বৃহস্পতিবার ● ১২ মে ২০১৬
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » আল-কুরআন ও বিজ্ঞান
আল-কুরআন ও বিজ্ঞান
লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল :: আল-কুরআন মহান আল্লাহ্ তা’আলার বাণী৷ মানব জাতির হিদায়াতের জন্য আল্লাহর নিকট থেকে অবতীর্ণ আসমানী গ্রন্থসমূহের মধ্যে আল-কুরআন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ৷ কুরআনের পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের সারবস্তু এবং পৃথিবীর সকল জ্ঞান-বিজ্ঞান তার মধ্যে সনি্নবিষ্ট আছে বলেই তাকে কুরআন বলা হয়৷ কুরআনের অপর একটি নাম আল-হাকীম অর্থাত্ জ্ঞান ভান্ডার৷ মানুষের প্রয়োজনীয় এমন কোন বিষয় নেই, যা এই কুরআনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি৷ আল্লাহ তা’আলা স্বয়ং আল-কুরআনকে ৫৫টি নামে পরিচিহ্নিত করেছেন৷ প্রত্যেকটি নামের মধ্যেই এই কিতাবের গুণাবলী, অনন্যতা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা তুলে ধরা হয়েছে৷ উল্লেখিত এসব নামের মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন মাজীদকে হাকিম(বিজ্ঞানময় বা জ্ঞানভান্ডার)
ফোরকান (সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী), আয্যিকর (উপদেশ) আন্নূর (জ্যোতি) প্রভৃতি নামে সম্বোধন করেছেন৷ এক কথায়, আল-কুরআন হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ মানবজাতির হিদায়াতের মহাগ্রন্থ৷বিজ্ঞান যেহেতু মানবীর তত্পরতা ও মানবজাতির অগ্রগতির জন্য আল্লাহ্ তা’আলা প্রদত্ত একটি বিশেষ জ্ঞান, তাই কুরআনের প্রায় সর্বত্রই জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সৃষ্টিতত্ত্ব, প্রকৃতি পরিবর্তন, বিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা রয়েছে৷ অথচ অজ্ঞতার কারণে অনেকেই বিজ্ঞানকে ধর্মীয় বিষয়ের অঙ্গীভূত বলে মনে করতে চান না৷ বিজ্ঞানের যতই উত্কর্য সাধিত হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার পরিচয় ও তাঁর সৃষ্টি রহস্যের সূক্ষাতিসূক্ষ বিন্যাস ও কৌশলের সাথে পরিচিত হয়ে মানুষ ততই আল্লাহর দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে৷
বর্তমান সময়কে বলা হয় বিজ্ঞানের উত্কযের্র যুগ৷ বিজ্ঞানকে জানা মানে আল্লাহ্ ও তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে জানা, আল্লাহ্ সৃষ্টি রহস্যের সাথে পরিচিত হওয়া, আল্লাহ্ দেয়া বিশেষ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব প্রকৃতি ও মানবতার কল্যাণ সাধন করা৷ এ যুগের তরুণ প্রজন্ম বিজ্ঞান প্রযুক্তির আবহে বেড়ে উঠছে, ফলে তরুণ প্রজন্মকে অবশ্যই জানতে হবে যে, মহাগ্রন্থ আল-কুরআন হচ্ছে আল্লাহ্র নিয়ামত, দিক-নির্দেশনা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক অনন্ত ভান্ডার, তাহলে তারাই সর্বাগ্রে আঁকড়ে ধরবে এই পবিত্র কুরআনকে এবং এর আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে তাদের মেধা ও মনন৷ অন্যথায় তারা হবে বিভ্রান্ত৷ পবিত্র কুরআনের মোট আয়াত সংখ্যার মধ্যে প্রায় এক-অষ্টমাংশই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে নিবেদিত হয়েছে৷ কুরআন আক্ষরিক অর্থে কোন বিজ্ঞান গ্রন্থ নয়, কাজেই বিজ্ঞানের সকল নীতিই এর মধ্যে হুবহু সনি্নবিষ্ট পাওয়া যাবে এমন আশা করা যেতে পারে না৷ তবে প্রকৃত ঘটনা ও বিজ্ঞানের সূত্র নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে কুরআনের নিজস্ব ভঙ্গিমা রয়েছে৷ এটি বৈজ্ঞানিক সূত্রসমূহের মূল প্রতিপাদ্য তুলে ধরে এবং বেশ কিছু ঘটনা বা সত্য সম্পর্কে ইঙ্গিত ধর্মী বক্তব্য প্রদান করে৷ যাতে থাকে সর্বোচ্চ সংখ্যক সূত্রসমূহ সম্পর্কে পরিষ্কার ইঙ্গিত৷ কুরআনের একটা বক্তব্য কোন একটা নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক বিষয়ে ব্যাপক কথা তুলে ধরে৷
একটি দৃষ্টান্ত বিষয় স্পষ্ট করে তুলতে পারে৷ আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেন “আমি কোন কিছুই অযথা সৃষ্টি করি নাই”৷ এই যে ঘোষণা, প্রকৃতপক্ষে এটি একজন আধুনিক পরিবেশ বিজ্ঞানীর সর্বপ্রথম মৌলিক বিশ্বাসের বিষয়বস্তু, যিনি উপলব্ধি করেন এই মাহবিশ্বের একটা সূক্ষ ব্যবস্থাপনা রয়েছে যাতে আমাদের বিঘ্ন সৃষ্টি করা উচিত নয়৷
পৃথিবীতে প্রায় ৩ কোটি প্রকারের জীবদেহ রয়েছে৷ এ পর্যন্ত মাত্র ৫০ লক্ষের উপর গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে৷ এ সকল জীবদেহের অনেকগুলোরই কার্যগত উপযোগিতা কী তা আমরা জানি না৷ অবশ্য অনেক সময়ই দেখা গেছে, এ সকল জীবদেহের জীবনধারায় মানুষ বিঘ্ন সৃষ্টি করে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ এমনকি আমরা যদি নাও জানি কোন বিশেষ প্রজাতির জীবদেহের কাজ কী, তবুও এটি যাতে টিকে থাকতে পারে সেদিকে আমাদের সর্বাধিক দৃষ্টি রাখতে হবে৷ কারণ এই প্রজাতি বিলুপ্ত বা উচ্ছেদ হলে তা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে৷ ফলে দেখা যায় যে, পরিবেশ বা বাস্তুসংস্থান বিজ্ঞানের পরিপূর্ণ ভিত্তি কুরআনের এই ঘোষণা ব্যতীত আর কিছু নয় যে, কোন কিছুই অযথা সৃষ্টি করা হয়নি৷ পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে যে, “তিনিই সেই সত্তা যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে বিন্যাস করেছেন সঠিক অনুপাতে”৷ সূরা “আল-মু’মিনূন”-এ ভ্রুণ স্তর থেকে ধাপে ধাপে মানব শিশু কিভাবে বেড়ে পূর্ণাঙ্গ মানবে পরিণত হয় তার উল্লেখ রয়েছে৷ এ সকল ধাপের কথা আল-কুরআনে বলা হয়েছে ৭ম খ্রিষ্টাব্দে যখন ভ্রুণতত্ত্ব বিজ্ঞানের উদ্ভাবনই ঘটেনি৷ ভ্রুণতত্ত্ব বিজ্ঞানের শাখা গড়ে উঠেছে মাত্র ১০০ বছর হয়েছে৷ পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত মানব ভ্রুণের ধাপে ধাপে বৃদ্ধির বিষয়টি মাত্র সমপ্রতি আবিষকৃত হয়েছে৷ আল্লাহ্ মানুষকে তাঁর সৃষ্টি এবং এর উন্নয়ন সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে বলেছেন, যেন মানুষ জীববিদ্যার গভীরে প্রবেশ করতে পারে এবং জীবনের রহস্য উন্মোচন করতে পারে৷ আমরা যাকে সৃষ্টিজগত্ বলে থাকি, তা আল্লাহরই এক প্রকার স্মারকচিহ্ন বা নিদর্শন৷ বিজ্ঞান মানুষকে এই স্মারকচিহ্নই বুঝতে সাহায্য করে৷ সাধারণভাবে জ্ঞান এবং বিশেষভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অবশ্যই ধমের্র সাথে সাথেই চর্চা করতে হবে৷ বস্তুত কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী বিজ্ঞান অন্যান্য মানবিক কর্মতত্পরতার মতই ধমের্র অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷ যেখানে বিজ্ঞান আমাদেরকে শিক্ষা দেয় কীভাবে প্রকৃতি কাজ করে এবং এই শিক্ষা আমাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য উত্পন্ন দ্রব্য ও প্রক্রিয়া কাজে লাগাতে সক্ষম করে৷ তেমনি ধর্ম আমাদেরকে শিক্ষা দেয় সেই সকল মূল্যবোধ যা আল্লাহ্ আমাদেরকে চর্চা করতে বলেন যাতে জীবনের মূল্যবোধ ও উপযোগিতার দিকগুলো সুসমন্বিতভাবে সংমিশ্রণ ঘটানো যায়৷ কাজেই বলা যায় যে, বিজ্ঞান ও ধর্ম উভয়ই প্রয়োজন৷ বিজ্ঞান বস্তুগত জ্ঞান দান করে, ধর্ম সেই জ্ঞানকে ব্যবহারের মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়৷ ধর্ম মানুষকে আহ্বান জানায় সৃষ্টিজগত্ ও স্রষ্ট্রা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে৷ বিজ্ঞান সৃষ্টিকে বুঝার মত জ্ঞান দান করে এবং সৃষ্টিই স্রষ্টার নিদর্শন হিসেবে কাজ করে৷ বিজ্ঞান ও ধমের্র মধ্যে সত্যিকার অর্থে কোন বিরোধ নেই৷ মূলতঃ আল-কুরআন ও বিজ্ঞানের মধ্যেও কোন বিরোধ নেই৷ তবে পবিত্র কুরআন আল্লাহ্ বাণী, অপরিবর্তনশীল ও সংরক্ষিত৷ আর মানুষের গবেষণা ও অক্লান্ত অনুশীলনের ফলে গড়ে উঠেছে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল৷ বিজ্ঞানসহ মানবজীবনের সকল কর্মতত্পরতাই আল-কুরআনের আওতাভুক্ত৷
লেখক : লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল
শিক্ষক, কলামলেখক, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক