বুধবার ● ১৫ জুন ২০১৬
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » শিশু শ্রম বন্ধ হয়নি : প্রয়োজন সচেতনতা
শিশু শ্রম বন্ধ হয়নি : প্রয়োজন সচেতনতা
পলাশ বড়ুয়া :: দেশে শিশু শ্রম সমস্য সমাধানে নেই কোন কার্যকরী ব্যবস্থা ৷ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (১৯৮৯) এ স্বাক্ষরকারী ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে অন্যতম একটি হলো বাংলাদেশ ৷
১৯৯৪ সালে জাতীয় শিশু নীতি প্রণয়ন করা হয় বটে কিন্তু আদৌ সুনির্দিষ্ট ভাবে আমাদের দেশে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেই ৷ শুধু ঢাকা বা সিলেট শহর নয় সারাদেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৷ শ্রম আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিব্যি বৃদ্ধি পাচ্ছে শিশু শ্রম ৷
মো: ইসমাইল বয়স-১১ উখিয়া উপজেলার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের ক্লাশপাড়া গ্রামের মৃত আইয়ুব আলী পুত্র ৷ শারীরিক ভাবে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে ৷ ১২ জুন (রবিবার) ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে রিক্সা নিয়ে ৷ কেননা, ঘরে থাকা ৩ ভাই-বোন ও বিধবা মায়ের অন্ন যে যোগাড় করতে হবে ৷ আমাকে দেখে মৃদুস্বরে বলল আপনি কি কোর্টবাজার যাবেন ? বললাম হ্যাঁ ৷ কিন্তু তুমি তো অনেক ছোট রিক্সা টানতে পারবে তো ? তার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে রিক্সায় উঠি এবং যেতে যেতে তার পারিবারিক অবস্থা ও ঝুকিপূর্ণ কাজে তার আত্ননিয়োগের বিষয়টি আমাকে পীড়া দিচ্ছে দারুণ ভাবে ৷ তার চাহিদার চেয়ে কিছু বাড়িয়ে দিয়ে বললাম রিক্সাটা কি ভাড়ায় চালিত নাকি নিজেদের ? ভুমিহীন পিতার চালিত রিক্সাটি ছাড়া সহায় সম্বল বলতে কিছুই নেই বলে জানায় ইসমাইল ৷ পিতার মৃত্যু পরবর্তী রিক্সা ভাড়ার টাকায় কোন রকম খেয়ে না জীবন কাটালেও বিগত ৫ মাস আগে থেকে নিজেই রিক্সা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে বলে জানায় ৷ দৈনিক কত টাকা আয় করে জানতে চাইলে বলে শরীর সুস্থ থাকলে ২/৩শ টাকা আয় হয় ৷ এই টাকায় সবাইকে নিয়ে কোনরকম দিন চলে যায় ৷ পিতৃ বিয়োগের কারণে ভর্তি হয়েও প্রাথমিকে পড়া সম্ভব হয়নি বলে জানায় ইসমাইল ৷
দেশে বিভিন্ন আইন, নানা উদ্যোগ আর আয়োজনের পরও যেন বেড়েই চলছে শিশু শ্রম ৷ লাখ লাখ শিশু শ্রম দিচ্ছে কল কারখানা, গ্যারেজে, রিকশায়, ওয়ার্কশপে ৷ অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা আর দারিদ্রের জন্যই বেড়েই চলছে শিশু শ্রম ৷ জীবিকার তাগিদে জীবনের শুরুতেই কোমলমতি শিশুরা মুখোমুখি হচ্ছে কঠিন বাস্তবতার ৷ যে বয়সে হাতে থাকার কথা বই-কলম ৷ সেই বয়সেই হাতে তুলে নেয় কঠোর শ্রমের হাতিয়ার ৷ দিনে পর দিনে বাড়ছে জনসংখ্যা আর বাড়ছে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৷ পরিবারকে দু-মুঠো অন্ন আর অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করতে যোগ দিচ্ছে বিভিন্ন পেশায় ৷ এদের মধ্যে অনেক শিশুই ঝুঁকির্পূণ পেশায় নিয়োজিত৷ শিশু শ্রম নিরসনে নেই কোন কার্যকর উদ্যোগ ৷ আমাদের দেশে স্কুল পড়ুয়া শিশুদের বৃহত্ একটি অংশ বিদ্যালয়ে যায় না ৷ প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু বিভিন্ন পারিপাশ্বীক কারণে স্কুলে গমন করতে পারে না ৷ অনেকেই বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও চালিয়ে যেতে পারেনা পড়ালেখা ৷ অর্থাভাবে থেমে যায় পড়াশোনা ৷ পরিবারে অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে গিয়ে বিসর্জন দিতে হয় শিক্ষাজীবনের ৷ পরিবারকে সাহায্য করার জন্য অল্প বয়সেই ঝুকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত হতে হয় অধিকাংশ শিশুকে ৷
শিশু শ্রম বন্ধের জন্য মূলত প্রয়োজন দারিদ্র মুক্ত সমাজ গড়ে তোলা ৷ অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের জন্য পরিবারের ছোট ছোট শিশুরা জড়িয়ে যায় বিভিন্ন কাজে ৷ চায়ের দোকানে, গাড়ীর হেলপার, মুদির দোকানদার, সব্জি বিক্রি, ওয়ার্কশপে কাজ, বিল্ডি নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে থাকে ৷ এসব শিশু শ্রমিক অনেকাংশে বেশি সময় কাজ করে থাকে কিন্তু তারা ন্যায্য মূল্য পায়না ৷ কাজের চাপ থাকে প্রচুর ৷ গৃহকত্রীর মেয়ে ঠিকই স্কুলে যাওয়া আসা করে কিন্তু কখনো চিন্তা করেনি কাজের মেয়েটির কথা৷ কাজের চাপ সহ্য করতে না নীরবে কান্না কাটি করতে থাকে এসব শিশুরা ৷ কর্ত্রীর চোখ রাঙানিতে কাজের মেয়েরা অনেক সময় প্রতিবাদ করতে চাইলে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা অত্যাচার করতে থাকে ৷ নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও হাত তোলে এসব অসহায় শিশু শ্রমজীবিদের শরীরে ৷ অনেক সময় জানা যায় গৃহকৃত্রীর অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয় ৷ অনেক কিশোরী মানুষের বাড়িতে কাজ করা অবস্থায় বাড়ির কর্তা কর্তৃক যৌন হয়রাণির শিকার হয়ে থাকে ৷ প্রতিবাদ করার সুযোগ পায়না ভিকটিম কিশোরী ৷
জাতীয় শিশু নীতির আলোকে যে সকল প্রতিষ্ঠানে শিশুরা নিয়োজিত আছে, সেখানে শিশুরা যেন কোনরূপ শারিরিক, মানসিক, ও যৌন নির্যাতনের শিকার না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে হবে ৷ বাস্তবে এর চিত্র ভিন্ন ৷ পাড়া মহল্লায় বিভিন্ন বাড়ীতে যারা কিশোরীদেরকে নিজেদের তত্তাবধানে রেখে কাজ করান আসলে কতটুকু মেনে চলেন জাতীয় শিশু নীতি ৷
শিশু শ্রম নিবারণ করতে হলে প্রয়োজন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সমণ্বিত উদ্যোগ আর সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করা ৷