রবিবার ● ২৯ মে ২০১৬
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে শিক্ষার বিকল্প নেই
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে শিক্ষার বিকল্প নেই
লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল :: ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘সকল প্রসূতির জন্য মানসম্মত সেবা আমাদের অঙ্গীকার’। নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস ২০১৬ উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছে রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে বলেছেন সুস্থ্য জাতি গড়তে গর্ভবতী মা ও নবজাতকের পরিচর্যা খুবই জরুরী। দিবসটি পালনের মাধ্যমে মাতৃস্বাস্থ্য সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাণীতে দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্যকে খুবই সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ অভিহিত করে বলেন, ‘এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখ জীবিত জন্মে ৭০ বা তার নীচে নামিয়ে আনতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সরকারের গৃহীত বিভিন্ন বাস্তবমুখী কর্মসূচীর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌছতে পারবো।’ জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রতিক্ষণ প্রতিষ্ঠান- নিপোট প্রকাশিত বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও জনমিতি জরীপ- ২০১৪ এর প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশে সন্তান প্রসবের আগে চিকিৎসকসহ অন্যান্য প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে নারীদের পরামর্শ নিতে যাওয়ার হার বেড়েছে। ২০১১ সালে এই হার ছিল ৪৩ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা বেড়ে ৫৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গর্ভবতী মায়েদের ৪ বার করে গর্ভকালীন সেবা গ্রহণের হার ৩ বছরে ১৭ শতাংশ থেকে উন্নীত হয়ে ৩১ শতাংশ হয়েছে। ধনী ও দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে সন্তান প্রসবের আগে সেবা নেয়ার যে বৈষম্য তা ৫৭ শতাংশ থেকে কমে ৫৩ শতাংশ হয়েছে। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সন্তান প্রসবের হার ২৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৭ শতাংশে পৌঁছেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি হাজার জীবিত জন্মে ৩.২%, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম উচ্চহার। বাংলাদেশে নারী সমাজের দীর্ঘমেয়াদী অপুষ্টির হার ৩৭.৯%। ফলে অপুষ্টিতে ভোগা মায়ের গর্ভে কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহন করা শিশুর হার ৩৬%। প্রতি বছর দেশে ৪০ লাখ নবজাতক শিশু প্রসব হয়ে থাকে যার ৯৫% প্রসবই বাড়িতে হয়ে থাকে। এর মধ্যে ১২% দক্ষ ধাত্রী কর্তৃক প্রসব হয়ে থাকে। অপুষ্টিতে মাতৃমৃত্যুর হার ২৫% ঘটে রক্তক্ষরণ এবং রক্তস্বল্পতার জন্য। এর অন্যতম কারণ কিশোরী মাতৃত্ব। বস্তিবাসীদের ক্ষেত্রে এই চিত্র আরো ভয়াবহ। উল্লেখ্য যে, একজন গর্ভবতী নারী গর্ভকালীন সেবা, নিরাপদ প্রসবের জন্য যাবতীয় সেবা এবং প্রসব পরবর্তী সেবা পাওয়ার অবশ্যই অধিকার রাখেন। এটা গর্ভবতী নারীর সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্র, সরকার ও সুশীল সমাজের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো তাদের এই ন্যায্য অধিকার সুনিশ্চিত করা। কিন্তু এই জন্য প্রথমেই প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষার। কারণ শিক্ষার আলো না পেলে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব দেখা দেয়। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান এবং চিকিৎসা গ্রহণ করলে দেশে ৮০% ভাগ মাতৃমৃত্যু রোধ করা সম্ভব। এজন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন গণসচেতনতা অর্থাৎ সঠিক শিক্ষার। উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে আমাদের দেশে অনেক ভ্রান্ত ধারণা বা কুসংস্কার বিদ্যমান রয়েছে। অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণ, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভপাত, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব, চিকিৎসা সমস্যা, স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থানের সংকট, পোশাক সমস্যা, বিনোদনের অভাব, ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, বিয়ে বিচ্ছেদ, তালাকপ্রাপ্ত হওয়া, অর্থনৈতিক দূরাবস্থা এবং পুরুষের দায়িত্বশীল আচরণের অভাবে অধিক মাতৃমৃত্যুর প্রধান প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এসব সমস্যার অন্যতম কারণ হচ্ছে শিক্ষার অভাব। যেমনঃ
মায়ের বয়স ও খাদ্য ঃ
মায়ের বয়স, খাদ্য এবং গর্ভকালীন খাবারের সাথে মা ও শিশুমৃত্যু হারের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। অথচ অল্প বয়সে বিবাহ আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামে গঞ্জে বহুল প্রচলিত। গর্ভবতী মায়ের অপরিমিত খাবার একটা সাধারণ ব্যাপার। খাবারের বেলায় আর্থিক সংগতি যতটা দায়ী, তার চেয়ে বেশী দায়ী কুসংস্কার অর্থাৎ শিক্ষার অভাব। মাতৃগর্ভে ভ্রুণের পুষ্টির প্রয়োজন। ভ্রুণের বয়স বাড়ার সাথে সাথে পুষ্টির প্রয়োজনীয়তাও বাড়ে। তাই গর্ভবতী মায়ের বাড়তি খাবারের দরকার। বিশেষতঃ গর্ভধারণের শেষের তিন চার মাস থেকে বর্ধিত খাবারের প্রয়োজন খুবই বেশী। প্রশ্ন হচ্ছে, বেশীর ভাগ লোকের যেখানে দু’বেলা পরিমিত খাবার জোটে না, সেখানে বাড়তি খাবার আসবে কোথা থেকে ?
গর্ভাবস্থায় খাদ্য : গর্ভাবস্থায় কেউ কেউ ডাল, মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি খান না, তাদের ধারণা এগুলো খেলে পেটে অসুখ করে, ফলে বাচ্চার ক্ষতি হবে। এমন কি অনেকেই মনে করেন ডিম খেলে বাচ্চার হাপানি এবং মৃগেল মাছ খেলে মৃগী রোগ হতে পারে। শিক্ষার অভাবেই এরকম কুসংস্কারের শিকার হয়ে গর্ভবতী মায়েরা অপুষ্টিতে ভুগেন। এতে গর্ভজাত শিশুরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সোজা কথা চিকিৎসকদের মতে, গর্ভবতী মায়ের জন্য কোন খাবার নিষিদ্ধ হবার কোন কারণ নেই।
সন্তান প্রসবের পর ঃ
সন্তান প্রসবের পর মায়েদের অনেক সময় আতুর ঘরে বন্দী করে রাখা হয়। ভাতের সাথে হলুদ বাটা, মরিচ বাটা ও নিরামিষ খাওয়ানো হয়। ফলে মায়েরা অপুষ্টিতে ভুগেন, নানা রোগে আক্রান্ত হয়, বুকের দুধের পরিমান কমে যায় এবং শিশুও উপযুক্ত পুষ্টি পায় না। এমনি করে মা ও শিশু উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উল্লেখ্য যে, গর্ভবতী মা এবং বুকের দুধ দানকারী মা উভয়েরই বাড়তি খাবার প্রয়োজন। তবে এই ক্ষেত্রেও সচেতনতা ও উপযুক্ত শিক্ষা দরকার। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাই সকল উন্নতির চাবিকাঠি এবং জাতির মেরুদণ্ড। দেশের সার্বিক অগ্রগতি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে চাই সবার জন্যে শিক্ষা। তাই নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে শিক্ষার বিকল্প নেই।
লেখক পরিচিতি : লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল
শিক্ষক, কলাম লেখক, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক