শুক্রবার ● ১৫ নভেম্বর ২০২৪
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » একেএম মকছুদ আহমেদ এর সাংবাদিকতায় ৫৫ বছর : গণমাধ্যমের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ, হামলা ও হুমকি বৈষম্যবিরোধী চেতনার পরিপন্থি
একেএম মকছুদ আহমেদ এর সাংবাদিকতায় ৫৫ বছর : গণমাধ্যমের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ, হামলা ও হুমকি বৈষম্যবিরোধী চেতনার পরিপন্থি
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: আজ ১৫ নভেম্বর-২০২৪ সাংবাদিক একেএম মকছুদ আহমেদ এর সাংবাদিকতা পেশায় ৫৫ বছর পূর্ণ হল। একেএম মকছুদ আহমেদ ইতিমধ্যে ৮০ বছর পার করলেন। পাশাপাশি সাংবাদিকতা জীবনে ৫৫ বছর পূর্ণ করেছেন।
১৯৯৫ সালে আমি যখন বগুড়ায় দৈনিক করতোয়া পত্রিকায় এবং দৈনিক আজকের ভোলা পত্রিকায় কর্মরত ছিলাম তখনও সাংবাদিক একেএম মকছুদ আহমেদ ভাইয়ের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো।
সাংবাদিক একেএম মকছুদ আহমেদ ভাই আমাকে অনেক স্নেহ করেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত প্রথম জাতীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম এর প্রধান উপদেষ্টা। একেএম মকছুদ আহমেদ ভাই সিএইচটি মিডিয়া পরিবারের অত্যান্ত শ্রদ্ধাভাজন একটি নাম।
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি থেকে ১৯৭৮ সালের ২৬শে মার্চ সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক ‘বনভূমি’ পত্রিকা। এরপর ১৯৮৩ সালের ২৬শে মার্চ প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক গিরিদর্পণ’ পত্রিকা।
বনভূমি পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হলেও দৈনিক গিরিদর্পণ পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে দৈনিক গিরিদর্পণ প্রকাশনার ৪২ বছর পূর্ণ করেছে। দুটি পত্রিকার প্রকাশক সাংবাদিক একেএম মকছুদ আহমেদ ভাই।
সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিষ্ট সাজ্জাদ শরিফ লিখেছেন ; সাংবাদিকতা মানে ‘কুমিরভরা পুকুরে সাঁতার কাটা’।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতার কপাল সব সময়ই মন্দ। যে গণতন্ত্র আর সার্বিক মানবিক স্বাধীনতার আকাঙ্খা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ আর এর আগের আন্দোলনগুলো হলো, বলা ও মতপ্রকাশের অধিকার ছিল তার ভিত্তি। আর এর প্রাণই ছিল সাংবাদিকতা চর্চার অবাধ স্বাধীনতা।
মুক্ত সাংবাদিকতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পৃথিবীব্যাপী মানবাধিকার রক্ষার মূল ভিত্তি। এটা কথার কথা নয়। ১৯৫৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারিতে সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে আলোচনার সময় শেখ মুজিবুর রহমান গণপরিষদে কী বলেছিলেন, আমরা একটু ফিরে দেখি।
স্পিকারের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘আপনারা বলে থাকেন যে বাকস্বাধীনতা মানেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। আপনি কি জানেন যে সম্পাদকদের ডেকে বলা হয়, আপনারা এটা ছাপাতে পারবেন না, আপনারা ওটা ছাপাতে পারবেন না। স্যার, তাঁরা সত্য কথা পর্যন্ত লিখতে পারেন না এবং আমি সেটা প্রমাণ করে দিতে পারি।…নির্দেশটা যায় সচিবালয় থেকে…। সরকারের তরফ থেকে একজন হাবিলদার বা একজন ইন্সপেক্টর গিয়ে নির্দেশনা দেন যে আপনি একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে লিখতে পারবেন না।’
৫ আগষ্ট-২০২৪ এর পর সাংবাদিকতার প্রেক্ষাপট :
অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ও অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিলের ঘটনা ঘটেছে। হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটেছে ৷
এ পর্যন্ত দুই দফায় মোট ৪৯ জন সাংবাদিকের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। কার্ড বাতিল হওয়ার আশঙ্কায় আছেন আরো অনেক সাংবাদিক।
