শিরোনাম:
●   পার্বতীপুর রেলওয়ে ইর্য়াডের আম গাছে যুবকের আত্মহত্যা ●   রংধনু ক্লাবের কার্যকরী পরিষদ গঠিত ●   কাউখালী তাহেরিয়া রশিদা সুন্নিয়া দাখিল মাদরাসার সভা ●   পাকুন্দিয়ায় ইয়ুথ পিস অ্যাম্বাসেডর গ্রুপ গঠিত ●   বৈরী আবহাওয়ায় ও শীতের তীব্রতায় বাড়ছে কৃষকের দুশ্চিন্তা ●   কোন হটকারিতায় গণঅভ্যুত্থানের অর্জন নষ্ট করা যাবেনা ●   তরফভাইখাঁ সমাজকল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ ●   মিরসরাইয়ে শীতার্তের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ ●   ঈশ্বরগঞ্জে জিয়াউর রহমান স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধন ●   লংগদু এস এস সি পরীক্ষার্থীদের শিক্ষা সামগ্রী বিতরন ●   ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৫ এর মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন সম্ভব ●   হালদা থেকে বিপন্ন গাঙ্গেয় প্রজাতির মৃত ডলফিন উদ্ধার ●   খাগড়াছড়ির আলুটিলায় পর্যটকবাহী বাস উল্টে আহত-২০ ●   পানছড়িতে লোগাং জোন এর অনুদান সামগ্রী প্রদান ●   আত্রাইয়ে কুলি-বেদে সম্প্রদায়ের মাঝে জেলা প্রশাসকের কম্বল বিতরণ ●   চুয়েটে স্থাপত্য বিভাগের ১ম জাতীয় কনফারেন্স শুরু ●   বিজিবির অভিযানে খাগড়াছড়িতে ১২ অনুপ্রবেশকারী আটক ●   ঈশ্বরগঞ্জে জাতীয় প্রবাসী দিবস পালিত ●   কুষ্টিয়ায় বালুঘাট দখল নিতে তাণ্ডব চালিয়েছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ●   রাউজানে বিকাশ প্রতারকের ফাঁদে নারী উদ্যোক্তা তানিয়া ●   যোবায়ের-সাদপন্থীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্র ইজতেমা মাঠ : নিহত ৩ ●   মিরসরাইয়ে মধ্য তালবাড়ীয়া স্পোর্টিং ক্লাবের কমিটি গঠন ●   জিয়া কিংবা শেখ মুজিব নয়; জনগণই মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়ক : টিপু ●   নবীগঞ্জে ট্রাকের ধাক্কায় কলেজ ছাত্রের প্রাণহানি ●   জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এর নেতৃত্বে থাকবেন ড. ইউনূস ও আলী রীয়াজ ●   রেডব্রিজ কমিউনিটি ট্রাস্ট ইউকে বিজয় দিবস উদযাপন ●   ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাবের নির্বাচন : সভাপতি আউয়াল, সম্পাদক আতাউর ●   কাউখালীতে মহান বিজয় দিবস উদযাপন ●   দীপংকর তালুকদার এর অবৈধ সম্পদের তদন্তে নেমেছে দুদক ●   ঈশ্বরগঞ্জে বিজয় দিবস পালিত
রাঙামাটি, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১



CHT Media24.com অবসান হোক বৈষম্যের
শুক্রবার ● ৯ অক্টোবর ২০১৫
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » শিক্ষকদের মান অপমান
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » শিক্ষকদের মান অপমান
শুক্রবার ● ৯ অক্টোবর ২০১৫
Decrease Font Size Increase Font Size Email this Article Print Friendly Version

শিক্ষকদের মান অপমান

---

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল :: ১. এই দেশের শিক্ষকদের জন্য এখন খুবই একটা খারাপ সময় যাচ্ছে। স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকই এখন কোনো না কোনো আন্দোলনে আছেন। যেহেতু আন্দোলন শব্দটা এখন মোটামুটি একটা অশালীন শব্দ, তাই এই দেশের প্রায় সব শিক্ষক এখন দেশের মানুষের কাছে রীতিমতো একটা অপরাধী গোষ্ঠী। শিক্ষকদের জন্য যেহেতু এই দেশে কোনো সম্মানবোধ নেই তাই তারা কেন আন্দোলন করছেন বিষয়টি কেউ খুটিয়ে দেখেছেন কিনা সেটা নিয়েও আমার সন্দেহ আছে। ছাত্রলীগের কর্মী এখন অবলীলায় তাদের শিক্ষকের গায়ে হাত তুলতে পারে, একজন সাংসদ প্রকাশ্যে চাবুক মারার ঘোষণা দিতে পারেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের বেতনভাতা নিয়ে খোঁটা দিতে পারেন কেউ কিছু মনে করেন না।

আমাদের দেশের কিছু পত্র-পত্রিকা বিষয়গুলো এমনভাবে উপস্থাপন করে যে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে পুরো বিষয়টি এক ধরনের আমোদ বলে মনে হতে পারে। আমি একজন শিক্ষক, তাই খুব সঙ্কোচের সঙ্গে শিক্ষকদের জীবন নিয়ে একটি দুটি কথা বলতে বসেছি। শিক্ষকরাও যে মনুষ্য জাতীয় প্রাণী, তাদেরও যে ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকতে পারে, পরিবার সন্তান থাকতে পারে এবং তারাও যে দেশের মানুষের কাছে একটুখানি সম্মান চাইতে পারেন বিষয়টি জেনে কেউ যদি অবাক হয়ে যান তাহলে তার জন্য অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, কিন্তু যখনই কোনো শিক্ষক নিয়ে কথা বলতে চাই তখনই কেন জানি আবার প্রথম প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের কথা মনে পড়ে। দেশের মানুষ কি জানে এই দেশে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকরা হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী? নুতন বেতন কাঠামোতে তারা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা কমরছিলাম, কিন্তু তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

আমি এরকম একটি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাকে চিনি যিনি তার স্কুলে পৌঁছে প্রথমেই একটা ঝাড়ু এবং এক বালতি পানি নিয়ে স্কুলের টয়লেটে ঢুকে সেটা পরিষ্কার করতেন। আমি যতদূর জানি ইদানীং স্কুলে স্কুলে একজন করে কর্মচারী দেওয়া হয়েছে, আগে স্কুল চালাতেন শুধু শিক্ষকরা, টয়লেট পরিষ্কার থেকে স্কুলের ঘণ্টা বাজানো সবকিছুই করতে হতো শিক্ষকদের। স্কুলে শিক্ষকের সংখ্যা কম, ক্লাসঘরও কম। দুই ব্যাচে পড়াতে হয়, তাই সেই কাক ভোর থেকে একেবারে বেলা পড়ে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের কোনো অবসর নেই। তারা যদি ক্লাসে পড়াতে পারেন তাহলে তারা নিজেদের রীতিমতো সৌভাগ্যবান মনে করেন, কারণ বেশির ভাগ সময়েই তারা ক্লাসে পড়ানোর সুযোগ পান না! এই দেশের যত ‘ফালতু’ কাজ সবকিছু এই শিক্ষকদের দিয়ে করিয়ে নেওয়া হয়। গ্রামের সেনিটারি ল্যাট্রিন গোনা থেকে ভোটার তালিকা তৈরি করা এমন কোনো কাজ নেই যা তাদের করতে হয় না। এই দেশে সম্ভবত প্রায় আশি হাজার প্রাইমারি স্কুল আছে-এই স্কুলের শিক্ষকদের থেকে অসহায় কোনো গোষ্ঠী এই দেশে আছে বলে আমার জানা নেই। তাই আমি যখনই শিক্ষকদের নিয়ে কিছু বলতে চাই তখনই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের কথা একটিবার হলেও স্মরণ করে নিই।

