রবিবার ● ২৬ জুন ২০১৬
প্রথম পাতা » অপরাধ » ঝিনাইদহে পুরোহিত হত্যায় এখন আতঙ্কের জনপদে পরিনত
ঝিনাইদহে পুরোহিত হত্যায় এখন আতঙ্কের জনপদে পরিনত
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি :: (১২ আষাঢ় ১৪২৩ বাংলা : বাংলাদেশ সময় রাত ৯.৪৮মিঃ) পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী খুন হওয়ার পর ঝিনাইদহের নলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিণত হয়েছে আতঙ্কের জনপদে৷ শুধু রাতে নয়, দিনের বেলাতেও মানুষ একা চলতে ভয় পাচ্ছে৷ হিন্দু-অধ্যুষিত এই এলাকায় ২০টির মতো ছোট-বড় মন্দির আছে৷ পুরোহিত হত্যার পর এসব মন্দিরে নিয়মিত পূজা-অর্চনা চলছে এখন সীমিত আকারে৷ ১০ জুন এই ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকায় জামাইষষ্ঠীর পূজাও হয়নি এখানে৷
সমপ্রতি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা ঝিনাইদহের সদর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের করাতিপাড়া, নারায়ণপুর, খেদাপাড়া, সোনাইখালী, নলডাঙ্গা, ডাকাতিয়াসহ আরও কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ভয় ও আতঙ্কের এ চিত্র চোখে পড়েছে৷
করাতিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী নলডাঙ্গা বাজারে একটি দুর্গামন্দিরের পুরোহিত ছিলেন৷ ৭২ বছরের প্রবীণ এই পুরোহিতকে ৭ জুন সকালে মহিষেরভাগাড় নামক স্থানে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা৷ দেশে সামপ্রতিক সময়ে এ ধরনের অন্যান্য হত্যাকান্ডের মতো এ ঘটনারও দায় স্বীকার করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস (ইসলামিক স্টেট)৷ এরপর সরকারের শীর্ষ কয়েকজন মন্ত্রী-সাংসদসহ ক্ষমতাসীন ১৪-দলীয় জোটের অনেকে ওই এলাকায় গিয়ে হিন্দু সমপ্রদায়কে আশ্বস্ত করেছে৷ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনও তত্পর৷ তারপরও সেখানকার বাসিন্দাদের ভীতি কাটছে না৷
নলডাঙ্গায় অবস্থিত শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী মায়ের বাড়ি নামের মন্দিরটি সাড়ে তিন শ বছরের বেশি পুরোনো৷ আনন্দ গোপাল খুন হওয়ার পর পাঁচ কিলোমিটার দূরের এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রামকৃষ্ণ ব্যানার্জি ভয়ে এলাকা ছাড়েন৷ তিনি মন্দিরে তালা দিয়ে অন্যত্র চলে যান৷ ফলে কয়েক দিন মন্দিরের নিয়মিত পূজা-অর্চনা পুরোপুরি বন্ধ ছিল৷ পরে পুরোহিত রামকৃষ্ণ ব্যানার্জিকে সবাই গিয়ে নিয়ে আসেন৷ এখন সীমিত পরিসরে পূজা-অর্চনা চালু করা হলেও সবাই উদ্বেগ-আতঙ্কের মধ্যে আছেন৷ পুরোহিত সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হন না৷
সিদ্ধেশ্বরী সর্বজনীন পূজা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মন্টু গোপাল বাবু বলেন, ‘সবাই ভয়ে আছে৷ পুজো-আচ্চা বন্ধ হবার জোগাড়৷ পুরোহিত রামকৃষ্ণ বাবুকে এখন পাহারা দিয়া বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হয়৷ ‘সইন্ধের পর ভক্তরাও আসতে চায় না৷’ তিনি বলেন, সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবারের পূজায় এই মন্দিরে তিন হাজার মানুষের জন্য ভোগের আয়োজন হতো৷ এখন তা নেমে এসেছে পঞ্চাশের কোঠায়৷
মন্দিরের প্রধান ফটকের সামনে মন্টু গোপালের সঙ্গে যখন কথা বলার সময় তখন পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন মুসা শেখ৷ মন্দিরসংলগ্ন বেগবতী নদীর ওপারে খেদাপাড়া গ্রামের তাঁর বাড়ি৷
তিনি জানালেন, পুরোহিত আনন্দ গোপাল হত্যার ঘটনা শুধু হিন্দুদের নয়, ওই এলাকার মুসলমানদেরও কাঁপিয়ে দিয়েছে৷
করাতিপাড়ায় পুরোহিত আনন্দ গোপালের বাড়ির পাশের ছোট মন্দিরটিতে সাপ্তাহিক হরিসভায় ৫০ থেকে ৬০ জন অংশ নিতেন৷ তিনি খুন হওয়ার পর ভয়ে লোকজন না আসায় এখানে নামকীর্তন আয়োজন করা সম্ভব হয়নি বলে জানালেন তাঁর প্রতিবেশী ফণীভূষণ ৷
ছোট মন্দিরটির দেয়াল পাকা ইটের৷ টিনের ছাউনি দেওয়া বর্ধিতাংশেই হতো হরিনামের আয়োজন৷ এখন মেঝেতে ধুলার সত্মর জমেছে৷ ফণীভূষণ বলেন, ‘আমরা কেউ মন খুলে বেড়াতে পারছিনা৷ উনি (আনন্দ গোপাল) ছিলেন ২২ গ্রামের পুরোহিত৷ নলডাঙ্গার হিন্দু-মোসলমান সবাই তাঁরে মান্য করত৷ সেই লোকের যদি এমন মৃত্যু হয়, তাহলে আমাদের কী হবে ?’
গত মঙ্গলবার দুপুরে আনন্দ গোপালের বাড়ির সামনে বসে কথা হয় পরিবারের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে৷ আনন্দ গোপালের ছোট বোন রাধারানী মুখার্জি বলেন, ‘ভয় হচ্ছে দাদা৷ কী একটা বিভীষিকা! খালি মনের মধ্যে গলাকাটা মানুষটা আকৃতি পাচ্ছে৷’
এই বাড়ির কাছে রাসত্মার ডান পাশে একটি পুকুরের পাড়ে ভজন কর্মকারের কামারশালা৷ সেখানে পাটি পেতে শুয়ে-বসে ছিলেন স্থানীয় মসজিদের মুয়াজ্জিন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী মোলস্না, কাঠমিস্ত্রি শানত্মিপদ বিশ্বাস, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অশোক রায়সহ আরও তিনজন কৃষিজীবী৷
মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী মোল্লা জানান, আনন্দ গোপাল খুন হওয়ার পর তিনি নিজেও নিরাপদ বোধ করছেন না৷ তিনি জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘হিন্দু-মোসলমান বলে কথা নেই৷ ওরা তো কারো ছাড়ছে না৷’
নারায়ণপুরের বিপুল কুমার বাগচী লাঙ্গলবাদ চৌদ্দপলস্নী মহাশ্মশানের পুরোহিত৷ নারায়ণপুর ও করাতিপাড়ার মাঝামাঝি মহিষেরভাগাড়ে আনন্দ গোপাল খুন হওয়ার পর প্রথম কয়েক দিন তিনি বাড়ি ফিরতেই সাহস পাননি৷ এখন বাড়ি এলে দিনের বেলাতেই আবার লাঙ্গলবাদে ফিরে যান৷ বিপুল কুমার বাগচী বলেন, ‘লাঙ্গলবাদের মানুষ আমাক সাহস দিচ্ছে৷ পুলিশ-প্রশাসনও সক্রিয়৷ তারপরও ভয় কাটছে না৷’ তিনি জানান, নারায়ণপুর রাস মন্দিরের পুরোহিতও ভয়ে মন্দিরে যেতে চাচ্ছে না৷
নলডাঙ্গা ইউনিয়নের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ বলেন, ‘আমরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছি৷ মানুষকে আশ্বসত্ম করার চেষ্টা করছি৷ হত্যাকান্ডের পর জেলার ৩৬৫টি পূজা মন্দির ও গির্জায় সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে৷ বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে৷ পুলিশের নিয়মিত টহল চালু আছে৷’
এদিকে পুরোহিত খুন হওয়ার ১৩ দিন পর ২১ জুন রাতে ঝিনাইদহ পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, আগের রাতে ঢাকার গাবতলী থেকে এনামুল হক (২৬) নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, যিনি ছাত্রশিবিরের ঝিনাইদহ পৌর এলাকার ২ নম্বর ওয়ার্ড শাখার সেক্রেটারি৷ এনামুল ওই দিন বিকেলে পুরোহিত হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন বলে জানান পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন ৷
এনামুল সদর উপজেলার আড়মুখ গ্রামের ফজলুল হক জোয়ার্দারের ছেলে৷ তাঁর বড় ভাইয়ের দাবি, এ ঘটনার সঙ্গে তাঁর ভাই জড়িত নয়৷ ঘটনার আগে থেকে এনামুল চাকরির খোঁজে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন৷ ১৬ জুন ঝিনাইদহ থেকে এনামুলের এক বন্ধুকে নিয়ে পুলিশ ঢাকায় গিয়ে তাঁকে আটক করে৷ এনামুলের বড় ভাই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি৷
পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করে জবানবন্দি পাওয়ার দাবি করলেও নিহত আনন্দ গোপালের নিকটাত্মীয়রা সন্তুষ্ট নন৷ তাঁর ছোট ভাই গোবিন্দ গোপাল গাঙ্গুলী বলেন, ‘একজনরে ধরতে পারলে তো আরও দুইজনরে ধরতে পারার কথা৷ তাদের কথা তো কিছু শুনলাম না৷’
অবশ্য তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে কিছু বলতে রাজি হননি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ৷ তিনি বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তাধীন আছে৷ এ মুহূর্তে সবকিছু বলা সম্ভব না৷’