তবে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী মনে করেন, “বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম স্মরণকালের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ভোগ করছে।” বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ মনে করেন সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার ও তাদের অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল করে স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করা হচ্ছে,” সাংবাদিক নামের যারা প্রকাশ্যে গণহত্যায় ইন্ধন দিয়েছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। ফ্যাসিবাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নে যাদের সচিবালয়ের প্রেসকার্ড দেয়া হয়েছে, তাদের কার্ড বাতিল করে স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করা হবে।”
এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক বিবৃতিতে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্বার্থান্বেষী মহলের হামলা-ঘেরাওয়ের হুমকি, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নির্বিচার মামলা ও হেনস্তার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, গণমাধ্যমের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ, হামলা ও হুমকি বৈষম্যবিরোধী চেতনার পরিপন্থি। ভিন্নমত ও মুক্ত গণমাধ্যমের ঢালাও নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপত্তাহীনতা মূলত কর্তৃত্ববাদের পুনরাগমনের পথ সৃষ্টি করবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেন,‘‘ আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন মহল দেশের কোনো কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, হামলা, ঘেরাওয়ের হুমকিসহ নানা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যত অতিক্ষমতায়িত কোনো কোনো মহলের স্বার্থের বাইরে গেলেই গণমাধ্যমকে আক্রমণ ও সাংবাদিক হেনন্তা, গণমাধ্যমকে দখল বা খেয়ালখুশিমতো পরিচালনার প্রচেষ্টা চলছে, যা আসলে মুক্ত গণমাধ্যমের সম্ভাবনার জন্য অশনিসংকেত।”
৫ নভেম্বর সম্পাদক পরিষদ এক বিবৃতিতে বলেছে, “বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখনো আক্রমণের মুখে আছে।” পরিষদ গণমাধ্যমসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে ‘মব জাস্টিস’ কঠোর হাতে দমন করতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে।
সম্পাদক পরিষদ একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রতি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিপন্থি কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছে।
সম্পাদক পরিষদ বলেছে, গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ও এর মধ্য দিয়ে সৃষ্ট নতুন বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিশ্রুতি হলো, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। তারপরও সম্পাদক পরিষদ অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে, এখনো সমাজের কোনো কোনো অংশ থেকে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতার ওপর নানাভাবে আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।
আর কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিষ্ট (সিপিজে) সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন বাতিল করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে মনে করা আরো ২৯ সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন অন্তর্বর্তী তথ্য মন্ত্রণালয়ের বাতিল করার খবরে সিপিজে উদ্বিগ্ন। সিপিজে বলেছে, সাংবাদিকদের কাজের জন্য তাদের নিশানা বানাতে প্রেস অ্যাক্রিডিটেশনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষের উচিত নয়। এর ফলে গণমাধ্যম সেন্সরশিপের ঝুঁকিতে পড়বে।
সাংবাদিক একেএম মকছুদ আহমেদ ভাই শুরুতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধীতা করেছেন এবং এখনো সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে তিনি রাজপথে দাঁড়ান। এছাড়া তিনি ২৯ সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন অন্তর্বর্তী তথ্য মন্ত্রণালয়ের বাতিল করার বিষয়ে একাধিকবার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
