মঙ্গলবার ● ২৭ আগস্ট ২০২৪
প্রথম পাতা » ঢাকা » ইউপিডিএফের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট ৮ দাবি
ইউপিডিএফের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট ৮ দাবি
ঢাকা প্রতিনিধি :: জামিনে মুক্তদের জেল গেইটে পুনঃ গ্রেফতার বন্ধ করা, আনন্দ প্রকাশ চাকমাসহ ইউপিডিএফ ও দেশের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরতে রাজধানী ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেনে করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-মূল)।
আজ মঙ্গলবার ২৭ আগস্ট ২০২৪ সকাল সাড়ে ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের ২য় তলা জহুর হোসেন চৌধুরী হলরুমে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মেলন লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-মূল)-এর সংগঠক মাইকেল চাকমা।
সংবাদ সম্মেলন থেকে অন্তর্বর্র্তীকালীন সরকারের কাছে ৮ দফা দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো:
(১) অবিলম্বে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের সময় নিহত সকল শহীদের নাম প্রকাশ ও হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ফ্যাসিস্টদের গ্রেফতার পূর্বক বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
(২) অবিলম্বে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলে আটক ইউপিডিএফ ও তার সহযোগি সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মুক্তি দিতে হবে; আদালত থেকে জামিন লাভের পর জেল গেট থেকে পুনরায় গ্রেফতার বন্ধ করতে হবে; এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে ইউপিডিএফ ও তার সহযোগি সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের নামে দায়ের করা সকল মিথ্যা মামলা ও হুলিয়া প্রত্যাহার করতে হবে।
(৩) ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে সৃষ্ট ঠ্যাঙাড়ে নব্য মুখোশ বাহিনী ও মগ পার্টি ভেঙে দিতে হবে এবং তাদের মধ্যে যারা খুন, গুম, অপহরণ ও সন্ত্রাসের সাথে জড়িত তাদের গ্রেফতার পূর্বক শাস্তি দিতে হবে।
(৪) স্বনির্ভর গণহত্যা ও পানছড়িতে চার যুব নেতা হত্যাসহ ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল হত্যাকান্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করতে হবে এবং তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে যুক্ত করতে হবে।
(৫) অবিলম্বে নির্দলীয়, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ পুনর্গঠন করতে হবে।
(৬) অবিলম্বে বান্দরবানে চলমান কেএনএফ-বিরোধী অভিযানের নামে বম জাতিগোষ্ঠীকে নিশানা করে জাতিৎ-নিধন অভিযান বন্ধ করতে হবে এবং শিশু ও নারীসহ আটককৃত বমদের মুক্তি দিতে হবে।
(৭) খাগড়াছড়ির রামগড়ে গৃহবধূকে ধর্ষণকারীদের গ্রেফতার এবং রাঙামাটি ও বান্দরবানে ধর্ষণ প্রচেষ্টার সাথে জড়িতদের শাস্তি দিতে হবে।
(৮)পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অপারেশন উত্তরণ বাতিল পূর্বক সেনাশাসন প্রত্যাহার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ১১ দফা নির্দেশনা বাতিল করতে হবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লিখিত বক্তব্যে মাইকেল চাকমা জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদ ও মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ সহ সকল শহীদদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ ও আহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেন, তাদের মহান আত্মত্যাগের ফলে বাংলাদেশ আজ দ্বিতীয় স্বাধীনতা লাভ করেছে। আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, কারণ তাদের আত্মত্যাগের কারণেই আজ আমি মুক্ত, যেন মৃত্যু থেকে আমার ফিরে আসা। গোপন বন্দীশালা তথাকথিত আয়নাঘর থেকে যাদেরকে এখনও মুক্তি দেয়া হয়নি, আমি তাদের মুক্তির জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।
বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রতি ইউপিডিএফের সমর্থনের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে অভূতপূর্ব ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর বর্তমানে দেশে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীর্কালীন সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। ভবিষ্যতে এদেশে যাতে আর কোনো ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম হতে না পারে, সেই লক্ষ্যে নতুন সরকার অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে, যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। ইউপিডিএফ এই সরকারের প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করেছে।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকারের দুঃশাসনের কথা তুলে ধরে মাইকেল চাকমা লিখিত বক্তব্যে বলেন, পতিত ফ্যাসিস্ট জালিম সরকারের দুঃশাসনে দেশের জনগণের নাভিঃশ্বাস উঠেছিল। মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করা হয়েছিল। সরকারের অন্যায় অবিচারের সামান্য সমালোচনা করলেও নাগরিকরদেরকে জেলে ঢোকানো হয়েছে, মিথ্যা মামলায় জর্জরিত করা হয়েছে। ক্রসফায়ারের নামে হত্যা, গুম ছিল তখন স্বাভাবিক ঘটনা। আয়নাঘর নামক বেআইনী গোপন বন্দীশালা খুলে সেখানে লোকজনকে বছরের পর বছর আটক রাখা হয়েছে। নাৎসীদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মতো সেই বন্দীশালায় অত্যাচারের ভয়াবহ কাহিনী এখন প্রকাশিত হচ্ছে। এক কথায়, ফ্যাসিস্ট হাসিনা দেশকে এক নরক রাজ্যে পরিণত করেছিল।
শুধু সমতলে নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামেও হাসিনার সরকার দমনপীড়নের স্টীম রোলার চালায়, যার শিকার হয় প্রধানত ইউপিডিএফ। তার ১৫ বছরের শাসনামলে ইউপিডিএফকে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক কার্যক্রম চালাতে দেয়া হয়নি। পার্টির সকল অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়। অর্ধ শতাধিক নেতাকর্মীকে বিনা বিচারে হত্যা, গুম ও আরো অনেককে গ্রেফতার-নির্যাতন করা হয়েছে। আদালত থেকে জামিন পেলেও জেলগেট থেকে একই বন্দীকে বার বার আটক করে জেলে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর খাগড়াছড়িতে একটি ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী গঠন করে দেয়া হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। এই বাহিনী হাসিনা সরকারের ছত্রছায়ায় ১৮ আগস্ট ২০১৮ স্বনির্ভর গণহত্যা ও ১১ ডিসেম্বর ২০২৩ সালের পানছড়িতে চার যুবনেতা হত্যাসহ অসংখ্য হত্যা, অপহরণ ও গুমের সাথে জড়িত। মোট কথা, পার্বত্য চট্টগ্রামে হাসিনা আমলের অন্যায় অত্যাচার ও জুলুমের কাহিনী এখানে বলে শেষ করা যাবে না।
লিখিত বক্তব্যে তিনি হাসিনা সরকারের পতনের আন্দোলনে ইউপিডিএফের যুক্ত থাকার কথা তুলে ধরে বলেন, জুলুমবাজ ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের লক্ষ্যে সমতলের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তির পাশাপাশি ইউপিডিএফ-ও আন্দোলনে সামিল হয়েছে। আমরা গত ৭ জানুয়ারীর তার ভূয়া নির্বাচনের তফশিল প্রত্যাখ্যান এবং নির্বাচন বর্জন করেছি। আমাদের পার্টির আহ্বানে সাড়া দিয়ে জনগণ ভোট কেন্দ্রে যায়নি, ২৭টি ভোট কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। তার রক্তচক্ষু, জবরদস্তি ও দমনপীড়ন আমাদের পার্টি ও জনগণকে দমাতে পারেনি। পার্বত্য চট্টগ্রামে তার দুর্নীতিগ্রস্ত মন্ত্রী, এমপিদের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে।
মাইকেল চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে লিখিত বক্তব্যে বলেন, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে। দেশের মানুষ এখন মুক্ত হাওয়ায় প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ এখনও স্বাধীনতার সেই স্বাদ পায়নি। পাহাড়ে এখনও পরিবর্তনের হাওয়া পৌঁছেনি। সমতলে অন্যায়ভাবে আটক রাজবন্দীরা মুক্তি পেতে শুরু করলেও, পার্বত্য চট্টগ্রামে বন্দী ইউপিডিএফ ও তার সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীদের এখনও ছেড়ে দেয়া হয়নি। এই বন্দীদের অনেকে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিনা বিচারে কারাগারে অন্তরীণ রয়েছেন। হাসিনার আমলে জামিন পাওয়ার পরও জেল গেট থেকে পুনরায় গ্রেফতার করার কারণে তারা এখন নতুন করে আদালতে জামিনের আবেদন করতে সাহস পাচ্ছেন না।
তিনি বলেন, সমতলে ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর ও সহযোগিদের কেউ কেউ গ্রেফতার হলেও, পার্বত্য চট্টগ্রামে তারা এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে এবং সমতলের মুক্ত হাওয়া পাহাড়ে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। তিনি সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার কথা লিখিত বক্তব্যে তুলে ধরেন।
এসম ইউপিডিএফ সদস্য থুইক্যচিং মারমা,সদস্য সুনয়ন চাকমা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর সভাপতি অঙ্কন চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি জিকো ত্রিপুরা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সদস্য রূপসী চাকমা প্রমুখ উপিস্থিত ছিলেন।