্রিপুরার রাজা ধনমানিক্যের সাথে সংঘাত সৃষ্টি হয়। ১৫১৩-১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত উভয় রাজার ভিতর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রাজা ধনমানিক্যের মৃত্যুর পর হোসেন শাহ চট্টগ্রাম তাঁর দখলে আনেন এবং উত্তর আরাকান পর্যন্ত তাঁর রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হন।
১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পোর্তুগিজরা চট্টগ্রামে আসা শুরু করে। এরা প্রথমাস্থায় বাণিজ্য করতে এলেও, পরে তারা জলদস্যু হয়ে যায়।
আরাকানী মগ রাজা থাজাতা ১৫১৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজ্যের কিছু অংশ পুনরায় জয় করেন। একই বছরে চাকমা চীফ চনু থাজাতা’র নিকট বশ্যতা স্বীকার করেন এবং ঐ এলাকায় আরাকানী গভর্ণর হিসেবে নিযুক্ত ধ্যারাং গিরির মাধ্যমে রাজার নিকট ২টি চুন রং করা শ্বেতহস্তী উপঢৌকন হিসাবে প্রেরণ করেন। আরাকানী রাজা সন্তুষ্ট হয়ে চাকমা রাজাকে ‘কুফরু’ উপাধি প্রদান করেন এবং চাকমা রাজার কন্যাকে ১৫২০ খ্রিষ্টাব্দে বিয়ে করেন। ১৫২২ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিপুরার দেবমানিক্য আরাকানীদের হাত থেকে রাজ্যের কিছু অংশ অধিগ্রহণ করেন। ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুলতান নসরৎ শাহ আততায়ীর হাতে নিহত হন। এরপর সিংহাসনে বসেন তাঁর ১৬ বছর বয়সী পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ। ফিরোজ শাসনকার্যে অনুপযুক্ত ছিলেন। তাঁর কুশাসনের বিরুদ্ধে আমিররা বিদ্রোহ করেন। বাংলার এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মিন বিন, ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই অক্টোবর চট্টগ্রাম দখল করে নেন। এরপর ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখে, তাঁর সৈন্যরা ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে। এই সময় সুলতানের সৈন্যরা আরাকানিদের বিরুদ্ধে যথাসাধ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং প্রায় ১০দিন আরাকানিদের ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুলতানের সৈন্যরা পরাজিত হয় এবং ১১ই ডিসেম্বর এরা আরাকানি সৈন্যরা ঢাকা প্রবেশ করে। এরা ঢাকা এবং এর আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক লুটতরাজ ও হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকে। ফলে ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি তরুণ সুলতান আলাউদ্দিন ফিরোজের পক্ষে রানিমাতা, রাজা মিন বিন-কে কর প্রদান করতে বাধ্য হয়। এরপর ১৩ই এপ্রিল মিন বিন- ঢাকা ত্যাগ করে। ১৪ই মে তিনি অধিকৃত অঞ্চলের জন্য একজন গভর্নর নিয়োগ করেন। ফলে চট্টগ্রাম আরাকানিদের অধিকারেই থেকে যায়। এরপর তিনি ত্রিপুরা অভিযানে উদ্যোগ নেন। ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সফলভাবে ত্রিপুরা আক্রমণ শেষ করেন এবং ১৫৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে ফেব্রুয়ারি তিনি ম্রায়ুক উ-এ ফিরে আসেন। এর ভিতর দিয়ে চট্টগ্রাম আরকানীদের হাতেই থেকে যায়। ১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজ বাহিনী তাঁর রাজ্য আক্রমণ করে। এই আক্রমণে কোণঠাসা হয়ে পড়লেও শেষ পর্যন্ত, মিন বিন পর্তুগিজ আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন। এরপর তিনি সাফল্যের সাথে নিম্ন বার্মা থেকে আগত তৌঙ্গুবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করেন। ১৫৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর রাজত্ব লাভ করেন, তাঁর পুত্র দীক্ষা। ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে পোর্তুগিজরা চট্টগ্রামে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে। এই সময় তারা বন্দর এলাকার শুল্ক আদায়ের অধিকার লাভ করে। ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ-র সেনাপতি পোর্তুগিজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে চট্টগ্রাম দখল করেন। কিন্তু শের শাহ-এর এই সেনপাতি চট্টগ্রামের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব লাভ করতে পারেন নি। ত্রিপুরার রাজা বিজয় মাণিক্য (১৫৪০-৭১) চট্টগ্রাম অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হন। আবার অন্য দিকে সিকান্দার শাহ্ ত্রিপুরা আক্রমণ করেন এবং রাজধানী লুণ্ঠন করেন।
১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এই অঞ্চল আরাকানী রাজা দখল করে নেন এবং ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে আরাকান রাজা চট্টগ্রাম অঞ্চলের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল সম্পূর্ণভাবে আরাকান রাজাদের অধীনে থেকে যায়।
এই সময় পোর্তুগিজরা আবার দস্যুতা শুরু করে। এদের দৌরাত্ম অত্যন্ত বৃদ্ধি পেলে, আরাকান রাজা ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে পোর্তুগিজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। এই অভিযানের ফলে পোর্তুগিজদের সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করা সম্ভব হয় নি। বিশেষ করে সন্দীপ অঞ্চল পোর্তুগিজ জলদস্যু গঞ্জালেস দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খানকে চট্টগ্রাম দখলের নির্দেশ দেন। সুবেদারের পুত্র উমেদ খাঁর প্রথমে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় আরাকানীদের পরাজিত করেন এবং আরাকানী দূর্গ দখল করেন। কথিত আছে পোর্তুগিজরা আরাকানীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে মোঘলদের পক্ষ নিয়েছিল। উমেদ খাঁ চট্টগ্রামের প্রথম ফৌজদারের দায়িত্ব পান।
প্রথম ফৌজদারের দায়িত্ব পান। এই সময় আরাকানীরা চট্টগ্রাম অধিকারের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। এই সময় টমাস প্রাট নামে এক ইংরেজ আরাকানীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মোঘলদের পরাজিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। জব চার্নক ১৬৮৬ খ্রিষ্টাব্দে এবং ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দে কাপ্তেন হিথের চট্টগ্রাম দখল করতে ব্যর্থ হয়। ১৬৭০ ও ১৭১০ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানীরা চট্টগ্রাম দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৭২৫ আরাকানরা বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে চট্টগ্রাম দখল করতে সক্ষম হয়, কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই মোগলরা আরাকানদের বিতারিত করে।
ইতিমধ্যে ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চাকমা রাজ্য বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে চাকমা রাজা ফতে খাঁর সময়ই- অনেক ক্ষেত্রে এরা মোগলদের এরা প্রায় গ্রাহ্যই করতো না। এই সূত্রে উভয় শক্তির ভিতরে এক ধরনের টানপোড়নের সৃষ্টি হয়।
একসময় মোগলরা চট্টগ্রামের সাথে বাণিজ্যের বিষয়ে চাকমাদের কাছে কর দাবী করে। এ নিয়ে চাকমা এবং মোগলদের ভিতর তীব্র তিক্ততার জন্ম দেয়। মোগল সৈন্যরা চাকমা রাজ শক্তিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, আক্রমণ করলে, ফতে খাঁর কৌশলে মোগলরা পরাজিত হয়। এই সময় চাকমা রাজার সৈন্যরা দুটি কামান দখল করে, এদের নাম রাখে ফতে খাঁ এবং কালু খাঁ।
রাজা ফতে খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর তিনপুত্রের ভিতর (সেরমস্ত খাঁ, ওরমস্ত খাঁ, খেরমস্ত খাঁ) সেরমস্ত খাঁ রাজত্ব লাভ করেন। এই সময় তিনি সমস্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে তাঁর অধিকার পাকা করেন। ইনি নিঃসন্তান থাকায়, তাঁর ভাই ওরমস্ত খাঁ-এর ছেলে শুকদেব রায়কে পোষ্য পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন। শুকদেব মোগলদের সাথে সখ্যতা স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ
করেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, প্রবল মোগল শক্তির বিরুদ্ধাচরণ করে দীর্ঘকাল রাজত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবেন না। ফলে ১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা-মোগলদের ভিতরে শান্তিচুক্তি হয়। এই চুক্তিতে চাকমা রাজা আংশিকভাবে মোগল-করদ রাজ্যে পরিণত হয়। চাকমা রাজা মোগলদেরকে বাৎসরিক ১১ মণ কার্পাস তুলা কর হিসেবে প্রদান করতো। এই কারণে মোগলরা চাকমা রাজাকে পুরস্কৃত করে এবং রায় উপাধি প্রদান করে। এরপর শুকদেব নিজের নামে একটি নগর স্থাপন করেন। এই নগরীর নাম রাখা হয় সুকবিলাশ বা সুখবিলাস। চাকমা রাজা পরে কার্পাস কর দিতে অস্বীকার করে। কিন্তু মোগলদের ভয়ে তিনি ১৭২৪ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানে চলে যান। তাঁর প্রশাসন মোগলদেরকে ১৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ১১ মণ কার্পাস কর দেন। ১৭৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শেরমুস্ত খাঁ কার্পাস করদেয়ার শর্তে কোদালা, শীলক, রাঙ্গুনিয়া অঞ্চলে জমিদারী লাভ করেন। রাণী কালিন্দির মতে, রাজা শেরমুস্ত খাঁর পর শুকদেব রায়, তারপর শের দৌলত খাঁ, পরেজানবক্স খাঁ, আর্য্যপুত্র ধরমবক্স খাঁ এবং পরে কালিন্দি রাণী নিজে ছিলেন চাকমা রাজার দায়িত্বে। ১৭৫৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজা শেরমুস্ত খাঁ মৃত্যু বরণ করেন। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে অর্ধ স্বাধীন নবাব মীরকাশীম আলী খান কর্তৃক ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিকট সমর্পিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম মোগলদের দখলে নিরাপদে ছিল।
১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের পর, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র পৃষ্ঠপোষকতায় মীরজাফর মুর্শিদাবাদের নবাব হন। এরপর ইংরেজরা মীরজাফরক সরিয়ে মীরকাসেমকে সিংহাসনে বাসায়। মীরকাসেমের সাথে ইংরেজদের সংঘাত উপস্থিত হলে, ইংরেজরা মীরজাফরকে পুনরায় সিংহাসনে বসায়। বাংলার সিংহাসনের এই টানপোড়নের মধ্যে, ১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারিতে Harry Verlest ইষ্ট ইন্ডিয়ার পক্ষে চট্টগ্রামের শাসন দায়িত্ব পান। ইংরেজরা এরপর ক্রমাগত চট্টগ্রামে অতিরিক্ত রাজকর ধার্য করে, যা চাকমা রাজা দিতে অস্বীকার করে। ফলে ইংরেজরা চাকমা রাজার বিরুদ্ধে মোট চারবার (১৭৭০, ১৭৮০, ১৭৮২ ও ১৭৮৫) আক্রমণ করে। ইংরেজরা প্রথম তিনটি আক্রমণ করেছিল জলপথে। প্রথম তিনটি যুদ্ধে কোম্পানির সৈন্যরা পরাজিত হয়। ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজা শের দৌলত খাঁ ইংরেজদের কর প্রদান বন্ধ করে দেন। ইতিমধ্যে সের দৌলৎ খাঁ মৃত্যুবরণ করলে, ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পুত্র জানবক্স খাঁ রাজা হন। ১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে স্থলপথে চতুর্থবার চাকমা রাজ্য আক্রমণ করে। মেজর এলারকারকে (Ellerkar) নেতৃত্বে এই যুদ্ধে ইংরেজরা জয়ী হয়। ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা রাজার জানবক্সের সাথে ইংরেজদের শান্তি চুক্তি হয়। এই চুক্তি অনুসারে চাকমা রাজা বৎসরে ৫০০ মন তুলা ইরেজদের কর হিসাবে প্রদান করবে বলে অঙ্গীকার করে। জানবক্স খাঁ ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীকালে আর কোন রাজা ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরণ করেনি।
চাকমা রাজার সাথে ইংরেজেদের সংঘাতের সময়, রোনা খান নামক জনৈক দলপতি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জমিদার কাছ থেকে কর আদায় শুরু করেন। এদের দমন করার জন্য রোনা খান-এর বিরুদ্ধে কোম্পানি একদল সৈন্য প্রেরণ করে। রোনা খান যোদ্ধা হিসেবে কুকীদের একটা বড় দলকে সঙ্গে নেন। মূলত কুকীরা ছিল পাহাড়ী অঞ্চলের দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তারা পাহাড়ের অভ্যন্তরে দূরে বসবাস করতো এবং কোন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতো না। তারা উলঙ্গ থাকতো। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এই বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে, সকল পাহাড়ী লোকদেরকেও চট্টগ্রামের প্রতিবেশী জেলার হাটবাজারে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দ নভেম্বর মাসে চট্টগ্রামস্থ কোম্পানী প্রধান ২২তম ব্যাটালিয়ানের কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) এলাকার (Ellerker) কে পাঠান। সত্যিকার অর্থে কুকীদেরকে ইংরেজরা জয় করতে পারে নি। তবে ধীরে ধীরে এই বিদ্রোহ থেমে গিয়েছিল এক সময়।
১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জুন তারিখে আরাকানী রাজা কর্তৃক চট্টগ্রামের চীফের প্রতি লেখা একটি চিঠি হতে কিছু চমকপ্রদ ঐতিহাসিক তথ্য জানা যায়। আরাকান হতে পালিয়ে আসা কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নাম রাজা উল্লেখ করেছিলেন। এই ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর লোকেরা চট্টগ্রামের পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল। এরা সকল রাজাদের দ্বারাই নিগৃহীত হয়েছিল। এই চিঠিতে এরূপ চারটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নাম পাওয়া যায়। এরা হলো- মগ, চাকমা, ম্যারিং বা মুরং এবং লাইস (পাংখু এবং বনযোগী)।
১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে মিঃ হ্যালহেড (Mr. Halhad) কমিশনার স্বীকৃতি দেন যে, পাহাড়ী উপজাতিরা বৃটিশ প্রজা নয়, তবে কেবল করদাতা। তিনি স্বীকার করেন যে, তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থায় বৃটিশদের হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। তাই একটি শক্তিশালী ও স্থায়ী সরকারের নিকট প্রতিবেশের সুবাদে উপজাতীয় চীফগণ ধাপে ধাপে বৃটিশ প্রভাবের অধীনে আসে এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে প্রত্যেক নেতৃস্থানীয় চীফগণ চট্টগ্রাম কালেক্টরকে সুনির্দিষ্ট কর দিতে অথবা পাহাড়ী অধিবাসী ও সমতলের মানুষের মধ্যে মুক্ত ব্যবসার (Free Trade) সুযোগ নেয়ার জন্য বার্ষিক উপহার দিত। প্রথম দিকে এর পরিমাণ হ্রাস বৃদ্ধি হয়। পরে ধীরে ধীরে তা বিশেষ ও নির্দিষ্ট হারে ধার্য হয়। অবশেষে তা কর হিসেবে না হয়ে রাজস্ব হিসেবেই রাষ্ট্রকে প্রদানের জন্য নির্ধারিত হয়। সরকার তারপরও পার্বত্য অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ করতো না। উল্লেখ্য, চাকমা রাজাগণের মধ্যে খাঁ উপাধির শেষ রাজা ছিলে ধরমবক্স খাঁ। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ধরমবক্স খাঁর মৃত্যু হলে রাণী কালিন্দিরাজকার্য পরিচালনার দায়িত্ব হাতে নেন। দেখুন : চাকমা [জাতি]
ইংরেজরা কুকীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কাপ্তাই খালের একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিল। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে কুকীরা পার্বত্য এলাকায় হানা দিয়ে ব্যাপক লুটতরাজ করে। এই কারণে ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে বিভাগীয় কমিশনার পাহাড়ী কুকীদের প্রতিরোধ করার জন্য একজন সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত করে, চট্টগ্রাম হতে পৃথক করে পার্বত্য অঞ্চলকে একটি রেগুলেশান জেলা করার সুপারিশ করেন। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে কুকীরা তিপ্পেরা (Tipperah) অঞ্চলে ইংরেজদের উপর আক্রমণ করে। এই আক্রমণে তিপ্পেরা অঞ্চলে ১৮৬ জন ইংরেজ নিহত হয় এবং ১০০জনকে তারা বন্দী করে।
১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে জুন প্রশাসনিক সুবিধার জন্য রাঙ্গামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের ACT XXII দ্বারা ঐ বছরের ১লা আগষ্ট তারিখে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। এই সময় একজন অফিসারকে পার্বত্য ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীদের জন্য
সুপারিনটেনডেন্ট পদে নিযুক্ত করা হয়। এভাবেই রেগুলেশান জেলার সিভিল, ক্রিমিনাল এবং রাজস্ব আদালত ও কর্মকর্তাদের অধিক্ষেত্র হতে পাহাড়ী ও বনাঞ্চলকে আলাদা করা হয়। একজন হিল সুপারন্টেন্ট নিয়োগের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল আক্রমণকারী ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীদের প্রতিরোধ করা এবং সাধারণ ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর লোকদের রক্ষা করা। তার অধীনস্থ পাহাড়ী এলাকাকে তখন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে অভিহিত করা হয়। উল্লেখ্য এর আগে এই অঞ্চলকে কার্পাসমহল বলা হত। এই সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সদর দপ্তর চন্দ্রঘোনাতে স্থাপিত হয়। এই ব্যবস্থার পর, পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য সীমান্তের শান্তিরক্ষার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়া হয়। এ সময়ে রাণী কালিন্দি চাকমা রাজার দায়িত্বে ছিলেন।
১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দেব্দের জানুয়ারী মাসে কুকিদের দমনের জন্য বরকলে একটি সেনা সমাবেশ ঘটানো হয়। লুসাই চীফ রতনপুয়া গ্রামটি বরকলের উত্তর-পূর্বে ১৮ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। ২৭ জানুয়ারী তারিখে ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) র‌্যাবনের নেতৃত্বে হালকা অস্ত্রশস্ত্রসহ ২৩০ জন নির্বাচিত সিপাই ও ৪৫০ জন কুলীর মাধ্যমে খাদ্য দ্রব্যাদি বহন করে বরকল হতে রতনপুয়ার গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ঐ গ্রামে সেসময় প্রবেশ করাই কঠিন ছিল। অবশেষে ঐ সৈন্যদল ৬দিন পর্যন্ত হেঁটে অসংখ্য পাহাড়, নদী ও কাঁটাময় ঝোপ জঙ্গল অতিক্রম করে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঐ গ্রামে পৌঁছে। কুকিরা সমস্ত মূল্যবান সম্পদ সরিয়ে নিয়ে গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং গ্রাম থেকে সরে গিয়ে ওৎপেতে থেকে সৈন্যদের প্রতি আকস্মিক আক্রমণের পথ বেছে নেয়। আধুনিক যুদ্ধবিদ্যা না জানলেও কুকিরা গেরিলা যুদ্ধের পথ বেছে নিতে সময় নেয় নি।
এই সময় ইংরেজ সৈন্যরা কুকিদের ১৫০০ মন চাউল আগুনে পুড়িয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত কুকিদের কোনো বড় ধরনের ক্ষতি করা ছাড়াই ব্রিটিশ সৈন্য বরকলে ফিরে আসে। এরপর ইংরেজরা কুকিদের সাথে সন্ধি করার প্রস্তাব দেয়। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে ইংরেজরা রতনপুয়াতে কুকিদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। সে প্রস্তাবে কুকিরা সাড়া না দিলেও ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দ তারা আক্রমণ থেকে বিরত থাকে।
১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ও ১৯ জানুয়ারীতে কুকিদের একটি দল সেন্দু অঞ্চলের ২টি গ্রাম আক্রমণ করে ৫ জনকে হত্যা করে এবং মহিলা ও শিশুসহ ২৩ জনকে ক্রীতদাস হিসেবে নিয়ে যায়। একই বছরে এপ্রিল মাসে এরা ২৬ জনের একটি বাঙালী কাঠুরিয়া দলকে আক্রমণ করে ৫ জনকে গুলি করে এবং ৯ জনকে আটক করে। অতঃপর তারা একটি খিয়াংথা গ্রামে আক্রমণ করে এবং ৫৬ জন অধিবাসীর মধ্যে ৬ জনকে হত্যা করেও ৩০ জনকে বন্দী করে নিয়ে যায়। ১৮৬৫-৬৬ সনে সেন্দুরা পার্বত্য অঞ্চলে তারা আরো ২টি হামলা করে। প্রথমবারে ৬ জনকে এবং দ্বিতীয়বারের ২০ জনেরও অধিক ব্যক্তিকে বন্দী করেনিয়ে যায়।
১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে কুকীদের অনুসরণ করে লুসাই-এর হলং জাতি লুণ্ঠন শুরু করে। এরা প্রথম আক্রমণ চালায় ৬ই জুলাই। সে সময় তারা বনযোগী ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীদর গ্রাম লুণ্ঠন করে। পার্বত্য অঞ্চলের দক্ষিণে উপত্যকায় এদেরকে বলা হতো বোমাং কুকী। এদেরই একটি দল কর্ণফুলী নদীর শাখা কাপ্তাই খালে ঢুকে পড়ে এবং সেখানে একটি গ্রাম ধ্বংস করে। তারা ৮০ জনকে বন্দী হিসেবে নিয়ে যায় এবং ৪ জনকে হত্যা করে। এই হামলায় মূলত কুকিরাই ক্ষতিগ্রস্থ হয় বেশি।
১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারীতে হলং জাতি পুনরায় বোমাং অঞ্চলের কিয়াংথা (মগ) গ্রামে হানা দিয়ে ১১ জনকে হত্যা ও ৩৫ জনকে ধরে নিয়ে যায়। এদের সবাই ছিল অন্য ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর লোকজন। ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার অফিসার ইন চার্জ এর পদবী সুপারিনটেনডেন্ট হতে পরিবর্তন করে জেলা প্রশাসক (Deputy Commissioner) করা হয় এবং সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলের রাজস্ব ও বিচার ব্যবস্থার যাবতীয় বিষয়েতাকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রদান করা হয়। একই সময়ে জেলাকে যথোপযুক্ত ভাগকরে মহকুমায় ভিক্ত করা হয় এবং সেগুলোতে অধীনস্থ কর্মকর্তাও নিয়োগ করা হয়। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে জেলা সদর দফতর চন্দ্রঘোনা থেকে রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তর করা হয়। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তেমন কোনো হামলার খবর পাওয়া যায় না।
১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে সাঙ্গু নদীর উপর চিমা পুলিশ ফাঁড়িতে একটি হামলা হয় এবং ১০ জনের গার্ড পরাজিত হয় ও ফাঁড়িটি ধ্বংস হয়। ৭ জন নিহত হয় এবং সমস্ত গার্ডের মহিলা ও শিশুদের বন্দী হিসেবে নিয়ে যায়। এরা ঠিক করা হল ? না কুকি ছিল তা জানা যায় না। ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ সরকার চিমা পুলিশ ফাঁড়িটি পুনরায় সংস্কার করে। এরপর ওই বছরে আর কোনো আক্রমণ হয় নি।
১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে জুলাই ভোরে, চিমা পুলিশ ফাঁড়ির নিকটবর্তী একটি গ্রামে ৪০/৫০ জনের একটি দল স্থানীয় ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর একটি গ্রামে আক্রমণ করে। এই সময় তারা ৪ জন নারী-পুরুষ এবং ৬ শিশুকে আটক করে নিয়ে যায়। এই বছরের ডিসেম্বর মাসে এরা চিমা ও পিন্দুর মাঝামাঝি স্থানে সাঙ্গু নদীর পাড়ে একটি গ্রামে আক্রমণ করে। এতে ২ জন নিহত হয় এবং ১ জনকে বন্দী করে নিয়ে যায়। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে কোনো হামলা হয় নি।
১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে একটি সেন্দু নামক একটি দল পিন্দু সীমান্ত পুলিশ ফাঁড়িতে আকস্মিক হামলা চালায়। এই হামলায় সীমান্ত ফাঁড়ি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীদের এই ক্রমাগত আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য ইংরেজরা লুসাই অঞ্চলে একই সাথে ২টি প্রতি আক্রমণ পরিচালিত হয়। একটি কেচার হতে জেনারেল বাউচারের নেতৃত্বে এবং অপরটি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল হতে জেনালের ব্রাউনলো, সি.বি. এর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এ যুদ্ধাভিযান পাঁচ মাসব্যাপী চলে এবং সম্পূর্ণরূপে সফল হয়। এই সময় বন্দীরা উদ্ধার হয় এবং আক্রমণকারীদের অনেকে আত্মসমর্পণ করে। তারপর তাদেরকে বেআইনী ও অকারণে আক্রমণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জরিমানা দিতে বাধ্য করা হয়। এরপর অনেকদিন এই অঞ্চল শান্ত ছিল। ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজেদের লুসাই অভিযানের সময় চাকমা রানি কালিন্দির আদেশে রাজা হরিশচন্দ্র ইংরেজদের সাহায্য করেন। এই কারণে ব্রিটিশ সরকার রাজা হরিশচন্দ্রকে ‘রায় বাহাদুর’ খেতাব দেন। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে কালিন্দিরানির মৃত্যুর পর হরিশচন্দ্র রাজ্যশাসনের পূর্ণ অধিকার লাভ করেন।
১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বর্ষা শুরু হওয়ার সামান্য পূর্বে সেন্দুরা একটি আক্রমণের প্রচেষ্টা নেয়া হয়। কিন্তু সেমসয় ওই গ্রামটি তাদের মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত ছিল। ফলে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে হরিশচন্দ্রের প্রথমা স্ত্রীর সৌরিন্ধ্রীর গর্ভজাত পুত্র ভুবনমোহন রায় রাজা হন। তবে তিনি নাবালক থাকায়, তাঁর পক্ষে রাজ্যশাসন করেন রায়সাহেব কৃষ্ণচন্দ্র দেওয়ান। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭মে-তে ভুবনমোহন রায়-কে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজপদে অভিষিক্ত করা হয়। ভুবনমোহন রায়ের প্রথম স্ত্রী দয়াময়ী’র গর্ভে নলিনাক্ষ রায় এবং বিরুপাক্ষ রায় নামক দুটি পুত্র সন্তান এবং কন্যা বিজনবালার জন্ম হয়। এই স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি রমাময়ীকে বিবাহ করেন।
১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা লুসাই পাহাড় দখল করে নেয়। এরপর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার গুরুত্ব অনেকটা হ্রাস পায়। এই সময় রাঙামাটিকে মহকুমায় পরিণত করা হয়। তখন জেলাটি বিভাগীয় কমিশনারের অধীনস্থ একজন সহকারী কমিশনারের দায়িত্বে দেয়া হয়।
১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা একটি চূড়ান্ত সেনা অভিযান পরিচালনা করে আক্রমণকারীদের দমন করতে সমর্থ হয়।
১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের ১নং রেগুলেশান অনুযায়ী রাঙমাটিকে পুনরায় জেলায় উন্নীত করা হয় এবং অফিসার-ইন-চার্জ এর পুরাতন পদবী সুপারিনটেনডেন্ট প্রত্যার্পণ করা হয়। জেলার সীমানা সংশোধন করে, দেমাগিরির ১৫০০ জনের বসতিসহ পূর্বাংশের একটা লম্বা অংশ লুসাই জেলায় স্থানান্তর করা হয়। জেলাটি একই সময়ে চাকমা, মং ও বোমাং সার্কেলের বিভক্ত করা হয় এবং স্বস্ব সার্কেল চীফদের কাছে ন্যস্ত করা হয়। সার্কেল চীফকে রাজস্ব আদায়ের এবং নিজ নিজ এলাকার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। চাকমা সার্কেলের অধীনে থাকে জেলার মধ্যবর্তী ও উত্তরাঞ্চল, বোমাং সার্কেলের অধীনে দক্ষিণাংশ এবং মং সার্কেলের অধীনে থাকে উত্তর-পশ্চিমাংশ। এ সার্কেলগুলো অনুরূপ অংশ নিয়ে ৩টি মহকুমা রাঙামাটি, বান্দরবান ও রামগড়কে মহকুমা ঘোষণা করে মহকুমা প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয় এবং তাদেরকে সার্কেল চীফের কার্যাবলী তদারকী ও লিঁয়াজো করার দায়িত্ব দেয়া হয়।
১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের রেগুলেশানটি পার্বত্য চট্টগ্রাম (সংশোধন) রেগুলেশান, ১৯২০ দ্বারা সংশোধিত হয় এবং সুপারিনটেনডেন্ট পদটি পরিবর্তণ করে জেলা প্রশাসক ও এসিসট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট পদটিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর করা হয়। দ্বৈত শাসনের প্রশাসনিক পদ্ধতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে “শাসনবহির্ভূত অঞ্চল” হিসাবে নির্বাহী পরিষদের সহায়তায় গভর্ণরের এক চেটিয়া দায়িত্বে সংরক্ষিত রাখা হয়।
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ভুবনমোহন রায় মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর প্রথম পুত্র নলিনাক্ষ রায় রাজা হন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত বিভাজনের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাটি তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করা হয়। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে রাজা নলিনাক্ষ রায়ের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র ত্রিদিব রায় চাকমা রাজা হন।
১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে কর্ণফুলীতে নদীতে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হলে পার্বত্য রাঙামাটির ভৌগলিক ও আর্থ- সামাজিক অবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তণ আসে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কাপ্তাই বাঁধের কারণে ১,০০,০০০ অধিবাসী ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং পাহাড়ী অধিবাসীদের মধ্যে অসন্তোষের কারণ গুলোর মধ্যে তা ছিল অন্যতম।
ছবি : নির্মল বড়ুয়া মিলন
উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ২রা ডিসেম্বরের শান্তি চুক্তিটি এ অঞ্চলের ৩য় চুক্তি ;
১ম : ১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা-মোগলদের ভিতরে শান্তিচুক্তি হয়।
২য় : ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে চাকমা রাজার জানবক্সের সাথে ইংরেজদের শান্তি চুক্তি হয়।
৩য় : ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ২রা ডিসেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটির আহবায়ক আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস-মুল) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়।
মোগলরা চাকমা রাজাকে রায় উপাধি প্রদান করেন।
জাতিগত বঞ্চনার সমাধান হিসাবেই ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ৷ কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি - বাঙ্গালী বহুমূখী বঞ্চনা বিদ্যামান৷ কিছু ক্ষেত্রে তা প্রশাসনিক ভাবেও৷ এর উত্তর কাপ্তাই বাঁধ৷ এবং আঞ্চলিক দল সমুহের উগ্র সম্প্রদায়িকতা।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সংবিধান প্রনয়নকালে এর প্রস্তাবনায়ও বলা হয়েছিল, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে৷
কিন্তু সাম্য-মৈত্রী- স্বাধীনতার কথিত ওই ধারনাটিকে এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিতে পারেনি৷
এর প্রমান হলো ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ৷
চুক্তিতে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রাখিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তরফ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অদিবাসীদের পক্ষ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নিম্নে বর্ণিত চারি খন্ড (ক,খ,গ,ঘ) সম্বলিত চুক্তিতে উপনীত হন”৷
এই চুক্তিতে কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক দলকে বা একটি সম্প্রদায়কে প্রধান্য দেয়া হয়েছে৷
কিন্তু চুক্তির পর দীর্ঘ ২৫ বছর যাবত্ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙ্গালী ও ক্ষুদ্র গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ভিতর পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ স্থানীয় অদিবাসীদের মধ্যে কোন ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি বা পার্বত্য জনপদের সকল জনগোষ্ঠীর জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে সম-ভুমিকা রাখতে পারেনি৷ এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির কোথাও জুম্মু জনগণ শব্দটি লেখা নাই।
এ শব্দর প্রয়োগ বা বলার ক্ষেত্রে কারোই আপত্তি থাকার কথা নয় কিন্তু চুক্তিকে উপজাতি শব্দের পরিবর্তে প্রশাসনিক ভাবে লেখতে গেলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে সংশোধন করা প্রয়োজন আর না হয় যাঁরা এই জুম্মু শব্দ প্রশাসনিক ভাবে লেখেন বা বলেন তাদের বেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি লঙ্গন এর সামিল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, কথিত পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অদিবাসীদের পক্ষ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দ ২৫ বছরের মধ্যে একবারও পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এর কোন সাধারন পাহাড়ি - বাঙ্গালীদের এক সাথে নিয়ে বৈঠক করেনি,(আর অদ্যবধি যাদের নিয়ে পিসিজেএসএস নেতৃবৃন্দ বৈঠক করেছেন এসব পাহাড়ি - বাঙ্গালীরা তাদের পকেটের লোকজন)৷
পার্বত্য চুক্তির পর ২৫ বছরে ডাকঢোল পিটিয়ে,কিছু সংখ্যাক সভা - সেমিনার করে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের রাজনৈতিক ধোঁয়া তোলা হয়েছে৷ রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এর ২৫ বছর পূর্তিতে তার প্রমান মিলেছে।
২৫ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা হয়নি৷
এমন কি চুক্তি স্বাক্ষরকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি তার নিজস্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত করার মতো উল্লেখযোগ্য নজিরও নাই, বরং তাদের বিরুদ্ধে নিজ জনগোষ্ঠীর লোকজনদের উপর প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্গন,অপহরন, হত্যা, কোটি কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে৷
আমি বা আমার বক্তব্য সরকার, কোন রাজনৈতিক সংগঠন বা পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে নয়, সাম্য- মৈত্রী ও স্বাধীনতার ধারনা পার্বত্য অঞ্চলে বর্তমানে কতটা প্রাসঙ্গিক তা তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র ৷ মূল সড়কের ওপর কালেক্টর এর মাধ্যে বন্ধ হয়নি চাঁদাবাজি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় যে কোন সময়ের চেয়ে বেশী এসময় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য চরম আকার ধারন করেছে ৷
যাক পার্বত্য চট্টগ্রামে মূল সমস্যা ভূমি বিরোধ তা নিয়ে আলোচনা করা অতিব জরুরী।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক ৯ আগস্ট “পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০১৬” নামে উক্ত সংশোধনী আইনের প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন -২০০১ (সংশোধন) ২০১৬ জাতীয় সংসদে পাশ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পাওয়ার পর সরকার গেজেটের মাধ্যমে আইন আকারে প্রকাশ করেছে ৷
এ আইন অনুসারে ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে৷ যেমন; আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের সদস্য সংখ্যা ছিলো কমিশনের চেয়ারম্যান (অবসর প্রাপ্ত ১ জন বিচারপতি) সহ ৭ জন, সংশোধন করে এ কমিশনের সদস্য সংখ্যা করা হয়েছে ৯ জন৷
কমিশনের চেয়ারম্যান ১ জন (অবসর প্রাপ্ত ১ জন বিচারপতি),পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান/প্রতিনিধি কমিশনের সদস্য ১ জন, রাঙামাটি (চাকমা),খাগড়াছড়ি (ত্রিপুরা) ও বান্দরবান (মারমা) পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান/প্রতিনিধি সদস্য ৩ জন, রাঙামাটি (চাকমা সার্কেল চীফ),খাগড়াছড়ি (মং সার্কেল চীফ) ও বান্দরবান (বোমাং সার্কেল চীফ) সার্কেল চীফ/প্রতিনিধি সদস্য ৩ জন ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার সদস্য ১ জন ৷
উলেস্নখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে রাখা হয়নি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর কোন প্রতিনিধি ৷
তাহলে ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে মুসলিম,হিন্দু ও বড়ুয়া অন্য সম্প্রদায়ের লোকজন তো প্রতিনিধি হিসাবে রাখা হয়নি। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, রাঙামাটি (চাকমা সার্কেল চীফ),খাগড়াছড়ি (মং সার্কেল চীফ) ও বান্দরবান (বোমাং সার্কেল চীফ) সার্কেল চীফগণ আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি উল্টা উভয়ের মধ্যে অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে।
বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে বলা হয়েছে,যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে৷
এছাড়া ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রাখিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা৷ ২০১৬ সালের সংশোধীত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনে ৩টি জনগোষ্ঠীকে প্রধান্য দেয়া হচ্ছে, লঙ্গিত হয়েছে বাংলাদেশের সংবিধান এবং ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি৷
আগের আইনে ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে চেয়ারম্যান যে কোন সিদ্ধান্ত একক ভাবে নিতে পারবেন, সংশোধীত আইনে কমিশনের সে ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে৷
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের প্রস্তাবে নতুন আইনে বলা হয়েছে, কমিশনের সকল সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের যে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে৷
পার্বত্য চট্টগ্রাম ভুমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন -২০০১ (সংশোধন) ২০১৬ বাস্তবায়ন করে কৌশলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৯০০ সালের রেগুলেসন আইন পুর্ণ বলবত্ করা হয়েছে৷
আইনে বলা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (উপজাতীয়) প্রথায় ভুমি বন্দোবস্তী দেয়া হবে, আসলে সেই প্রথা কি ?
সহজ ও সরল ভাবে বলতে গেলে; প্রথমত ১জন ভুমির মালিক তার খাস জায়গা বা ভুমি নিজের নামে বন্দোবস্তী করতে চাইলে বা আবেদন করলে প্রথম যেতে হবে তার এলাকার/গ্রামের কার্বারীর কাছে, সে কার্বারীর সুপারিশ নিয়ে ভুমির মালিক যাবে ২য় পর্য়ায়ে মৌজা হেডম্যানের কাছে, কিন্তু (পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি)’র পক্ষ থেকে গ্রাম প্রধান কার্বারীকে আগে থেকে বলা আছে, কোন বাঙ্গালী (মুসলিম, হিন্দু ও বড়ুয়া পার্বত্য অঞ্চলে এরা হচ্ছে বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী) যদি ভুমি/ জায়গার সুপারিশ নিতে আসে তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে ৷
ভুমির মালিক যদি কয়েক মাস দৌড়-ঝাপ করে হয়তো মিলেও যেতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছ থেকে অনুমতি ৷
ভুমির মালিক ২য় পর্য়ায়ে মৌজা হেডম্যানের কাছে গেলে সবার আগে হেডম্যান চাইবে সার্কেল চীফের স্থানীয় নাগরিকের সনদপত্র,(পার্বত্য চুক্তিতে এ ক্ষমতা জেলা প্রশাসক ও সার্কেল চীফদের প্রদান করা হয়েছে, কিন্তু সার্কেল চীফ, হেডম্যান ও কারর্বারীদের কাছে জেলা প্রশাসক প্রদত্ত স্থানীয় নাগরিকত্ব সনদপত্র গ্রহন যোগ্য নয়) যদি থাকে তো ভালো, না হলে দিনের পর দিন ঘুরতে হবে সেই সার্কেল চীফের সনদপত্রের জন্য ৷
সার্কেল চীফদের কার্যালয়ে গিয়ে দেখবেন তাদের কার্যালয়ে পাহাড়িরদের জন্য ১টি ফাইল আর বাঙ্গালীদের জন্য ১টি ফাইল৷ পাহাড়িদের ফাইলে দেখবেন ৩০টি সনদপত্রের জন্য আবেদন আর বাঙ্গালীদের ফাইলে দেখবেন ১-২টি সনদপত্রের জন্য আবেদন, এ সনদের জন্য পাহাড়িদের কাছ থেকে নেয় ১শত টাকা ফি আর বাঙ্গালীদের কাছ থেকে নেয়া হয় হাজার টাকা ফি, যাহা চরম বৈষম্য ও সুস্পষ্ট মানবাধীকার লঙ্গন ৷
যাক ধরে নিন, ভুমির মালিক সার্কেল চীফের কাছ থেকে স্থানীয় নাগরিকের সনদপত্র নিতে পেরেছেন, এবার মৌজা হেডম্যানের কাছে সুপারিশ নিয়ে ৩য় পর্যায়ে ভুমির মালিক যাবে সার্কেল চীফের সুপারিশ নিতে,ভাগ্য ভাল হলে সার্কেল চীফের সুপারিশ পেয়ে যাবে, না হলে দিনের পর দিন ঘুরেও ভুমি/ জায়গার মালিক সার্কেল চীফের কাছ থেকে সুপারিশ পাবেনা৷
ভুমি/ জায়গার মালিককে কেন সার্কেল চীফ সুপারিশ করছে না অথবা সমস্যা কি জানতে ভুমি/জায়গার মালিক সেই সার্কেল চীফের সাথে দেখা করতে চাইলে সার্কেল চীফ দেখা করবেনা বলে সাফ জানিয়ে দেন বর্তমানেও৷ সার্কেল চীফের কার্যালয় থেকে সে ভুমির মালিককে বলা হয় আপনার সমস্যা জানিয়ে সার্কেল চীফের কাছে আবেদন করতে ৷ একবার,দুইবার ও তিনবার আবেদন করেও কোন ফল পাওয়া যায় না৷ একদিকে ভুমির মালিকের দখলে থাকা ভুমি/জায়গা বন্দোবস্তীর জন্য সুপারিশ করবেনা অন্য দিকে সার্কেল চীফ সেই ভুমি/জায়গার মালিকের সাথে দেখাও করেন না ৷(এই কাজটি বেশী করেন চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়)৷
ধরা যাক ভুমির মালিক সার্কেল চীফের সুপারিশ পেয়ে গেছেন, ৪র্থ পর্যায়ে যেতে হবে উপজেলা ভুমি কর্মকর্তা (এসি ল্যান্ড)’র কাছে৷ উপজেলা ভুমি কর্মকর্তা (এসি ল্যান্ড) অফিসে সেই কয়েক মাস পড়ে থাকার পর যাচাই - বাচাই করে, ৫ম পর্যায়ে উপজেলা ভুমি কর্মকর্তা সুপারিশ করে সেই ভুমি বন্দোবস্তীর ফাইল পাঠাবেন জেলা প্রশাসকের কাছে, সেই ফাইল অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) যাচাই - বাচাই করে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ৬ষ্ঠ পর্যায়ে সেই ভুমি বন্দেবস্তীর ফাইল পাঠাবেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে অনুমোদনের জন্য ৷
জেলা পরিষদে সেই ভুমি বন্দোবস্তীর ফাইল কয়েক মাস পড়ে থাকার পর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের অনুমোদন পেলে সেই ভুমি/ জায়গা বন্দোবস্তীর ফাইল চলে যাবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে, সেখানে কয়েক মাস শুনানী করার পর খাস ভুমি/জায়গার মালিককে অফিসিয়াল পত্র দিয়ে জানিয়ে দেয়া হবে ভুমি বন্দোবস্তীর সেলামীর টাকা (রাজস্ব) জমা দেয়ার জন্য৷
এখানে কেবলমাত্র মৌজার জায়গা/ভুমি বন্দোবস্তীর বিষয়ে বলা হয়েছে ৷
পার্বত্য তিন জেলায় রয়েছে বাজার ফান্ড নামক আরো একটি গোদের উপর বিষ পোড়া ৷
উল্লেখ্য, আদালতের মাধ্যমে সিএইচটি রেগুলেশন ১৯০০ বাতিলের জন্য বা বন্ধের দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পক্ষ বা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিরোধীরা বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করছে। তাতে একটি বিষয় পরিস্কার
‘ব্রিটিশ প্রণীত ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনে প্রথাগত আইন, রীতি-নীতি ও ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি বলে বাংলাদেশ সরকারের নিকট তারা সুরক্ষা চায়।
১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের রেগুলেশানটি পার্বত্য চট্টগ্রাম (সংশোধন) রেগুলেশান, ১৯২০ দ্বারা সংশোধিত হয় এবং সুপারিনটেনডেন্ট পদটি পরিবর্তণ করে জেলা প্রশাসক ও এসিসট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট পদটিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর করা হয়। দ্বৈত শাসনের প্রশাসনিক পদ্ধতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে “শাসনবহির্ভূত অঞ্চল” হিসাবে নির্বাহী পরিষদের সহায়তায় গভর্ণরের এক চেটিয়া দায়িত্বে সংরক্ষিত আইন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরিপস্থি কারণ
১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রাখিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তরফ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অদিবাসীদের পক্ষ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নিম্নে বর্ণিত চারি খন্ড (ক,খ,গ,ঘ) সম্বলিত চুক্তিতে বলা হয়েছে। এখন কেউ যদি ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের রেগুলেশানটি পার্বত্য চট্টগ্রাম (সংশোধন) রেগুলেশান, ১৯২০ দ্বারা সংশোধিত হয় এবং সুপারিনটেনডেন্ট পদটি পরিবর্তণ করে জেলা প্রশাসক ও এসিসট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট পদটিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর করা হয়। দ্বৈত শাসনের প্রশাসনিক পদ্ধতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে “শাসনবহির্ভূত অঞ্চল” হিসাবে নির্বাহী পরিষদের সহায়তায় গভর্ণরের এক চেটিয়া দায়িত্বে সংরক্ষিত আইন বলবৎ চায় তাহলে সবার আগে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাতিল করিতে হবে।
১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের রেগুলেশানটি পার্বত্য চট্টগ্রাম (সংশোধন) রেগুলেশান, ১৯২০ দ্বারা সংশোধিত আইনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরিপন্থি বলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী অভিজ্ঞ মহলের মতামত।
লেখক : নির্মল বড়ুয়া মিলন
মূখ্য সম্পাদক
সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম
তারিখ : ১২ জুলাই-২০২৪ ইংরেজি
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।





উপ সম্পাদকীয় এর আরও খবর

পার্বত্য চুক্তির ২৭ বছর : শান্তি চুক্তি পাহাড়ে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ পার্বত্য চুক্তির ২৭ বছর : শান্তি চুক্তি পাহাড়ে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ
একেএম মকছুদ আহমেদ এর সাংবাদিকতায় ৫৫ বছর :  গণমাধ্যমের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ, হামলা ও হুমকি বৈষম্যবিরোধী চেতনার পরিপন্থি একেএম মকছুদ আহমেদ এর সাংবাদিকতায় ৫৫ বছর : গণমাধ্যমের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ, হামলা ও হুমকি বৈষম্যবিরোধী চেতনার পরিপন্থি
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মৌলভীবাজারের পাঁচগাঁওয়ের দূর্গাপূজা ও কিছু কথা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মৌলভীবাজারের পাঁচগাঁওয়ের দূর্গাপূজা ও কিছু কথা
পার্বত্য চুক্তির ২৬ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ কি-কি বৈষম্যের স্বীকার তা নিয়ে একটি পর্যালোচনা পার্বত্য চুক্তির ২৬ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ কি-কি বৈষম্যের স্বীকার তা নিয়ে একটি পর্যালোচনা
আন্তর্বর্তীকালিন সরকার পাহাড়ের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিলে নিতে হবে গভীর বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে আন্তর্বর্তীকালিন সরকার পাহাড়ের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিলে নিতে হবে গভীর বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে
সবকিছু কেড়ে নিয়েছে স্বৈরাচারী খুনি হাসিনার আওয়ামীলীগ সবকিছু কেড়ে নিয়েছে স্বৈরাচারী খুনি হাসিনার আওয়ামীলীগ
রাঙামাটিতে ঐক্যবদ্ধ বড়ুয়া সমাজ গড়ে তোলার সম্ভবনার পথ দেখা দিয়েছে রাঙামাটিতে ঐক্যবদ্ধ বড়ুয়া সমাজ গড়ে তোলার সম্ভবনার পথ দেখা দিয়েছে
আগামীতে  কারা দেশ চালাবে ? …সাইফুল হক আগামীতে কারা দেশ চালাবে ? …সাইফুল হক
সীমান্ত সড়ক পশ্চাদপদ পার্বত্য অঞ্চলকে উন্নয়নের স্রোতধারায় একীভূত করেছে সীমান্ত সড়ক পশ্চাদপদ পার্বত্য অঞ্চলকে উন্নয়নের স্রোতধারায় একীভূত করেছে

আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)