শুক্রবার ● ১৭ জুন ২০১৬
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » ইফতার মাহফিল রাজনীতি নয় ইবাদাত
ইফতার মাহফিল রাজনীতি নয় ইবাদাত
মুহাম্মদ আবদুল কাহহার :: ইফতার পূর্ব মুহূর্ত মাহে রমাদানের একটি বরকতময় সময়৷ সাওমপালনকারী ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, দান-খয়রাত, দুয়া-মুনাজাত ছাড়াও অন্যান্য নফল ইবাদাত আদায় করার মধ্য দিয়ে সময়টি অতিবাহিত করেন ৷ কেউ আবার নিজ হাতে ইফতার তৈরী করে থাকেন ৷ আবার কেউ ইফতারি ক্রয় ও বিতরণে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন ৷ ব্যক্তি বিশেষে কাজের পার্থক্য হয়ে থাকে ৷ বিশুদ্ধ হাদিসের ভাষ্যনুযায়ী ইফতারের পূর্ব মুহূর্তটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ৷ দু’য়া কবুলের যতগুলো সময় রয়েছে তার মধ্যে এটি একটি ৷ এছাড়া একজন রোজাদারকে ইফতার করানোর মাধ্যমেও অসংখ্য নেকী অর্জন করার ব্যবস্থা রয়েছে ৷ ‘যে ব্যক্তি একজন রোজাদারকে ইফতার করাবে তার জন্য সেই রোজাদারদের মতোই সওয়াব লেখা হবে তাতে মূল রোজাদারের সওয়াবের কমতি হবে না ৷’ এ হাদীসকে সামনে রেখেই ইফতার মাহফিলের আয়োজন করত ইফতারের আয়োজন করা হয় ৷ কুরআন ও হাদিসের আলোচনা পেশ করা হয় ৷ কিন্তু এমন একটি ভাল কাজও আজ বিতর্কীত হয়ে যেতে পারে ৷ যেমন:’ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো চাঙ্গা’; ‘এবার জমবে ইফতার রাজনীতি’; ‘রাজেৈনতিক দলগুলোর ইফতার পলিটিক্স’; ‘ইফতার মাহফিলে সংঘর্ষ আহত ২০’৷ এমন শিরোনামে প্রতি রমাদানেই সংবাদ ছাপা হয় ৷ এ ধরণের শিরোনামের কারণে মানুষের মাঝে ইফতার মাহফিল সম্পর্কে একটি ভুল ধারণাও বিস্তার লাভ করছে ৷
ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দু ধরণের কর্মকান্ডই বিদ্যমান ৷ ইতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে কুরআন তেলাওয়াত, হামদে বারী তায়ালা ও নাতে রাসূল পরিবেশন, কুরআনুল কারীম থেকে পঠিত আয়াতের অনুবাদ, তাফসীর, হাদীসের উদ্বৃতি, মাহে রমাদান সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা, সীরাত ও সাহাবিদের জীবন ও কর্ম আলোচনার পাশাপাশি সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা, মুসলিমদের মধ্যে মতানৈক্যের ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠার আহ্বানসহ তাহলিল, তাসবীহ, দুয়া ও মুনাজাত শেষে ইফতারী বন্টন করা হয় ৷ তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয় ৷ এ কাজগুলো যদি সুন্নাহ অনুসরণ করে করা হয় তাহলে সেই ধরণের ইফতার মাহফিল নিয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয় ৷ তবে ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করে কোথাও কোথাও কতিপয় নেতিবাচক কর্মকান্ডের কথাও জানা যায় ৷ বিশেষ করে ইফতার মাহফিলের নামে শুধুই দুনিয়াবি কথা-বার্তা, স্রেফ রাজনৈতিক বক্তৃতা, রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও দলীয় কর্মসূচি ঘোষণা, অসত্য বক্তব্য ও উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান, অপরকে খাটো করে কথা বলার মানসিকতায় পূর্ণ কথা বার্তা, গিবত, মিথ্যা গল্প তৈরী, নিজে থেকে বানিয়ে বানিয়ে বলার অপসংস্কৃতিও সমাজে চালু আছে ৷ তাছাড়া বসার স্থান ও ইফতারি ভাগ ভাটোয়ারা, আধিপত্য বিস্তার নিয়েও দ্বন্দ্ব, হামলা, ভাংচুর, সংঘাত, সংঘর্ষ ইত্যাদি আচরণও কোথাও কোথাও দেখা যায় ৷ এসব কর্মকান্ড শুধু বর্জনীয় নয়, একই সাথে তা নিন্দনীয় ৷
ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করে অনেক ভাল ভাল করাজ করা হলেও মনের অজান্তেই নেতিবাচক চিন্তাগুলাই মাথায় ভর করছে ৷ আর কেনই বা করবে না ? যখন ইফতার মাহফিলের প্রধান অতিথি বা সভাপতি থাকেন গায়ক,গায়িকা, নায়ক-নায়িকা, নাস্তিক, মুরতাদ, হিন্দু কিংবা অমুসলিম অথবা দাইয়ূস কোন মহিলা ৷ এখানেই শেষ নয়, ‘আমি হিন্দুও নই, মুসলমানও নই’ এমন কথা যারা বলেছেন তাদেরকেও আবার ইফতার মাহফিলের অতিথি হতেও দেখা যায় ৷ নাস্তিক আর আস্তিক কিংবা নারী-পুরুষ, বয়েেফ্রন্ড-গার্লফ্রেন্ডস একত্রিত হয়ে পর্দার বিধানসহ ইসলামের বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করে ধর্মীয় সাইনবোর্ড ঝুলান তখন সে ধরণের ইফতার মাহফিল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা আসবে এটাই যুক্তিযুক্ত ৷ আর এসব কর্ম কান্ডের মাধ্যমে সাওয়াব ও হেদায়াত লাভের আশা করা অর্থহীন ৷ এ ধরণের ইফতার মাহফিলই নয় যে কোন কাজ মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না ৷ নারী ও পুরুষদের জন্য পৃথক পৃথক ব্যবস্থা থাকা অবশ্যই জরুরী ৷ ইতিবাচক কাজগুলো নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে, অপরদিকে নেতিবাচক কাজগুলো অবশ্যই পরিত্যাজ্য ও জঘন্য অপরাধ ৷ ইফতার মাহফিল তখনই সফল হবে যখন তা কুরআন ও হাদীসের বিধান মেনে করা হবে ৷ কেউ যদি নেতিবাচক কাজের জন্য ‘ইফতার মাহফিল’ নাম ব্যবহার করেন তাহলে তিনি গোনাহগার হবেন ৷ দুনিয়ার মানুষের কাছে তারা যেমন তিরস্কারের পাত্র হবেন তেমনি পরকালে তাদের জন্য থাকবে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা ৷
কেউ কেউ বলেন রাজনীতিও ধর্মের বাইরে নয় ৷ এটাও ঠিক৷ তবে সে রাজনীতির লক্ষ হবে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য রাজনীতি ৷ আর সেই রাজনীতি করছেন নবী-রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামগণ ৷ রাসূল স. যে নীতি ও আদর্শ রেখে গেছেন তা যথাযথ অনুসরণ করার মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করার মানসিকতা বা দেশ পরিচালনা করাই হবে আসল রাজনীতি ৷ তখন সেটিই হবে নীতির রাজা ৷ কিন্তু রাজনীতি যখন রাজার নীতি হয় তখন মানুষ হয় বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট ৷ তাই রাসূল (স.) ও খোলাফায়ে রাশেদুনের দেখানো রাজনীতি করা হলে তা হবে সহীহ ও ন্যায় সঙ্গত ৷ সব কিছুকে রাজনীতিকরণ ভাল নয় একথা যেমন সত্য, তেমনি প্রকৃত রাজনীতি করার প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে, এটিও আড়াল করে রাখা ঠিক নয় ৷ আমরা দেখছি, পেশাদার রাজনীতিবিদদের অধিকাংশই ইফতার মাহফিলের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতকে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থে ব্যবহার করেন ৷ স্বাভাবিক রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করতে না পেরে ধর্মীয় চেতনায় রাজনৈতেক ফায়দা লাভ করতে ইফতার মাহফিল করা হলে প্রাথমিকভাবে এতটুকু বলা যায় যে তাদের নিয়ত সহীহ নয় ৷ আর কোনো আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় হওয়ার জন্য নিয়ত বিশুদ্ধ হতে হয় ৷ তা না হলে কোন ধরণের সওয়াব আশা করা যায় না ৷ একদল তার নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করবেন আর অন্যদলের নেতাকর্মীরা ঘনিষ্ঠতা লাভ করবেন এই যদি হয় তাদের নিয়ত তাহলে তারা ভুলের চর্চা করছেন এবং ভুলের ওপর প্রতিষ্ঠিত ৷
ইফতার পার্টির নামে ভূরিভোজ সমাজে চালু রয়েছে তাতে অধিক পরিমাণে খাদ্যের অপচয় হয় ৷ অভিজাত এলাকায় অহরহ খাবার অপচয় করা হয় ৷ খাবার অপচয় করা যেন ফ্যাশনে রুপ নিয়েছে ৷ খাদ্য অপচয় রোধে নৈতিকবোধ যত দিনে জাগ্রত না হবে ততদিনে সামগ্রিকভাবে ক্ষুধা ও দারিদ্রতা থেকে মুক্তি মিলবে না ৷ সিয়াম সাধনার মাধ্যমে সংযমী হওয়ার পরিবর্তে আমরা অহংকারী আচরণ করছি ৷ প্রতিপক্ষের আয়োজন কেমন ছিলো তা বিবেচনায় নিয়ে নিজেদেরেকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে আমরা মরিয়া হয়ে উঠছি ৷ সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষেরা প্রতি নিয়ত না খেয়ে মরছে, সঠিকভাবে খাবার পায় না ৷ আর প্রভাবশালীরা অসত্ উপায়ে অর্জিত সম্পদ দিয়ে রাজনৈতিকভাবে ইফতারের আয়োজন করেই মনে করছেন তিনি অনেক বড় একটি ভালো কাজ করে ফেলেছেন ৷ আলেম, এতিম, পেশাজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, বিচারপতি, সরকারি কর্মকর্তা, আত্মীয়স্বজন, জোটের শীর্ষ নেতা, কূটনীতিক, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার নাগরিকদের সম্মানে ইফতার মাহফিল করা হলেও সাধারণ নাগরিক কিংবা প্রকৃত অভাবী ও সাওমপালনকারীদেরকে মূল্যায়ন করা হয় না ৷ তাদের বেলায় ব্যাপক কোন আয়োজন তেমন চোখে পড়ে না ৷ তাই এ ধরণের আয়োজনের নিয়তের বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন আসে ৷
আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে নিয়ে ইফতার মাহফিল আয়োজন করে ইসলামী আলোচনার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সেই কার্যক্রমকে আরো শক্তিশালী করা ঈমানের দাবী ৷ আলোচনার মাধ্যমে একটি বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করা যায় ৷ রাসূল (স.) ইফতারির মহত্ম্য তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, কিছু না থাকলে অর্ধেক খেজুর অথবা পানি দিয়ে হলেও সাওমপালনকারীকে ইফতার করাতে বলেছেন ৷ রাসূলুল্লাহ সা. অন্যত্র বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে, তা তার জন্য গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে এবং সে রোজাদারের সমান সওয়াবের অংশীদার হবে ৷ অথচ রোজাদারের সাওয়াবের মধ্যে কোনো কম করা হবে না ৷ ‘ এছাড়াও বলা হয়েছে,’ যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে পানি পান করাবে আল্লাহ তাকে হাউসে কাওসার থেকে এমন পানি পান করাবেন, যারপর জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত আর পিপাসা লাগবে না ৷ ‘(বায়হাকি, ইবনে খুজায়মা)৷ তাই নিজেদের ইফতারি পরস্পর ভাগাভাগি করে খাওয়ার মধ্য দিয়ে, অপর ভাইকে ইফতারে শামিল করে চরম তৃপ্তি, অধিক পূণ্য ও কল্যাণ করা যায়৷ তাই সহীহ নিয়ত নিয়ে ইফতার মাহফিলের আয়োজন বেশি বেশি করা উচিত ৷
সর্বোপরি, দুনিয়ার ফায়দা হাসিলের জন্য ধর্মীয় ব্যানারে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালানোর যে রীতি চালু হয়েছে তা বন্ধ হওয়া দরকার ৷ নিয়তকে বিশুদ্ধ করতে হবে ৷ ইবাদত যাতে বিতর্কীত না হয় সে জন্য সতর্কতার সাথে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করতে হবে ৷ বিশেষ করে প্রত্যেকের সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে যাতে তাকওয়া অর্জিত হয় সে ভাবেই সাওম পালন করা উচিত ৷ আর তাকওয়া অর্জনের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সকল আদেশ মানা ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চেষ্টা করতে হবে ৷ আল্লাহ আমাদেরকে সেই তাওফিক দান করুন ৷ আমীন ৷ লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট ।