বুধবার ● ২২ জুন ২০১৬
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » পাহাড়ি–বাঙ্গালীর প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার পার্বত্য অঞ্চল
পাহাড়ি–বাঙ্গালীর প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার পার্বত্য অঞ্চল
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: সত্য বলা আর সত্য প্রকাশ করা বড়ই কঠিন। গত মাসে (মে-২০১৬ ) আমার নিজের একটি লিখা গনমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি সমস্য সমাধানের পথ কি ? লিখাটি পড়ে আমার এক বন্ধু বলেছেন আমি না কি কাউকে সরাসরী আক্রমন করে লিখি ইত্যাদি। আবার কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের হুমকিও দিয়েছে। এবার আমি আমার লেখায় চেষ্টা করব অনেক দুর থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লেখার, তবে তথ্য দিতে গিয়ে হয়তো অনেকের থলির বিড়াল বের হয়ে আসতে পারে। ৬ মাস ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে এর আগে পার্বত্য এলাকার সীমান্তে বেশ কয়েকটি উগ্রপস্থী অস্ত্রধারী সংগঠনের তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করায়, আমার আরেকজন বন্ধু বলেছিলেন, ১০ জন সাংবাদিক এর ভিতর ৮জন সাংবাদিক যা লিখবে তা পাঠক, সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে গুরুত্ব পাবে। আমার এ বন্ধুর কথাটি শতভাগ সত্য। পার্বত্য চুক্তির পর পাহাড়ে অস্ত্রে ব্যবহার হচ্ছে আবাধে, চাঁদাবাজি হচ্ছে গণহারে আর খুন, অপহরণ ও সরকারী অর্থ লোপাট তো প্রতিনিয়ত হচ্ছে । যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাজ করেন তারা কিন্তু এসব প্রকাশ না করার দায় এড়াতে পারেন না। আপনি অধিকার চাইবেন কিন্তু দায়িত্ব পালন করবেন না, এটা তো হতে পারে না। আমার এক সেনাবাহিনীর অফিসার বন্ধু ৫মাস আগে বলেছিলেন, আমাদের (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী)’র ভাল কাজের প্রশংসা এখানের গণমাধ্যম গুলি করে না বা তার তথ্যও তারা নেন না। কিন্তু (সেনাবাহিনী)আমরা যে কাজ করি নাই, সে কাজের জন্য আমাদের (সেনাবাহিনী) বিরুদ্ধে গণমাধ্যম গুলিতে সংবাদ প্রকাশ করে, একথার সত্যতা সবার জানা। এটা সাংবাদিক বন্ধুদের হচ্ছে দৃষ্টি ভঙ্গীর ব্যাপার।
১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাগের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামে ৯০ %ছিলো পাহাড়ি, ৭.৫% ছিলো হিন্দু আর বড়ুয়া এবং মুসলিমদের সংখ্যা ছিলো ১.৫% তারপরও ‘বাউন্ডারি কমিশনের’ রোয়েদাদ অনুসারে পাকিস্তানের ভাগে পার্বত্য চট্টগ্রাম পড়ে যায়।
এর পরের ইতিহাস অনেকের হয়তো জানা, অনেকের হয়তো জানা নেই।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই নানা অপকৌশল অবলম্বন করা হয়েছিলো এবং এখনও করে যাওয়া হচ্ছে পার্বত্য বাসীদেরকে তাঁদের ভূমিতেই সংখ্যালঘু করে রাখার। কখনও দেশের অন্য জেলা থেকে বাঙালিদের এখানে এনে অপরিকল্পিতভাবে পুনর্বাসিত করা হয়েছে যত্রতত্র, কখনও কাপ্তাই লেক আবার কখনও চন্দ্রঘোনা পেপার মিল নির্মাণ ইত্যাদি করে করে বিভিন্নভাবে পার্বত্য বাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
‘কাপ্তাই লেক’ প্রকল্প নির্মাণের কারণে প্রায় ১ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো। এই এক ১ লক্ষ লোকের পরিবার সংখ্যা ছিলো প্রায় ১৮ হাজার। কৃষি জমির অভাবে সকলকে পুনর্বাসন সম্ভবপর হয়ে উঠে নি। শেষমেশ ৪০ হাজার পার্বত্য বাসী নির্যাতিত হয়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়।
জিয়াউর রহমানের শাসনকালে ১৯৭৯ – ১৯৮৩ সালের মাঝামাঝিতে প্রায় ৪ লক্ষ বাঙালিকে পুনর্বাসনের জন্য নিয়ে আসা হয়। এসব বাঙালিরা পার্বত্য বাসীদের জমিজমাতে হস্তক্ষেপ শুরু করলে শান্তি বাহিনীর সদস্যরা স্যাটেলার বাঙালিদের উপর আক্রমণ শুরু করে এবং সেটা এ-দেশের সেনা বাহিনীর জন্য শাপে বর হিসেবে দেখা দেয়। ফলে পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে স্যাটেলার বাঙালিদের সহযোগিতায় শান্তিবাহিনী এবং পার্বত্য বাসীদের উপর শুরু করা হয় পাল্টা আক্রমণ। এতে করে অনেক পাহাড়ি, লারমা পরিবারের সদস্য ও পার্বত্য বাসী নিহত হয় এবং প্রাণ বাঁচাতে অনেক পার্বত্য বাসী ভারতের ত্রিপুরা এবং মিজোরাম রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়, চুক্তির পর কাগজে কলমে কিছু পরিবার ফিরে আসলেও বেশীর ভাগ পরিবার এখনো ভারতে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছে।
জিয়ার পর সেনাশাসক এরশাদের আমলে হাজার হাজার পার্বত্য বাসী ভারতে আশ্রয় নিলে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অভ্যন্তরে হাজার হাজার পার্বত্য বাসী উদ্বাস্তু হলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষন করতে সম্মত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)। পার্বত্য এলাকার প্রায় সকল সম্প্রদায় অনেক মানবাধিকার সংগঠনের দৃষ্টিতে আসে।
এরশাদ এই সমস্যাকে সমাধান করতে উদ্যোগী হয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেন তৎকালীন পরিকল্পনা মন্ত্রী এয়ার মার্শাল (অবঃ) এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম ছিলেন পার্বত্য বাসীদের বিশেষ সুবিধা দানের ঘোর বিরোধী। সময়টা যেহেতু সামরিক শাসনের ছিল তাই এ কে খন্দকারের ইচ্ছে থাকলেও তিনি কিছুই করতে পারেননি।
পরবর্তীতে বিভিন্ন উপায়ে এরশাদ সরকার স্থানীয় জেলা পরিষদ গঠন করতে সম্মত হন (যা এখন পার্বত্য জেলা পরিষদ হিসাবে পরিচিত পার্বত্য জেলা গুলিতে দুর্নীতির আখড়ায় পরিনিত হয়েছে) এবং দেশে বিদেশে প্রচারণা চালাতে থাকেন পার্বত্য বাসীদের ‘স্বায়ত্তশাসন’ দেওয়া হয়েছে এবং সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।
এরপর খালেদা জিয়ার সরকারের আমলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয় নি।
শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। যদিও চুক্তির অনেকগুলো শর্তের মধ্যে একটা ছিলো,‘পার্বত্য পাহাড়িদের এবং বাঙালিদের মধ্যে জমিজমার বিরোধ মীমাংসা করা এবং সরকার অধিকৃত জমি, বাড়ি, ভিটে পূর্বতন মালিকদের নিকট ফেরত দেওয়া।’
এখন চলছে ২০১৬ সাল। শান্তিচুক্তির ১৮ বছর পরে গত ৯ মে ২০১৬ তে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা বলেছেন,’শান্তিচুক্তির অন্য সব শর্ত বাস্তবায়িত হলেও ভূমি সংস্কার এখনও হয় নি।’
শুনে মনে হয়;- “ ক্রীড়ামন্ত্রীর গাড়ির সবই ঠিক আছে শুধু মাঝে মাঝে ব্রেক কাজ করে না।” ওই বিজ্ঞাপনটির মতো।
এই ভূমি সমস্যার সমাধান করতে গেলে অনেক স্যাটেলার যাদেরকে জিয়াউর রহমান কূটচাল চেলে নিয়ে এসেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য বাসীদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার উদ্দেশ্য মাথায় রেখে, তাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আগের জায়গায় রেখে আসতে হবে অথবা তাদের বর্তমান বসতি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। তাই এই ভূমি সমস্যার সমাধান হবে এমন আশা করাটাও নিতান্তই বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়।
অনেকের কাছে হয়তো কাকতালীয় মনে হবে; ১৯৭৬ সালে পুরাতন কোর্ট বিল্ডিং (বর্তমান যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অফিস রয়েছে) রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের রেকড রুমের নথিপত্র অফিসের টিনসহ উড়িয়ে নিয়ে কাপ্তাই হৃদের ক্ষতিগ্রস্থদের সব নথিপত্র নষ্ট হয়ে যায় এছাড়া ১৯৯১ সালের ৭ই মার্চ তারিখে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের অফিসে অগ্নিকান্ড ঘটে এতে পার্বত্য বাসীদের জমিজমার সব রেকর্ডও পুড়ে যায়। এই জমিজমার কাগজপত্র অনেক পার্বত্য বাসীদের কাছে রেকর্ড ছিলো না এবং অনেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় হারিয়ে ফেলেছিলেন। উল্লেখ্য জেলা প্রশাসকের অফিস পুড়ে যাওয়ার ঘটনায় কোনো তদন্ত হয়নি এবং কোনো একজন অপরাধীকেও শাস্তির সম্মুখীনও হতে হয়নি। কে জানে শর্ষের মাঝেই আবার ভূত কিনা!
হয়তো অনেক পার্বত্য বাসী তাঁদের জায়গাজমি আর কখনোই ফেরত পাবেন না। অনেকেই আর ফিরতে পারবেন না নিজেদের ভিটেমাটিতে। হয়তো ‘শান্তি চুক্তি’ বাস্তবায়ন সরকারের পক্ষে আর কখনও সম্ভবপর হবেই না। যেহেতু এখন ধর্ম আর পাহাড়ি–বাঙ্গালীর প্রধান রাজনৈতিক হাতিয়ার পার্বত্য অঞ্চল।