সাংবাদিকতার এই দীর্ঘ জীবনে একেএম মকছুদ আহমেদ ভাই অনেক সাংবাদিক এবং সাংবাদিক নেতা তৈরি করেছেন। রাঙামাটি তথা পার্বত্য চট্টগ্রামে ওনার পিছনে ঘুরে এবং তিনি হাত কলামে অনেকই সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেছেন তাদের অনেকে বর্তমান সময়ে বড় সাংবাদিক। ১৯৮৩ সালে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামকে তৎকালিন সরকার রাঙামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ি এই তিন পার্বত্য জেলায় ভাগ করে। বর্তমানে এই তিন পার্বত্য জেলায় অসংখ্য গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
একেএম মকছুদ আহমেদ ভাই শিক্ষকতা পেশার সাথে সাথে ১৯৬৯ সালের ১৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদী পত্রিকায় রাঙামাটি প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন। তিনি দৈনিক জনপথ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক নিউনেশন, বিবিসি-বাংলা, রয়টার এবং সংবাদ সংস্থা এপি-তেও দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন। তিনি ভয়েজ অব আমেরিকার বাংলাদেশ প্রতিনিধি গিয়াস কামাল চৌধুরীকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংবাদ পরিবেশন করে সহযোগিতা করেছেন। একেএম মকছুদ আহমেদ ভাই দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় রাঙামাটি জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সাংবাদিকতায় অসামান্য অবদান রাখায় একেএম মকছুদ আহমেদ ভাইকে দৈনিক আজাদী পত্রিকা ২০০৩ সালে ‘চারন’ সাংবাদিক হিসেবে সম্মাননা প্রদান করেন। বাংলাদেশে তাঁর আগে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দীনকে চারন সাংবাদিক হিসবে সম্মাননা জানানো হয়েছিল। এই দুই বিশিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া বাংলাদেশে চারণ সাংবাদিক হিসেবে আর কোন সংস্থা বা সংগঠন অন্য কাউকে চারন সাংবাদিক হিসেবে সম্মাননা দেয়নি।
সাংবাদিকতা করার এখন যে সহজ অনলাইন যোগাযোগ ও ডিজিটাল মাধ্যম রয়েছে এমন মাধ্যম তিনি পাননি। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সীমাহীন কষ্ট ও পরিশ্রম করে তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেছেন। শত প্রতিকুলতার পরেও তিনি সফল সাংবাদিক হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছেন। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ একেএম মকছুদ আহমেদকে সিএইচটি মিডিয়াসহ বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন থেকে অসংখ্য সম্মাননা প্রদান করেছেন।
আমাদের রাষ্ট্রীয় পরিধিতে সাংবাদিকতা চর্চায় স্বাধীনতার পরমপ্রতিশ্রুতি তাই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এক অন্তর্গত বাস্তবতা। অথচ সত্য হলো, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সাংবাদিকতা চর্চার ক্ষেত্র রাষ্ট্রের তরফ থেকে ক্রমাগত সংকুচিত করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর অধিকাংশ সংবাদপত্রের প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই বছরের ১৫ আগস্টে শেখ পরিবারকে নির্মম হত্যাকান্ডের পর দেড় দশক ধরে চলে সামরিক শাসন। সামরিক শাসনে যেখানে গণতন্ত্রই নেই, সেখানে মুক্ত সাংবাদিকতার প্রশ্নই বা ওঠে কোথায়! স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলের শেষ দিকে ছোট ছোট বিষদাঁতওয়ালা কিছু পত্রিকা তাঁকে নাস্তানাবুদ করে ফেলে। কোনো কারণ না দেখিয়ে পত্রিকার নিবন্ধন বাতিল করার একটি নিবর্তনমূলক আইন তিনি সেগুলোর ওপর অহরহ প্রয়োগ করেন। এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এর ৫৭ ধারা সাংবাদিকদের বাকস্বাধীনতা এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রনয়ন করে দেশের সাংবাদিকদের মুক্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করা হয়েছে।
বর্তমানে একেএম মকছুদ আহমেদ ভাই বয়সের ভারে কিছুটা দুর্বল হলেও মানসিক ভাবে তিনি এখনো চির তরুন। এখনো বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে থাকেন। একেএম মকছুদ আহমেদ সফলভাবে আরো দীর্ঘ সময় ধরে সাংবাদিকতা করবেন এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের এবং সিএইচটি মিডিয়া পরিবারের।
লেখক : নির্মল বড়ুয়া মিলন
মূখ্য সম্পাদক
সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম
তারিখ : ১২ নভেম্বর-২০২৪
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা।