বুধবার ● ৮ জুন ২০১৬
প্রথম পাতা » আন্তর্জাতিক » চরম ভোগান্তিতে ভিসাপ্রার্থীরা : ভিসা খাতে ভারত বছরে ৬০ কোটি টাকা আয় করে নিচ্ছে
চরম ভোগান্তিতে ভিসাপ্রার্থীরা : ভিসা খাতে ভারত বছরে ৬০ কোটি টাকা আয় করে নিচ্ছে
তৌহিদ আক্তার পান্না ,ঈশ্বরদী :: (২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩ বাংলা : বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭.০০মিঃ) ভারতে ভ্রমনেচ্ছুকদের ভিসা পদ্ধতি সহজিকরণ সংক্রান্ত ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্রী হর্ষবর্ধণ শ্রিংলার অতিসম্প্রতি দেওয়া ঘোষনা কোন কাজে আসছেনা ৷ রাষ্ট্রদূতের ঘোষনার পর ভিসা পদ্ধতিতো সহজ হয়ইনি বরং ভারতে ভ্রমনেচ্ছুকদের ভিসা প্রাপ্তিতে নানা প্রকার সমস্যার সম্মুখিন ও চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে ৷
ঢাকায় অনুষ্ঠিত ভিসা মেলায় বক্তৃতাকালে মি. শ্রিংলা বলেছেন, প্রতিটি ভারতীয় ভিসার জন্য ফি নেয়া হয় ৬’শ টাকা ৷ গত বছর ‘ভারতীয় দূতাবাস ১০ লাখ বাংলাদেশীকে ভিসা প্রদান করায় ৬০ কোটি টাকা আয় হয়েছে ৷ এই পরিমাণ টাকা আয় করতে এই টাকা নেয়া হয় ইউ ক্যাশের মাধ্যমে ৷ ইউসিবি ব্যাংকের ইউ ক্যাশ হয়ে টাকা যায় স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া ৷ যদিও সম্পূর্ণ অসত্য কথা, ভিসা ফি লাগেনা বলে বলা হয়ে থাকে ৷ অথচ ইউ ক্যাশের মাধ্যমে ভিসা হতে আয়কৃত অর্থ দিয়েই ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতনসহ যানবাহন বাবদ খরচ এবং অন্যান্য খরচ সঙ্কুলান সম্ভব ৷
গত ২৯ মে থেকে ‘ই টোকেন’ টেকনিক্যাল ভিসা পদ্ধতিকে আরও আধুনিক করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ৷ যে পদ্ধতির কথা রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে বলা হয়েছে, সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে ঘন্টার পর ঘন্টা এমনকি দিনের পর দিন চেষ্টা করেও ওটিপি সংযোগ পাওয়া যায় না ৷ যদি বলা হতো ভিসার আবেদন ও এপোয়েন্টমেন্ট নিয়ে ভারতীয় দূতাবাসের নিযুক্ত অফিসগুলোতে যেতে হবে, তা হলে সাধারণ বাংলাদেশী নাগরিকগণ সহজে বুঝতে পারতেন এবং ভোগান্তির শিকার হতেন না ৷
অতীতে ভারতীয় দূতাবাস কর্তৃক নিয়োজিত বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে কিছু ভিসা এজেন্ট ছিলেন ৷ যারা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ভিসার কাজে সহযোগিতা করতেন ৷ ভিসা পেতে ইচ্ছুক গ্রামাঞ্চল এবং শহরের সাধারণ মানুষজন তাদের মাধ্যমে ভিসা সংগ্রহ করতেন ৷ অক্ষর জ্ঞান হীন, শারীরিকভাবে চলাচলে অক্ষম ব্যক্তিদের ভিসাও করে দিতে সহযোগিতা করতেন ওই সব এজেন্টগণ ৷ ন্যুনতম একটি মজুরির বিনিময়ে ভিসা এজেন্টগণ কাজ করতেন ৷ এখন একটি ‘ই টোকেন’ বা তার পরবর্তী ওটিপি হয়ে ‘পাসওয়ার্ড ম্যাসেজ’ পেতে হলে দালালদের দিতে হয় চার - ছয় হাজার টাকা ৷
অনলাইন এপ্লিকেশনের এপোয়েন্টমেন্ট এর তারিখ নিয়ে যে বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়েছিল তা নিরসনের জন্য নতুন ‘ওটিপি’ সিস্টেম করা হয়েছে ৷ এই পদ্ধতি আরও জটিলতর৷ ইন্ডিয়ান ভিসা এপ্লিকেশন সেন্টারের ফরম পূরণ করার পর আবেদন করলে একটি নং পাওয়া যায়, তাকে বলা হয় ওটিপি ৷ ওটিপি হলে আবেদনকারি যে মোবাইল নম্বরটি ব্যবহার করবেন বা যে নম্বরটি ফরম পূরণের সময় লিখবেন, সেই নম্বরে ‘পাসওয়ার্ড ম্যাসেজ’ আসবে ৷
ঘন্টার পর ঘন্টা এমনকি দিনের পর দিন চেষ্টা করেও এই ম্যাসেজ পাওয়া যায় না ৷ কয়েকজন ভূক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল রাত দিন একটানা ১৬ ঘন্টা চেষ্টার পরও তারা কাঙ্খিত ‘পাসওয়ার্ড ম্যাসেজ’ পাননি ৷ পাসওয়ার্ড ম্যাসেস পাওয়ার পর কম্পিউটারে ফরম পূরণ করে এপোয়েন্টমেন্ট তারিখের জন্য আবেদন করতে হবে ৷
এই পদ্ধতি ইতোমধ্যেই হ্যাকারদের দখলে চলে গেছে ৷ এর প্রমাণ আপনি যে মোবাইল ফোন নম্বর লিখে ফরম পূরণ করেছেন সেই নম্বরে ম্যাসেজ না এসে ‘পাসওয়ার্ড ম্যাসেজ’ আসছে অন্য নম্বরে ৷
এখন প্রশ্ন হলো, হ্যাকিংয়ের সঙ্গে কে বা কারা জড়িত তা অনুসন্ধান করার দায়িত্ব কার ? বাংলাদেশ সরকারের ? না কি ভারত সরকারের ? জনমনে এই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে ৷
ভারতীয় দূতাবাস এবং স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারি এই হ্যাকিংয়ের সঙ্গে জড়িত এমন অভিযোগ উঠেছে ৷ কিছু চিহ্নিতজন এখন এই টোকেন সংগ্রহ ব্যবসা করে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন ৷ এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ভারতীয় দূতাবাসে কর্মরত বাংলদেশী কর্মচারিদের অনেকেই ৷
সাধারণ মানুষ রাত জেগে সময় নষ্ট করে দিনের পর দিন ‘ই টোকেন’ না পেয়ে বাধ্য হয়ে চার - ছয় হাজার টাকা দালালকে দিয়ে সংগ্রহ করেছেন ৷ জনগণের এহেন ভোগান্তি নিরসনের জন্য এখন আরও আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে ওটিপি নম্বর নেয়ার বিধান চালু করায় ভোগান্তি তো কমেই নি বরং বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৷
আরোও জানাগেছে, ভারতীয় দূতাবাস কর্তৃপক্ষ বায়োমেট্রিক পদ্ধতি নামে আরও একটি নতুন পদ্ধতি চালু করতে চাচ্ছেন ৷ এই পদ্ধতি চালু হলে শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ্য ব্যক্তি, মহিলা সকলকেই আঙ্গুলের ছাপ দিতে উপস্থিত হতে হবে ভারতীয় দূতাবাসে ৷ তখন ভোগান্তি আরও শতগুণ বাড়বে বৈ কমবে না ৷ এমন মন্তব্য করলেন ভূক্তভোগীরা ৷
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট নাট্যকার মলয় ভৌমিক বলেন, ‘বাংলাদেশ এবং ভারত প্রতিবেশি রাষ্ট্র ৷ একদা দুটি রাষ্ট্রই ছিল বৃটিশ সরকারের অধীন এবং এক উভয় দেশের জনগণের আত্মীয়-স্বজন রয়েছে এপার-ওপারে ৷ ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র ৷ সম্পর্ক গভীর ৷ কিন্তু ভিসা প্রাপ্তিতে যে জটিলতা তা সত্যিই কষ্টকর ৷ কেন কি কারণে এই জটিলতা তা খতিয়ে দেখা জরুরী ৷ এটি করা দরকার উভয় দেশের স্বার্থেই ৷’
বিশিষ্ট সাংবাদিক ‘দৈনিক সোনার দেশ’ সম্পাদক হাসান মিল্লাত বলেন, ‘ভারতের রাষ্ট্রদূত বলছেন ভিসা পদ্ধতি সহজ করা হয়েছে, কিন্তু আমরা দেশবাসী কি দেখছি ? প্রতিদিন ভিসার জন্য ভারতীয় দূতাবাস প্রাঙ্গণে শত শত মানুষের লাইন’৷ দালালদের তত্পরতা ৷ রাজশাহী প্রেসক্লাবের সাধারন সম্পাদক সাইদুর রহমান বলেন, ‘ভারতীয় দূতাবাসের রাজশাহী অফিসের কর্মকর্তাদের আচরণ বন্ধুসুলভ এবং গণমুখি নয় ৷ তাদের আচরণে সহমর্মিতার তীব্র’ সংকট রয়েছে ৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়ন করার জন্য আন্তরিক হলে এই সমস্যা দ্রুত সমাধান করা জরুরী ৷ তবে এক্ষেত্রে ভারতের রাষ্ট্রদূতকে আরও আন্তরিক হতে হবে ৷ খুঁজে বের করতে হবে সমস্যার জন্য কে বা কারা দায়ী ৷’
রংপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ডা. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘রংপুরে ভারতীয় দূতাবাস একটি ভিসা বুথ চালু করেছে ৷ তাতে জনগণ খুব বেশি উপকৃত হচ্ছে না ৷ আগের চেয়ে বরং ভোগান্তি বেড়েছে’৷ পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ডক্টর আব্দুল আলীম বলেন, ভিসা প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বন্ধুপ্রতিম দু’দেশেরই সম্পর্কের উন্নয়ন হওয়া জরুরী ৷