২.
আমার ধারণা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকেরই গত কয়েক দিন থেকে খুব মন খারাপ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের মর্যাদার জন্য আন্দোলন করছেন, আন্দোলনটি যেহেতু শুধু হয়েছে বেতনের স্কেল ঘোষণার পর তাই সবারই ধারণা আন্দোলনটি বুঝি টাকা-পয়সার জন্য! আমি জানি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টাকা-পয়সা খুব বেশি নেই, (আমার মনে আছে একজন লেকচারারের বেতন কত সেটি উল্লেখ করে একবার খবরের কাগজে একটা লেখা ছাপানোর পর আমার একজন তরুণ সহকর্মীর বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল!) সত্য মিথ্যা জানি না, শুনেছি আমরা মাসে যত টাকা বেতন পাই একজন সচিব নাকি তার গাড়ির তেলের জন্য তার থেকে বেশি টাকা পান! বেতনের বাইরে একজন শিক্ষক কী পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা পান সেই কথাটি লিখলে আমার আরও তরুণ সহকর্মীদের বিয়ে ভেঙে যেতে পারে। তবে একবার একজন সচিবের গাড়িতে ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সচিব মহোদয় যেন দ্রুত নিরাপদে যেতে পারেন সেজন্য যে প্রক্রিয়ায় ট্রাফিক থামিয়ে তাকে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল সেটি চমকপ্রদ! এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আমার এক ধরনের বিস্ময় আছে, কিন্তু কোনো অভিযোগ নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কয়েক দিন থেকে মন খারাপ, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষকদের নিয়ে কিছু খোলামেলা কথার কারণে। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি কানাকে ‘কানা বলিও না, ঘোড়াকে ঘোড়া বলিও না’, সেই হিসেবে এই কথাটিও নিশ্চয়ই সত্যি, যারা টাকা-পয়সা নিয়ে এক ধরনের টানাটানির মাঝে থাকেন তাদেরকে টাকা-পয়সা নিয়ে খোঁটা দিলে তারা কানা এবং ঘোড়ার মতোই অসম্মানিত বোধ করেন।

এই দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে আমরা এখন মোটামুটিভাবে অনুমান করতে পারি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন কত হওয়া উচিত! গত সিমেস্টারে আমাকে পাঁচটি কোর্স নিতে হয়েছে (না, এটি মুদ্রণ প্রমাদ নয়, সংখ্যাটি সঠিক, পাঁচ), আমার পরিচিত একজন একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে মাত্র একটি কোর্স নেওয়ার জন্য প্রতিমাসে আমার বেতন থেকে বেশি টাকা পায়! কাজেই কোন কাজের জন্য কত টাকা বেতন হওয়া উচিত সেটি কখনও সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না, আমি শুধুমাত্র বিনয়সহকারে সবাইকে বলার চেষ্টা করতে পারি, আমাদের যত টাকা বেতন দেওয়া হয় আমরা সেই বেতন পাওয়ার যোগ্য নই-আমাদের আরও কম টাকা বেতন দিয়ে আমাদের একটা শিক্ষা দেওয়া উচিত ছিল কথাটি আমাদের জন্য সম্মানযোগ্য নয়।

নতুন বেতন স্কেল দেওয়ার পর সাংবাদিকরা মাঝে মাঝেই এ ব্যাপারে আমার মন্তব্য জানতে চেয়েছে, আমাকে বাধ্য হয়ে তখন বেতন স্কেলটি খুঁজে বের করে সেটি দেখতে হয়েছে। বেতনের টাকার পরিমাণ নয়, বিভিন্ন পদের মানুষ কে কোথায় অবস্থান করছে সেটি দেখে আমি আঁেক উঠেছি। ‘পদমর্যাদা’ বলে একটি বিচিত্র শব্দ আছে।

বাংলাদেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের অত্যন্ত ক্ষমতাশালী একজন সচিব আছেন। কোনো একটি সভায় কোনো একটি বিষয় ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি আমাকে বলেছিলেন ধর্ষিত হতে যাচ্ছে এরকম একটি মেয়ে যদি আবিষ্কার করে তার বাঁচার কোনো উপায় নেই, তাহলে তার জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে ধর্ষণটি উপভোগ করার চেষ্টা করা। (এটি এই সচিবের নিজের উক্তি নয়, ক্লেটন উইলিয়াম নামে এক আমেরিকান রাজনীতিবিদের উক্তি)। পদমর্যাদায় এই সচিব নিশ্চয়ই প্রফেসরদের থেকে ওপরে, কাজেই আমি জানার চেষ্টা করছি কোনো একটি সভায় যদি এই সচিব এসে উপস্থিত হন তাহলে কি আমাকে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে একটা স্যালুট দিতে হবে? এই দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে আমার নাম আছে, এতদিন এই দেশের কালচারে একে অন্যকে সম্মান দেখানোর যে বিষয়টি আছে আমি সেভাবেই চালিয়ে এসেছি। ‘পদমর্যাদা’ নামে এই বিষয়টি আবিষ্কার করার পর এখন আমি খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। তাহলে কি সভায় একজন একজন করে ঢোকার পর আমাকে কি কখনও কখনও উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট করতে হবে? বিষয়টি কে আমাকে বুঝিয়ে দেবে? এই ধরনের সকল সভা থেকে একশ’ হাত দূরে থাকা সম্ভবত আমাদের জন্য একমাত্র সম্মানজনক সমাধান।

আমি যদি ঠিকভাবে বুঝে থাকি, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই আন্দোলনটি বেতনের টাকা বাড়ানোর জন্য আন্দোলন নয়, পদমর্যাদা নামক বিভাজন প্রক্রিয়া থেকে উদ্ধার পাওয়ার আন্দোলন, সময়ে অসময়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দেওয়ার বিড়ম্বনা থেকে উদ্ধার পাওয়ার আন্দোলন!

পদমর্যাদা শব্দটি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। আমরা সবাই যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কারণে শেরপুরের সোহাগপুরে তৈরি বিধবাপল্লীর নাম শুনেছি। বেশ কয়েক বছর আগে বেগম মতিয়া চৌধুরী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিধবাপল্লী এলাকায় একটা কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমি দেশের বাইরে ছিলাম, দেশে ফিরেই খুবই আনন্দের সঙ্গে সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। রওনা দেওয়ার পর আবিষ্কার করলাম এটি অনেক বড় অনুষ্ঠান, সেখানে শুধু যে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী আছেন তা নয়, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও আছেন। এত গুরুত্বপূর্ণ দু’জন মন্ত্রী একসঙ্গে, বলা যেতে পারে সেই এলাকায় রীতিমতো আলোড়ন তৈরি হয়ে গেল। কোনো একটা অনুষ্ঠানে সবাই মিলে স্টেজে উঠবে, এই বড় বড় দু’জন মন্ত্রীর সঙ্গে আমিও আছি। স্থানীয় নেতা-কর্মীর ভিড়, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ, সবকিছু মিলিয়ে আমি একটু জবুথবু অবস্থায় পড়ে গেলাম।

হঠাৎ শুনতে পেলাম কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী উপস্থিত সবাইকে বিশাল একটা ধমক দিয়ে আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘এই যে, ইনি একজন শিক্ষক। উনাকে সবার আগে যেতে দাও। আমরা সবাই তার পেছনে যাব।’

অবিশ্বাস্য ব্যাপার, আমাকে সবার সামনে নিয়ে আসা হল। আমি বিব্রতভাবে হেঁটে যাচ্ছি, দুই দু’জন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী আমার পেছনে পেছনে হেঁটে যাচ্ছেন। সারা জীবনই ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে সম্মান এবং ভালোবাসা পেয়ে এসেছি, কিন্তু দু’জন এত বড় বড় মন্ত্রী একজন শিক্ষককে এভাবে সম্মান দেখাবেন সেটি আমি কল্পনা করিনি। শিক্ষকদের কত জায়গায় কতভাবে অসম্মান করা হয়েছে, কিন্তু এই ঘটনাটির কথা মনে করে জীবনের অনেক দুঃখ এবং ক্ষোভের কথা আমি ভুলে যেতে পারি।

৩.
শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো শেষ নেই, দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, এই অভিযোগগুলোর বেশির ভাগই সত্যি। তারপরও একটা দুঃখ হয়, যখন দেখি কিছু শিক্ষকের জন্য ঢালাওভাবে সব শিক্ষককে অবমাননা সইতে হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেদের ছাত্র-ছাত্রীদের না পড়িয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়ে টাকা উপার্জন করতে ব্যস্ত থাকেন, এই অভিযোগটি সব সময়েই শোনা যায়। কিন্তু কেউ কখনও একটা বিষয় লক্ষ করেন না, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য বিভাগ হয়েছে, তার মাঝে শুধু হাতে গোনা দুয়েকটি বিভাগের শিক্ষকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়াতে পারেন। এই দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছেই মাত্র অল্প কয়েকটি বিভাগ, অথচ অপবাদটি ঢালাওভাবে সব বিভাগের সব শিক্ষকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়।

আমি মোটেও অস্বীকার করব না, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকেরই অনেক বড় ধরনের সমস্যা আছে। কিন্তু তারপরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে এই দেশের অনেক বড় সম্পদ। একটা সময় ছিল যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে থাকত, কিন্তু এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভবিষ্যত্ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এখন স্থানীয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলা হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, যখন একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থানীয় রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে তখন তার মৃত্যুঘণ্টা বেজে যায়। একটা বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তুলতে অনেক দিন লাগে, কিন্তু সেটাকে ধ্বংস করতে খুব বেশি সময় লাগে না।

শুরুতেই বলেছি, শিক্ষকদের এখন খুব খারাপ একটা সময় যাচ্ছে! অথচ এরকমটি হওয়ার কথা ছিল না। এই দেশের প্রায় চার কোটি ছাত্র-ছাত্রী, পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের মোট জনসংখ্যাই হচ্ছে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ লাখ। যদি আমাদের সব ছাত্র-ছাত্রীকে ঠিক করে লেখাপড়া করানো যেত তাহলে দেশটা চোখের সামনে একটা স্বপ্নের দেশ হয়ে যেত! লেখাপড়া করানোর জন্য জিডিপির ছয় শতাংশ খরচ করার কথা, অথচ সেই অংশটুকু কমতে কমতে দুই শতাংশের কাছাকাছি নেমে এসেছে। যদি সত্যি সত্যি এই দেশের সব ছেলেমেয়েকে ঠিকভাবে লেখাপড়া করানো হতো তাহলে সবচেয়ে আনন্দে কে থাকত? এই দেশের শিক্ষকরা। আমাদের শিক্ষকদের যথেষ্ট অসম্মান করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, শিক্ষক এবং আমলাদের একেবারে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই দেশের একজন শিক্ষক হিসেবে আমাদের মন খারাপ করার যথেষ্ট কারণ আছে।

কিন্তু যখন একটুকরো চক হাতে নিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আমি ছাত্র-ছাত্রীদের মুখের দিকে তাকাই তখন আমার সমস্ত মন খারাপ দূর হয়ে যায়। যখন ছাত্র-ছাত্রীরা এসে বলে তাদের তৈরি রোবট সারাদেশে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এসেছে তখন আনন্দে আমার বুকটি ভরে যায়। যখন দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ টেলিফোন করে আমাদের ছাত্রদের তৈরি ড্রোনটি দেশের সত্যিকার কাজে ব্যবহার করার জন্য আগ্রহ দেখায় তখন আমার বুকটি একশ’ হাত ফুলে যায়। যখন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় ছাত্র-ছাত্রীরা সারাদেশের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হয়ে ফিরে আসে আমার মনে হয় এই পৃথিবীতে আমার চেয়ে সুখী কে আছে? যখন কয়েকজন ছেলেমেয়ে এসে বলে তাদের একটি গবেষণা পেপার জার্নালে ছাপার জন্য মনোনীত হয়েছে তখন আমার মনে হয় বেঁচে থাকার মতো এত আনন্দ আর কোথায় আছে? চারপাশে সবাই মিলে আমাদের মন খারাপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা শিক্ষক, যতদিন আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা আমাদের সঙ্গে আছে, কার সাধ্যি আছে আমাদের মন খারাপ করিয়ে দেবে?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : শিক্ষাবিদ, লেখক

আপলোড : ৯ অক্টোবর ২০১৫ : বাংলাদেশ : সময় : দুপুর ২. ৫৬ মিঃ





উপ সম্পাদকীয় এর আরও খবর

পার্বত্য চুক্তির ২৭ বছর : শান্তি চুক্তি পাহাড়ে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ পার্বত্য চুক্তির ২৭ বছর : শান্তি চুক্তি পাহাড়ে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ
একেএম মকছুদ আহমেদ এর সাংবাদিকতায় ৫৫ বছর :  গণমাধ্যমের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ, হামলা ও হুমকি বৈষম্যবিরোধী চেতনার পরিপন্থি একেএম মকছুদ আহমেদ এর সাংবাদিকতায় ৫৫ বছর : গণমাধ্যমের ওপর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আক্রমণ, হামলা ও হুমকি বৈষম্যবিরোধী চেতনার পরিপন্থি
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মৌলভীবাজারের পাঁচগাঁওয়ের দূর্গাপূজা ও কিছু কথা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মৌলভীবাজারের পাঁচগাঁওয়ের দূর্গাপূজা ও কিছু কথা
পার্বত্য চুক্তির ২৬ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ কি-কি বৈষম্যের স্বীকার তা নিয়ে একটি পর্যালোচনা পার্বত্য চুক্তির ২৬ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ কি-কি বৈষম্যের স্বীকার তা নিয়ে একটি পর্যালোচনা
আন্তর্বর্তীকালিন সরকার পাহাড়ের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিলে নিতে হবে গভীর বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে আন্তর্বর্তীকালিন সরকার পাহাড়ের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিলে নিতে হবে গভীর বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে
সবকিছু কেড়ে নিয়েছে স্বৈরাচারী খুনি হাসিনার আওয়ামীলীগ সবকিছু কেড়ে নিয়েছে স্বৈরাচারী খুনি হাসিনার আওয়ামীলীগ
রাঙামাটিতে ঐক্যবদ্ধ বড়ুয়া সমাজ গড়ে তোলার সম্ভবনার পথ দেখা দিয়েছে রাঙামাটিতে ঐক্যবদ্ধ বড়ুয়া সমাজ গড়ে তোলার সম্ভবনার পথ দেখা দিয়েছে
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ১৯০০ সালের রেগুলেশান, (সংশোধিত) ১৯২০ আইনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরিপন্থি নয় কি ? বর্তমান প্রেক্ষাপটে ১৯০০ সালের রেগুলেশান, (সংশোধিত) ১৯২০ আইনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরিপন্থি নয় কি ?
আগামীতে  কারা দেশ চালাবে ? …সাইফুল হক আগামীতে কারা দেশ চালাবে ? …সাইফুল হক
সীমান্ত সড়ক পশ্চাদপদ পার্বত্য অঞ্চলকে উন্নয়নের স্রোতধারায় একীভূত করেছে সীমান্ত সড়ক পশ্চাদপদ পার্বত্য অঞ্চলকে উন্নয়নের স্রোতধারায় একীভূত করেছে

আর্কাইভ

পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)