

শনিবার ● ২২ মার্চ ২০২৫
প্রথম পাতা » খুলনা বিভাগ » সুন্দরবনে আগুন ২৩ বছরে ৩৪ বার
সুন্দরবনে আগুন ২৩ বছরে ৩৪ বার
শেখ সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট প্রতিনিধি: বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনপূর্ব সুন্দরবনের কলমতেজী এলাকায় আগুন লাগার বিষয়টি মানুষের নজরে এসেছে শনিবার (২২ মার্চ)সকালে কিন্তু বিকেল গড়িয়ে গেলেও তা নেভানোর কাজ শুরু করেনি ফায়ার সার্ভিস। সেখানে রয়েছে পানি সংকটও। তবে, সন্ধ্যা ৬টার দিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।আগামীকাল রোববার (২৩ মার্চ) শুরু হবে বলে জানিয়েছেন সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নূরুল করীম। আগুন যেন বনের ব্যাপক এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য আগুনের চারপাশে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ফায়ার লাইন কাটা শুরু করেছেন বনরক্ষীরা।সুন্দরবনে আগুন ২৩ বছরে ৩৪ বার সবগুলোই ঘটেছে পূর্ব সুন্দরবন এলাকায়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ৪টি ইউনিট এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের শরণখোলা স্টেশনের স্টেশন কর্মকর্তা আবতাদ ই আলম বলেন, শরণখোলা ও মোড়েলগঞ্জ ফায়ার স্টেশন ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। রামপাল ও কচুয়া থেকে আরও দুটি ইউনিটও ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে।
ধানসাগর এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য পান্না মিয়া বলেন, শনিবার সকালে সুন্দরবনের কলমতেজী টহল ফাঁড়ির টেপারবিল এলাকায় বনের মধ্যে আগুনের ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। বিষয়টি ধানসাগর স্টেশন কর্মকর্তাদের জানানো হয়।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নূরুল করীম বলেন, আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছেছি এবং ফায়ার লাইন কাটা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে ভোলা নদী ৩ কিলোমিটার দূরে থাকায় ফায়ার সার্ভিসের কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আশা করা যাচ্ছে, আগামীকাল (২৩ মার্চ) সকালেই ফায়ার সার্ভিস কাজ শুরু করতে পারবে।সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ডা. লায়ন ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের রেঞ্জের আশপাশে এলাকায় প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ কারণে এই শুষ্ক মৌসুমে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদেরও সতর্কতা বাড়াতে হবে।সুন্দরবনে ২৩ বছরে ৩৪ বার আগুন লেগে পুড়ে যায় প্রায় ৯০ একর বনভূমি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনে এবার আগুন জ্বলছে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের কলমতেজী ফরেস্ট টহল ফাঁড়ি এলাকায়। এর আগের আগুনটি ছিল ২০২১ সালের মে মাসে পূর্ব সুন্দরবনে দাসের ভারানির পাশের অঞ্চলে। সব মিলিয়ে ২০০২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ঘটা ২৪টি অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত করেছে পূর্ব বন বিভাগ।উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো হলো ২০০২ সালের ২২ মার্চ শরণখোলা রেঞ্জের কটকাতে। ওই ঘটনায় পুড়ে যায় প্রায় এক একর ছন বন। এরপর ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলি ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকায় পুড়ে যায় তিন একর বনভূমি। একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর আড়ুয়াবেড় এলাকায় পুড়ে যায় প্রায় ৯ শতক ছন বন। ২০০৫ সালের ৮ এপ্রিল ধানসাগর স্টেশনের অধীন কদলতেজী এলাকায় পুড়ে যায় প্রায় তিন একর বন। এ ঘটনার পাঁচ দিন পর একই এলাকার তুলাতলায় পুড়ে যায় ৪.৫ একর বনভূমি। এরপর ২০০৬ সালের ১৯ মার্চ শরণখোলা রেঞ্জের তেরাবেকা এলাকায় আগুন লাগে। এর কিছু দিন পর ১১ এপ্রিল চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়ায়ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
এর একদিন পর কলমতেজির টহলফাঁড়ির খুটাবাড়িয়া এলাকার দেড় একর, ১ মে নাংলির পঁচাকুড়ালিয়া এলাকার ৫০ শতক, তিন দিন পর ধানসাগর স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় ২.৫ একর বনভূমি। ২০০৭ সালে ৩ দফায় (১৫ জানুয়ারি, ১৯ মার্চ ও ২৮ মার্চ) একই এলাকার প্রায় ১৫ একর বনভূমি পুড়ে যায়। ২০১০ সালের ২০ মার্চ ধানসাগর স্টেশনের গুলিশাখালী এলাকায় প্রায় পাঁচ একর বন পুড়ে যায়। পরে ২০১১ সালের মার্চ মাসে দুই দফা বনে আগুন লাগে। এতে প্রায় সাড়ে তিন একর বন পুড়ে যায়। প্রায় ১০ একর বনভূমি পুড়ে যায় ২০১৪ সালের ২৫ মার্চের অগ্নিকাণ্ডে। ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলি ফরেস্ট ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকার আগুন লাগে। ১৩ এপ্রিল একই এলাকায় ফের আগুন লাগে। পুড়ে যায় ৮.৫ একর বন।
১৮ এপ্রিল আব্দুল্লাহর ছিলায় এবং ওই বছরের ২৭ এপ্রিল তুলতলার বিলে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালের ২৬ মে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ফরেস্ট ক্যাম্পের আওতাধীন মাদ্রাসার ছিলা এলাকায় আগুন লাগে। ২০২১ সালের গত ৮ ফেব্রুয়ারি পুড়েছে দানসাগর টহল ফাঁড়ি এলাকার প্রায় চার শতক বনভূমি।বন বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২৪টি আগুনের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৩ লাখ ৫৩৩ টাকা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অগ্নিকাণ্ডে প্রাণী-বৈচিত্র্য ও পরিবেশের ক্ষতি ধরা হয় আনুমানিক হিসাবে। ফলে এই হিসাবে যে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র আসেনি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ ছাড়া প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, অধিকাংশে আগুনের সূত্রপাতের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, জেলে-মৌয়ালদের অসাবধানতায় আগুন। অর্থাৎ জেলে-মৌয়ালদের বিড়ি-সিগারেট বা মৌমাছি তাড়াতে জ্বালানো মশাল থেকেই সবচেয়ে বেশি আগুনের সূত্রপাত হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা আগুন লাগার কারণ নিয়ে দ্বিমত আছে বনজীবীদের।
প্রতিটি আগুন লাগার ঘটনার পরে আগুনের কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ ও পরে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি নির্দিষ্ট সময়ে সুপারিশসহ রিপোর্টও পেশ করে। তবে সেসব রিপোর্টের প্রতিফলন বাস্তবে দেখা যায় না।
জানা গেছে, শুধু আগুনেই পুড়ছে না সুন্দরবন। বন্যপ্রাণী ও মৎস্য সম্পদই ধ্বংস করে চলছে প্রতিনিয়ত একশ্রেণির চক্র। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ‘স্মার্ট পেট্রোলিং’ আর জেলে-বনজীবীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে বাঘ, হরিণ হত্যাসহ বনের সম্পদ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। এই অবস্থার মধ্যে অক্সিজেনের অফুরন্ত ভাণ্ডার দেশের ফুসফুসখ্যাত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সুন্দরবন এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনে আয়তন ছিল বর্তমানের দ্বিগুণ। কমতে-কমতে বর্তমানে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন এখন দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। যা দেশের সংরক্ষিত বনভূমির সর্বমোট ৫১ ভাগ। ২৪ ঘণ্টায় দুবার সমুদ্রের জোয়ারের লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয় সুন্দরবন।
সংরক্ষিত এই বনের তিনটি এলাকাকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেসকো ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করে। বর্তমানে যা সমগ্র সুন্দরবনের ৫২ ভাগ এলাকা। এখানে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি রয়েছে। এ ছাড়া ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, লোনা পানির কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর, কিংকোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি রয়েছে।
সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের পাশাপাশি বিশ্বের বৃহত্তর জলাভূমিও। সুন্দরবনের জলভাগের পরিমাণ এক হাজার ৮৭৪ দশমিক এক বর্গ কিলোমিটার। যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ। ১৯৯২ সালে সমগ্র সুন্দরবনের এই জলভাগকে রামসার এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। এ ছাড়া সুন্দরবনের সমুদ্র এলাকার পরিমাণ এক হাজার ৬০৩ দশমিক দুই বর্গ কিলোমিটার।
এই জলভাগে ৪৫০টি ছোট-বড় নদী ও খালে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির ইরাবতীসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন, ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া, ৪৩ প্রজাতির মলাস্কা ও এক প্রজাতির লবস্টার।
ইতোমধ্যেই সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গেছে এক প্রজাতির বন্য মহিষ, দুই প্রজাতির হরিণ, দুই প্রজাতির গণ্ডার, এক প্রজাতির মিঠা পানির কুমির।
করোনাকালে গোটা সুন্দরবনে সর্বোচ্চ সতর্কতা ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করে পর্যটক, জেলে-বনজীবীদের বনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে বন অধিদফতর। এই নিষিদ্ধ সময়ের মধ্যেও হুমকিতে পড়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য।
সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনকে আগুন থেকে রক্ষা করার জন্য বনে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রোধে বনরক্ষীদের তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। অসাধু বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান তিনি।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মো. নুরুল কবির বলেন, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা বনজীবীদের বিড়ি সিগারেটের আগুনে অনেক সময় আগুন লাগে। এ জন্য আমরা বনজীবী ও স্থানীয়দের সচেতন করেছি। সচেতনতামূলক কার্যক্রম এখনও অব্যাহত রয়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশ মতে ওয়াচ টাওয়ার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাঘ, হরিণ হত্যার পাশাপাশি খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার ও আগুন দস্যুদের হাত থেকে সুন্দরবন রক্ষায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট পেট্রোলিংসহ সব ধরনের পাহারা জোরদার করা হয়েছে।সুন্দরবনের কলমতেজী ফরেস্ট টহল ফাঁড়ির আওতাধীন টেপারবিল এলাকায় ধোঁয়া উড়তে দেখেন এলাকাবাসী। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান বনরক্ষীরা। তবে বনের খাল থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে আগুন লাগায় পানির উৎসের অভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে। আগুন যেন বনের ব্যাপক এলাকাজুড়ে ছড়াতে না পারে সেজন্য আগুনের চারপাশে ফায়ারলাইন কাটা শুরু করেন বনরক্ষীরা। খালে জোয়ার হলে নৌপথে পানির পাম্প নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীলরা।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশন কর্মকর্তা ফরেস্টার বিপুলেশ্বর দাস জানান, বনের খাল থেকে প্রায় দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে গহীন বনের মধ্যে আগুন জ্বলছে। আশেপাশে পানির কোনো উৎস নেই। খালে জোয়ার হলে নৌপথে পানির পাম্প নেয়া হবে।
ধানসাগর এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য পান্না মিয়া, স্থানীয় ফজলুর রহমান বলেন, সকালে সুন্দরবনের কলমতেজী টহল ফাঁড়ির টেপারবিল এলাকার বনের মধ্যে আগুনের ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। বিষয়টি ধানসাগর স্টেশন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগ বাগেরহাটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নূরুল করীম বলেন, সুন্দরবনে আগুন লাগার বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।