বৃহস্পতিবার ● ১ আগস্ট ২০২৪
প্রথম পাতা » খুলনা বিভাগ » দীর্ঘ ৫১ বছরেও বেড়িবাঁধের দেখা মেলেনি নদীর ভাঙনে বিলীন হচ্ছে মোরেলগঞ্জ
দীর্ঘ ৫১ বছরেও বেড়িবাঁধের দেখা মেলেনি নদীর ভাঙনে বিলীন হচ্ছে মোরেলগঞ্জ
এস. এম সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট :: দীর্ঘ ৫১ বছরেও সেই স্বপ্নের বেড়িবাঁধের দেখা মেলেনি পানগুছি নদীর অব্যাহত ভাঙনে প্রতিদিনই বদলে যাচ্ছে উপকূলীয় উপজেলা বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের মানচিত্র। প্রতিদিন ভাঙছে নতুন নতুন এলাকা। বসতবাড়িসহ বহু প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট চলে গেছে নদীগর্ভে। গত ৫১ বছরে পানগুছি নদীর আয়তন বেড়েছে তিনগুন। এক কিলোমিটারের বেশি এখন নদীটির প্রশস্ততা। এই নদীর তীরে উপজেলার ৩ লাখ লোকের বসতি। দেশ স্বাধীনের আগে থেকেই এই নদীর তীরে বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। যার পোল্ডার নং ৩৫/২। কিন্তু দীর্ঘ ৫১ বছরেও সেই স্বপ্নের বেড়িবাঁধের দেখা মেলেনি। বিভিন্ন সময় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী আন্দোলন, মানববন্ধন করেছেন। মন্ত্রী, এমপি ও পাউবোর কর্মকর্তারা পরিদর্শনও করেছেন বহুবার। বেড়িবাঁধের দাবিতে ডিও লেটারসহ দৌঁড়ঝাপও করেছেন তারা। কিন্তু এখনো দৃশ্যমান কোন কিছুই দেখতে পারেননি এলাকাবাসী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার নদীর তীরবর্তী ৯টি ইউনিয়নের ৩০টি গ্রাম নদীর অব্যাহত ভাঙনে নিঃস্ব হচ্ছে শত শত পরিবার। গাবতলা গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এ গ্রামের অনেকেই নদীগর্ভে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে অন্যত্র চলে গেছে।’
জেলে পল্লীর বাসিন্দা সেলিম তালুকদার, গফফার তালুকদার, শহিদ বেপারী বলেন, ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি বেড়িবাঁধ হবে। এ পর্যন্ত ৩-৪ বার বসতবাড়ি ভেঙেছে। নতুন করে গড়েছি। এখন আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। বাপ-দাদাদের অনেক জমি ছিল, এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এলেই আতঙ্কে থাকতে হয় আমাদের।
অপরদিকে কাঁঠালতলায় আশ্রয়ন প্রকল্পের ১১টি পরিবারের নেই কোনো যাতায়াতের রাস্তা। আশ্রয়ণের বাসিন্দা সাফিয়া বেগম, মাহিনুর, নূরজাহান, চম্বা বেগমসহ একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারিভাবে চার মাস হয়েছে তারা ঘর পেয়েছেন। কিন্তু এখান থেকে যাতায়াতের কোনো রাস্তা নেই। বন্যা হলে বা পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ঘরেই থাকতে হয় তাদের। চলাচলের রাস্তা না থাকায় তারা চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। ঘর পেলেও একরকম বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে আছেন।
আশ্রয়ণের বাসিন্দাদের অভিযোগ- মাটির রাস্তার কাজ শুরু করেও মাঝ পথে তাও আবার বন্ধ হয়ে গেছে। তারা দ্রুত আবার রাস্তার নির্মাণকাজ শুরু করার দাবি জানান।
৫১ বছরে শুধু উপজেলা সদর থেকে নদীগর্ভে চলে গেছে, খাদ্যগুদাম, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস, টেলিফোন অফিস, আব্দুল আজিজ মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, এসিলাহা উচ্চ বিদ্যালয়ের মূল ভবন, ডাকবাংলো, বারইখালী ইউনিয়ন পরিষদ, পুলিশ কোয়াটার, আনছার ময়দান, বারইখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পোস্ট অফিস, স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের অফিস, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, থানা জামে মসজিদ, সার্বজনীন হরিসভা মন্দির, শ্মশান ঘাটসহ বহু প্রতিষ্ঠান ও রাস্তা ঘাট। বর্তমানে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে গাবতলা, কাঠালতলা, বারইখালী, ফেরিঘাট, কুমারখালী, সন্নাসী, শ্রেণিখালী, ঘষিয়াখালী, সোনাখালী, ফুলহাতাসহ ৩০টি গ্রাম। কয়েক বছর ধরে পানগুছি নদীর ভাঙনে শুধু মোরেলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের ৩টি গ্রামের কমপক্ষে ৬ শ’ পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। গাবতলা গ্রামের ৪০ একর জমি ধসে গেছে নদীতে। সিডর, আইলা, ইয়াসের পরও ভেঙে যাওয়া বাঁধ স্থায়ীভাবে রক্ষার জন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
২০২৪ সালে বাগেরহাট-৪ (শরণখোলা-মোরেলগঞ্জ) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ পানগুছি নদীর ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। সংসদ সদস্যের পরিদর্শনকালে নদীর তীরবর্তী হাজার হাজার নারী-পুরুষ শ্লোগান দেন- ত্রাণ চাই না, চাই টেকসই বেড়িবাঁধ চাই’। উপজেলা চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মো. লিয়াকত আলী খান,উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান মো. রাসেল হাওলাদার,উপজেলা পরিষদ মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আজমিন নাহার সহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে স্থানীয় সংদস্য সদস্য ডা. মোজাম্মেল হোসেন ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। ওই সময় তিনি গাবতলা হতে পশুরবুনিয়া অভিমুখে আড়াই কিলোমিটার বেড়িবাঁধের জন্য ডিও লেটার দেন। ডিও লেটারে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীনতার পূর্বে বেড়িবাঁধ নির্মাণের লক্ষে পোল্ডার নং-৩৫/২ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল যা অদ্যাবধি বাস্তবায়িত হয়নি’। ডিও লেটারের ভিত্তিতে পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম গত বছরের ১২ জুলাই পাউবো মহাপরিচলকেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু অদ্যাবধি কার্যকরী কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
২০২১সালের মে মাসে স্থানীয় এ্যাডভোকেট আমিরুল আলম মিলন ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন। ওই সময় মোরেলগঞ্জ উপজেলার বারইখালী, বহরবুনিয়া, বলইবুনিয়া ও পঞ্চকরণ ইউনিয়নের নদীর তীরবর্তী এলাকা পরিদর্শনকালে তিনি বলেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে নদী শাসন কার্যক্রম শুরু হবে। রাস্তা-ঘাট পুনঃনির্মাণ করা হবে। সন্ন্যাসী থেকে ঘষিয়াখালী পর্যন্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে।
সংসদ সদস্যের পরিদর্শনকালে নদীর তীরবর্তী হাজার হাজার নারী-পুরুষ শ্লোগান দেন- ত্রাণ চাই না, চাই টেকসই বেড়িবাঁধ চাই’। এসময় পানি উন্নয়ন বোর্ড বাগেরহাটের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মাহামুদুন্নবী,উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো.রোকনুজ্জামান,১৬নং খাউলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মাস্টার সাইদুর রহমান সহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
১৬নং খাউলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মাস্টার সাইদুর রহমান বলেন, পানগুছি নদীর অব্যাহত ভাঙন প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে সন্ন্যাসী লঞ্চঘাট হতে মোরেলগঞ্জ শহর পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার স্থায়ী বেড়িবাঁধ হলে এ সমস্যা সমাধান হতে পারে।
সরেজমিনে এ এলাকায় দেখা গেছে, পানগুছি নদীর তীরবর্তী গ্রামের শত শত বিঘা ফসলি জমি বিলীন হচ্ছে। ভাঙনের মুখে গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকটি পরিত্যক্ত হয়েছে। বিলীন হচ্ছে বসতবাড়ি, কাঁচা-পাকা রাস্তা। অনেক পরিবার ভাঙনের কবলে বাড়িঘর হারিয়ে শহরমুখী কিংবা অন্যত্র বসবাস করছে। কমিউনিটি ক্লিনিকটিও ভাঙনের মুখে। আতংকে রয়েছে নদীর তীরবর্তী ৩০টি পরিবার। গাবতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার, মসজিদ, খাউলিয়া ও গাবতলা ব্রিজ এখন হুমকির মুখে।
বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আল বিরুনী বলেন, সন্যাসী হয়ে ঘষিয়াখালী পর্যন্ত বেড়িবাঁধের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্যের মাধ্যমে ইতোমধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি টিম সরেজমিন পরিদর্শন করেছে। কাজটির অগ্রগতিও রয়েছে। আশা করছি দ্রুত কাজটি পাস হবে।‘১৪ ডিসেম্বর প্রকল্প (সিইআইপি-১) কর্তৃপক্ষ ঢাকা অফিসে বাপাউবোর কাছে শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জের ৩৫/১ এবং বাগেরহাট সদরের ৩৫/৩ এই দুটি পোল্ডারে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়া বেড়িবাঁধের কাগজপত্র হস্তান্তর করেছে। তবে শরণখোলা ও মোরেলগঞ্জের ৩৫/১ পোল্ডারের বলেশ্বরতীরের অধিক ঝুঁকিপূর্ণ সাতটি স্থান চিহ্নিত করেছি। এসব স্থানে স্থায়ীভাবে নদীশাসনের জন্য ২৬ কোটি টাকার একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।’
নদীভাঙন রোধ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এসএম তারেক সুলতান বলেন, সন্যাসী হয়ে ঘষিয়াখালী পর্যন্ত বেড়িবাঁধের জন্য স্থানীয় সংসদ সদস্যের মাধ্যমে ইতোমধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি টিম সরেজমিন পরিদর্শন করেছে। কাজটির অগ্রগতিও রয়েছে। আশা করছি দ্রুত কাজটি পাস হবে।
বাগেরহাটে মাছ উৎপাদনে অবদান রাখায় সম্মাননা পেলেন তিন চাষী
বাগেরহাট :: বাগেরহাটে মাছ চাষে অবদান রাখায় ৩ চাষীকে সম্মাননা দিয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তর। জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে বুধবার (৩১ জুলাই) দুপুরে জেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত আয়োজিত অণুষ্ঠানে এসব চাষীদের মাঝে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেন।
সম্মাননা প্রাপ্তরা হলেন- রামপাল উপজেলার মল্লিকেরবের এলাকার মো. রেদওয়ান মারুফ, মোল্লাহাট উপজেলার কুলিয়া এলাকার আলমগীর শেখ ও মোংলা উপজেলার দক্ষিন কাইনমারী এলাকার শেখ মো. সেলিম। এদের মধ্যে মো. রেদওয়ান মারুফকে বাগদা উৎপাদন, আলমগীর শেখকে গলদা এবং শেখ মো. সেলিমকে তেলাপিয়া মাছ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় সম্মাননা দেওয়া হয়।
মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহা. খালিদ হোসেন, পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত খান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাগেরহাটের উপ-পরিচালক শঙ্কর কুমার মজুমদার, বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল, সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফেরদাউস আনছারি, সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রিজিয়া পারভীন, বীর মুক্তিযোদ্ধা নকিব সিরাজ উদ্দিন, সরদার শুকুর আহমেদ প্রমুখ।
এর আগে, মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে জেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামের সামনে থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রায় মৎস্য চাষী, মৎস্য কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেনি পেশার মানুষ অংশগ্রহন করেন।