বুধবার ● ২২ জুন ২০১৬
প্রথম পাতা » আন্তর্জাতিক » এক অচেনা, অনন্য কাশ্মীর
এক অচেনা, অনন্য কাশ্মীর
অনলাইন ডেস্ক :: কাশ্মীর নামটা শুনলেই যেন নেচে ওঠে মন। যে কোনও পর্যটকের কাছেই কাশ্মীরের আকর্ষণ দুর্নিবার। আর বাঙালিদের কাছে তো কাশ্মীরের একটা আলাদা চুম্বকীয় টান আছেই। সেই টানই আমাকে টেনে নিয়ে গেল কাশ্মীরে।
ভোরে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে দিল্লিতে বিমান পরিবর্তন করে দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম শ্রীনগর। ডাললেকের পাশেই অবস্থিত হোটেলে মধ্যাহ্নভোজ সেরে সেই বিকালটা কাটালাম শিকারায় ভেসে লেকের নীল জলে আনন্দবিহার করেই।
পর দিন সকালে গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম ইউসমার্গ-এর উদ্দেশ্যে। এখন যদিও কিছু পর্যটক যাচ্ছেন ইউসমার্গে (পরিচিত পহেলগাঁও-গুলমার্গ-সোনমার্গ সার্কিটের বাইরে), তা-ও সার্বিক বিচারে এখনও যেন অচেনা বা অপরিচিত কাশ্মীরের একটা নির্ভেজাল, নিষ্কলুষ, মধুর সুবাস জড়িয়ে আছে এ জায়গাকে ঘিরে। প্রাতরাশ পর্বটা সারলাম ছানাপোড়া-র (শ্রীনগর থেকে দূরত্ব ৯ কিলোমিটার) জান-বেকারিতে, সদ্য তৈরি হওয়া গরম, নরম ও মুচমুচে বাকরখানি দিয়ে। অপূর্ব স্বাদ সে বাকরখানির। আশ মিটিয়ে খেলাম তো বটেই, রাস্তার জন্য নিয়েও গেলাম আরও কিছু। সঙ্গে বেকারির বিস্কুট ও কেকও কিছু নেওয়া হল।
চাডোরা, নাগম ইত্যাদি ছোট ছোট জনপদের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। জনপদের ফাঁকে ফাঁকেই চোখে পড়ছে উজ্জ্বল হলুদরঙা বিস্তীর্ণ সরষের খেত আর তার নেপথ্যে বরফে মোড়া সফেদ পাহাড়ের মনকাড়া দৃশ্য। কোলাজটা বাস্তবিকই চমৎকার। নাগমের পরই চড়াই রাস্তার শুরু, আর সেই পথ ধরেই এ বারে পৌঁছে গেলাম চারার-ই-শরিফ। নাগম থেকে আসার পথে রাস্তার দু’ধারে চোখে পড়ল প্রচুর আপেল বাগান, তেমনই আমন্ড গাছও দেখতে পেলাম প্রচুর। গাড়িচালক জানাল, এই এলাকাতে উৎকৃষ্ট মানের আপেল উৎপন্ন হয় বেশ ভারী পরিমাণেই। অনেকটা দূর থেকেই দেখতে পাওয়া গেল চারার-ই-শরিফের অভিনব স্থাপত্য।
চারার-ই-শরিফ হল সুফিসাধক শেখ নুরুদ্দিনের সমাধির উপর ১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীররাজ জৈন-উল-আবেদিন নির্মিত মাজার। ভিতরে ঢুকে দেখলাম অনবদ্য সূক্ষ্ম শিল্পকর্মে মোড়া সমাধি মন্দিরে কাঠের দেওয়াল ও ছাদ। তবে ১৯৯৫ সালে জঙ্গি নাশকতায় প্রাচীন স্থাপত্যটি বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরে সম্পূর্ণ নতুন করেই গড়ে তোলা হয়েছে বর্তমান এই কাঠামোটি।
চারার-ই-শরিফ দেখে গাড়ি এ বার ইউসমার্গের যে পথটি ধরল তা এককথায় অপূর্ব। পাইনশোভিত নিরালা সে পথে পাখির কুজন ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। আঁকাবাঁকা এই মনোরম পথটিই ভাললাগার আবেশে পৌছে দিল ইউসমার্গে। ইউসমার্গ ঢোকার সময়েই চোখে পড়ল এক বিরাট জলাশয়। দুধগঙ্গা নদীর জল থেকেই সৃষ্ট হয়েছে এই জলাধার। পাইনে মোড়া সবুজ পশ্চাদপটে বৈচিত্র এনেছে ইতিউতি জমে থাকা বরফের শুভ্র ঝলকানি।
পীরপাঞ্জাল পর্বতশ্রেণি দিয়ে ঘেরা ইউসমার্গের উচ্চতা হল ২৩৯৬ মিটার। শ্রীনগর থেকে দূরত্ব মাত্রই ৪৭ কিলোমিটার। ফার, পাইনে ঘেরা গোটা উপত্যকাটিই মখমলি সবুজ ঘাসে আবৃত। আর এপ্রিলের এই সময়ে আসাতে আমার অতিরিক্ত প্রাপ্তি হল উপত্যকার তুষারযোগ। শোনা যায়, সুলতানি শাসনকালে, কাশ্মীরের সুলতান ইউসুফ শাহের খুব পছন্দের অবসরযাপনের জায়গা ছিল এটি। তাঁর ইউসুফ নাম থেকেই এ জায়গার নাম করা হয়েছে ইউসমার্গ।
গাড়ি যে জায়গাটায় নামিয়ে দিল তার পাশেই রয়েছে এক সুন্দর ক্যাফেটেরিয়া। ঠান্ডার মধ্যে গরম কফির উষ্ণতা প্রাণকে যতটা আরাম দিল, তার থেকেও চোখ বেশি আরাম পেল অনিন্দ্যসুন্দর এই উপত্যকার অসাধারণ দৃশ্যে। দুধগঙ্গা নদী (জলের রং দুধসাদা, তাই নদীর নামও হয়েছে দুধগঙ্গা) অপরূপ নৃত্যবিভঙ্গে বয়ে যাচ্ছে উপত্যকার বুক চিরে। ঢেউ খেলানো নয়নাভিরাম সবুজ উপত্যকায় মনের সুখে চরে বেড়াচ্ছে নধরকান্তি ভেড়ার পাল। আর চারপাশের ফার, পাইনের ঠাসবুনোটের মধ্যেও নজর টানল রংবেরঙের সুদৃশ্য কিছু কটেজ। ইচ্ছে করলে অপার শান্তির বাতাবরণে অবস্থিত এই সুন্দর উপত্যকায় কয়েকটি দিন কাটাতেও পারেন পর্যটকেরা। হাতে যথেষ্ট সময় থাকলে তখন ঘোড়ায় চেপে ঘুরেও আসতে পারবেন কাছাকাছি দ্রষ্টব্য স্থানগুলি। নীলনাগ লেক, দুধগঙ্গা (সঙ্গসফেদ তুষারশৃঙ্গ থেকে সৃষ্ট হয়েছে এই নদী) ভিউ পয়েন্ট, ‘হে জন’ দরগা ইত্যাদি জায়গাগুলি ঘুরে নেওয়া যায় অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার হয়ে। পরিষ্কার আবহাওয়ায় ইউসমার্গ থেকেই দিব্যি দেখা যায় মাউন্ট টাট্টাকোটি (৪৭২৫ মিটার), মাউন্ট রোমেস হং (৫০০০ মিটার), সানসেট পিক (৪৭৪৫ মিটার) প্রভৃতি তুষারশৃঙ্গ।
মধ্যাহ্নভোজ সেরে বিকেল অবধি ঘুরে বেড়ালাম ইউসমার্গের সেই অপরূপ নিসর্গে। অকৃপণ প্রকৃতির অনাবিল লাবণ্য পর্যটক মনকে যেন একেবারে সম্পৃক্ত করে দিল। আলো থাকতে থাকতেই তাই যখন শ্রীনগর ফিরতে হবে বলে গাড়িতে উঠলাম, তখন অনিচ্ছুক মনে ধ্বনিত হল এক অনিবার্য গুঞ্জরণ— ‘মধুর তোমার শেষ যে না পাই, প্রহর হল শেষ’।
কী ভাবে যাবেন: শ্রীনগর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরবর্তী ইউসমার্গ পৌঁছতে গাড়িতে সময় নেবে ঘণ্টা দুয়েক। গাড়িভাড়া পড়বে ২৫০০-৩০০০ টাকা (পুরো গাড়ি ভাড়া করলে)।
কোথায় থাকবেন: শ্রীনগরের হোটেল থেকেই ঘুরে আসতে পারেন ইউসমার্গ। থাকতে চাইলে সরকারি ট্যুরিজমের লজে রাত্রিবাসের বন্দোবস্ত হতে পারে। দ্বিশয্যা ঘরের ভাড়া ১০০০-৬০০০ টাকা।
হোটেল বুকিং বা গাড়ি বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন সরাসরি কাশ্মীরে—
মহঃ ইউনিস ওয়ানি, ওয়ানি ট্র্যাভেলস। ফোন: ০৯৫৯৬১-৯২১৩৬, ০৮৪৯১৮-২৬১৬৮।
হোটেল, গাড়ি বা অন্য যে কোনও প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য কলকাতা যোগাযোগ: আবদুল কায়েম, অধিকর্তা, জম্মু-কাশ্মীর ট্যুরিজম, কলকাতা শাখা, ফোন: ৯১০৩০-৮৭৫৫০, ৮০১৭৯-৩৭৪২৬।