মঙ্গলবার ● ৭ জুন ২০১৬
প্রথম পাতা » অপরাধ » কাশিমপুর কারাগারে মীর কাসেমের মৃত্যু পরোয়ানা
কাশিমপুর কারাগারে মীর কাসেমের মৃত্যু পরোয়ানা
গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি :: (২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩ বাংলা : বাংলাদেশ সময় রাত ১০.১০মিঃ) একাত্তরের মানবতাবিরোধী, গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর নেতা ও জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীকে মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শুনিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ ৷
৭ জুন মঙ্গলবার সকালে মীর কাসেম আলীকে ওই কপি পড়ে শুনিয়েছেন কারাকর্তৃপক্ষ ৷
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এ জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বনিক আমাদের গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি মুহাম্মদ আতিকুর রহমান আতিককে জানান, সকাল ৭টার দিকে মীর কাসেম আলীকে মৃত্যু পরোয়ানার কপি পড়ে শোনানো হয় ৷ এর আগে লাল সালুতে মোড়া সেই পরোয়ানা ট্রাইব্যুনাল থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ঘুরে সোমবার রাতেই কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছায় ৷ এ সময় মীর কাশেম আলীকে স্বাভাবিক থাকতে দেখা গেছে বলে জানান কারা কর্তৃপক্ষ ৷
তিনি বলেছেন, আইনজীবী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করবেন তিনি ৷
এই যুদ্ধাপরাধ মামলায় সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসার পর এই রিভিউ আবেদনই বিচারিক প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ ৷
নিয়ম অনুযায়ী, আসামিপক্ষ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য আবেদন করার সুযোগ পাবে৷ রিভিউ নিষ্পত্তি হওয়ার আগে দ- কার্যকর করা যাবে না ৷
রিভিউ না টিকলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা তিনি চাইতে পারবেন একাত্তরের বদর নেতা মীর কাসেম৷ সে আর্জিও নাকচ হলে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে কারা কর্তৃপক্ষ দন্ড কার্যকরের ব্যবস্থা নেবে ৷ তার আগে আসামির সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা সাক্ষাতের সুযোগ পাবেন ৷
১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে হত্যার দায়ে আলবদর বাহিনীর নেতা মীর কাসেমের ফাঁসি বহাল রেখে ৮ মার্চ রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ ৷ রায়ে আরও ছয়টি অভিযোগে (২, ৩, ৭, ৯, ১০ ও ১৪) তাঁর বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড বহাল রাখেন আদালত ৷ তিনটি অভিযোগ (৪, ৬, ১২) থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয় ৷ এর মধ্যে একাত্তরে রঞ্জিত সেন ও টুন্টু দাসকে হত্যার (১২ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল ৷
মীর কাসেম আলী মীর কাসেম আলী একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে কাসেমকে গ্রেফতার করা হয়৷ ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল ৷ ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ১০টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে ৷ এর মধ্যে দুটি অভিযোগে তাঁকে ফাঁসির আদেশ ও আটটি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয় ৷
ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর আপিল করেন মীর কাসেম ৷ গত ৯ ফেব্রুয়ারি ওই আপিলের শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি৷
মীর কাসেম আলী এ কারাগারের ৪০ নম্বর কনডেমড সেলে বন্দি আছেন ৷ এর আগে গ্রেফতারের পর ২০১২ সাল থেকে তিনি এ কারাগারে রয়েছেন ৷ ২০১৪ সালের আগে তিনি হাজতবাসকালে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দির মর্যাদায় ছিলেন ৷ পরে দন্ডপ্রাপ্তির পর তাকে ফাঁসির সেলে পাঠানো হয় ৷
মীর কাসেম আলীর ছেলে মীর আহমেদ বিন কাসেম আমাদের গাজীপুর জেলা প্রতিনিধিকে জানান, মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত রায়ের সার্টিফায়েড অনুলিপি তারা হাতে পাননি ৷ রায় হাতে পেলেই বাবার সঙ্গে আলোচনা করে রিভিউ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ৷ দুই একদিনের মধ্যে আমরা কাশিপুর কারাগারে যাব ৷
যে অভিযোগে ফাঁসি : অভিযোগ ১১: ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যে কোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায় ৷ তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয় ৷ নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশসহ তার লাশ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয় ৷
ট্রাইব্যুনালে তিন বিচারকের ঐক্যমতের ভিত্তিতে এ অভিযোগে মীর কাসেমের ফাঁসির রায় হয় ৷ আপিলেও তা বহাল থাকে ৷
এ মামলার বিচারে রাষ্ট্রপক্ষ ৬৩ বছর বয়সী মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসাবে, যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ৷
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে এই রায়ে ৷
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, একাত্তরে তার নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল ৷ সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির ৷ সেখানে অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়, যাদের লাশ পরে ফেলে দেওয়া হতো চাক্তাই চামড়ার গুদাম সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে ৷
ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে সেই ডালিম হোটেলকে বলা হয় ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’৷
ডালিম হোটেল ছাড়াও নগরীর চাক্তাই চামড়ার গুদামের দোস্ত মোহাম্মদ বিল্ডিং, দেওয়ানহাটের দেওয়ান হোটেল ও পাঁচলাইশ এলাকার সালমা মঞ্জিলে বদর বাহিনীর আলাদা ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র ছিল সে সময় ৷
ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ডালিম হোটেলে ঘটে যাওয়া সবধরনের অপরাধের ব্যাপারে সবকিছুই জানতেন মীর কাসেম ৷ এসব অপরাধে তার কর্তৃত্বপূর্ণ’ অংশগ্রহণও প্রমাণিত ৷ ফলে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৪ (২) ধারা অনুযায়ী তিনি ‘ঊর্ধতন কর্তৃত্বের’ দোষে দোষী ৷
ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মীর কাসেম ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ অর্থাত্ মজলিসে শুরার সদস্য হিসেবে দলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন ৷ তিনি হলেন জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা, চূড়ান্ত রায়েও যার সর্বোচ্চ সাজার সিদ্ধান্ত এসেছে ৷