মঙ্গলবার ● ১৩ অক্টোবর ২০১৫
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » গণপরিবহনে নৈরাজ্য
গণপরিবহনে নৈরাজ্য
মুহাম্মদ আবদুল কাহহার :: দু’সপ্তাহ আগে অতিবাহিত হলো পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদ মানে খুশি। কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছে ঈদ মানে যাত্রীর ওপর জুলুম। যাত্রীর ওপর যতবেশি যুলুম করা যায়, ততই যেন তারা খুশিতে মেতে ওঠে। বিশেষ বিশেষ দিন ও মৌসুমে পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছে যাত্রীরা যিম্মি হয়ে পড়ে। যাত্রীদের থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় যেন ওপেন-সিক্রেট বিষয়। জ্বালানির মূল্য বাড়লে পরিবহনের ভাড়া বাড়বে এটা স্বাভাবিক। গত ২৭ আগস্ট’১৫ সিএনজির মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবহন মালিক সমিতির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভাড়া বাড়ানোর সুপারিশ করে বিআরটিএ। এরই ধারাবাহিকতায় মালিক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ১০ পয়সা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। সেই অনুযায়ী গত ১ অক্টোবর থেকে ঢাকা ও চট্ট্রগ্রাম মহানগরে গণপরিবহনে বর্ধিত বাসভাড়া কার্যকর করা হয়েছে। তাই নতুন করে বাসের ভাড়া বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ টাকা ৭০ পয়সা, যা আগে ছিল ১ টাকা ৬০ পয়সা। আর মিনি বাসের ভাড়া বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ টাকা ৬০ পয়সা, যা আগে ছিল ১ টাকা ৫০ পয়সা। এখানে উল্লেখ্য যে, কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন নেতাদের সঙ্গে কোন রকম আলোচনা ছাড়াই সরকার পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বসে একতরফাভাবে বাস ভাড়া বাড়িয়ে আবারও প্রমান করেছেন যে, রাষ্ট্রীয়ভাবে সাধারণ মানুষের মতামত উপেক্ষিত।
সরকারি সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, রাজধানী ও আশপাশের পাঁচ জেলা নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ জেলা ও ঢাকা জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে ঢাকা মহানগর পর্যন্ত সিএনজিচালিত যেসব বাস-মিনিবাস চলাচল করে সেগুলোর জন্য নির্ধারীত নতুন ভাড়া প্রযোজ্য হবে। কোন মতোই দূরপাল্লার পথের বাসের জন্য নতুন ভাড়া প্রযোজ্য হবেনা। অথচ দেশের বিভিন্ন স্থানে থেকে পরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন। ০১ অক্টেবর থেকে নতুন ভাড়া কার্যকরা হওয়ার ঘোষণার সাথে সাতে রাজধানীর দূরপাল্লার ২০০টির বেশি রোডের ১১৪টিতে নতুন ভাড়া চালু করা হয়েছে।
ঈদের আগে ‘বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি’র এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, ঈদ যাত্রায় বাড়তি ভাড়া আদায় প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। (ইনকিলাব,২৩ সেপ্টেম্বর)। তাদের এ আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হওয়ায় জনর্দুভোগ বেড়েছে। অসাধু পরিবহনকর্তৃপক্ষ সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছামতো অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন। সামান্য ভাড়া বৃদ্ধি পেলেও বাস ভাড়া বাড়ানো হয়েছে কয়েকগুণ। এতে করে যাত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়ে হাতাহাতি, মারামারিসহ বিভিন্নভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। অধিকাংশ পরিবহনে নতুন ভাড়ার তালিকা সাঁটানো না থাকায় যাত্রীরা নিয়মিত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এছাড়া গণপরিবহনে অযৌক্তিকভাবে অতিরিক্ত ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সকালে ‘বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি’র উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় ভাড়া বৃদ্ধির অনিয়মের প্রতিবাদে মানববন্ধনও হয়েছে। গণমাধ্যমের খবরে যাত্রীদের অভিযোগের বিষয়টি প্রচারিত ও প্রকাশিত হলেও সরকারকে এ ব্যাপারে তেমন কার্যকরী কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। যার ফলে পরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্য বন্ধ হয়নি। যতবার ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, ততবারই যাত্রীরা যুলুমের শিকার হচ্ছেন। এবার সর্বনি¤œ ভাড়া আগের মতো বড় বাসে ৭ টাকা ও মিনিবাসে ৫ টাকা বহাল থাকার কথা, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে, সে নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। ফলে পরিবহন সেক্টরে এক ধরণের নৈরাজ্য বিরাজ করছে।
পরিবহন সেক্টরের সে অনিয়ম অহরহ ঘটছে, সেগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে যাত্রী ওঠা-নামার জন্য নির্দিষ্ট স্টপিজ থাকলেও যেখানে সেখানে গাড়ি থামানো হচ্ছে। হেলপার গাড়ি ড্রাইভ করছে। চালকের লাইসেন্স নেই। নির্দিষ্ট আসনের বেশি লোক বহন করা। সিটিংয়ের নামে চিটিংবাজি। ভাড়ার বিপরীতে যাত্রীদের টিকেট না দেয়া, অতিরিক্ত ভাড়া দিতে যাত্রীদের বাধ্য করা। যাত্রীবহনকারী পরিবহনে ব্যবসায়ীক পণ্য বহনকরায় যাত্রীদের দুর্ভোগ। সরকার কর্তৃক নিধারিত ভাড়ার তালিকা না থাকা। পরিবহন চলাকালে চালকের ধূমপান। যাত্রীদের সাথে খারাপ আচরণসহ নানা অনিয়ম বিদ্যমান। এছাড়া মহানগরের অভ্যন্তরে ছোট ছোট সড়কে চলমান সিএনজি ট্যাক্সিতে মিটার নেই। ফলে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করেন। আর যে সব সিএনজি ট্যাক্সিতে মিটার আছে তারা আবার মিটার অনুযায়ী ভাড়ায় যেতে রাজি নন। তাই কখনো কখনো চুক্তিতে, কখনো বা মিটারের চেয়ে ২০-৫০ টাকা বেশি ভাড়ায় যাত্রীদের যাতায়াত করতে হয়।
অতিরিক্ত ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিবে কি নিবেনা এ বিষয়ে নানামত রয়েছে। “রাজধানীর বাস-মিনিবাসের বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে বলে মনে করেন কি?” শীর্ষক প্রথম আলোর অনলাইন পাঠক জরিপ ফলাফলে দেখা গেছে, ৩৯৬৫০ জনের মধ্যে ৩৫৮৫ জন (৯০.৪২%) “না” ভোট দিয়েছেন। (৩ ও ৪ অক্টোবর’১৫)। এছাড়া সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া আবার বাড়ানোর প্রস্তাব সমর্থন করেন কি? এ প্রশ্নের আলোকে জরিপে ৪০৯৩ জনের মধ্যে ৩৭০৩ জন (৯০.৪৭%) না ভোট দিয়েছেন। (২৪ আগস্ট’১৫)। এসব মতামত জরিপের ফলাফল প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের নজরদারি বাড়িয়েছে। ফলে, “বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এর মোবাইল কোর্ট ‘বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও ভাড়ার তালিকা না রাখাসহ বিভিন্ন অভিযোগে রাজধানীতে বিভিন্ন ধরণের পরিবহনের বিরুদ্ধে ৫৪টি মামলা দায়ের করেছে।’(ভোরের কাগজ, ৪ অক্টোবর,’১৫)। সেই মামলায় আসামিরা নাম মাত্র শাস্তি পাচ্ছেন কি না কিংবা আদৌ কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় কিনা তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
সরকারের বেঁধে দেয়া নিয়ম মানা হচ্ছে না। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহনকর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতায় নৈরাজ্য কায়েম হয়েছে। পরিবহন শ্রমিকদের অভিযোগ বিভিন্নস্থানে চাঁদা দিতে হয় বলে তারা ভাড়া বেশি নেন। সরকারদলীয় বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নামে বেনামে চাঁদা তুলছেন। তাদের এ কথার যথেষ্ট সত্যতা রয়েছে। একটি লোক কথা সমাজে প্রচলিত আছে যে, নিয়ম বর্হিভূত কোন কাজ করতে চাইলে সরকারি দলে যোগ দাও। এখন যেই দল ক্ষমতায় আছেন এই কথাটি শুধু তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বরং যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদেরকেই বোঝানো হয়েছে। আবার সবাই অনিয়ম করছেনা, কিন্তু যারা অনিয়মগুলো করছে তাদেরকে সনাক্ত করা এবং শাস্তির আওতায় না আনার কারণে সবাইকেই এক চোখে দেখা হচ্ছে, যা অনুচিত।
এসব কর্মকা- দেখে রাষ্ট্রের কোন অভিভাবক আছে বলে মনে হয়না। কেননা তাদেরকে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতেও দেখা যায় না। তবে রাস্তাঘাটে সরব এক মন্ত্রীকে কালেভদ্রে বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়। এতে করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কিছুটা কমলেও এই ব্যবস্থাটি যদি সার্বক্ষণিক-সর্বত্র বহাল রাখা যেত তাহলে পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্য কিছুটা হলেও কমে যেত। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিরা তা করছেন না।
সাধারণ মানুষকে খুবই কষ্টের সাথে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে জীবনযাত্রায় বাড়তি চাপ পড়ছে। পাশাপাশি বাড়ির মালিকরা বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি করতে শুরু করেছে। এছাড়া ২১ লাখ সরকারি ও এমপিওভুক্ত চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করায় ইতোমধ্যেই বিভিন্ন পণ্য দ্রব্যের দাম আরেক ধাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মানুষকে সর্বোচ্চ সেবা কী উপায়ে প্রদান করা যায় সরকারকে সেটা ভেবে দেখা উচিত। যাত্রীদের স্বার্থ না দেখে শুধুই মালিকের মতামতের প্রধান্য দেয়া ঠিক নয়। ভাড়া বাড়ানোর পাশাপাশি সেবার মান, পরিবহন খাত সংস্কার, লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলোর সার্ভিস বন্ধসহ চাঁদাবাজি বন্ধ করা করতে হবে। বিশেষকরে যাত্রীদেরকে নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি রুটে সরকারি বাস সার্ভিস চালু হোক এই প্রত্যাশা করছি। একই সাথে বাস, মিনিবাস, হিউম্যান হলার ও সিএনজি অটোরিক্সায় বাড়তি ভাড়া আদায় থেকে বিরত থাকার জন্য পরিবহন কর্তৃপক্ষকের প্রতি উদাত্ত আহ্বান রইলো।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট