শুক্রবার ● ২২ জুলাই ২০১৬
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » তিন হাজার পরিবারের জীবন চলে খলসুনী বিক্রি করে
তিন হাজার পরিবারের জীবন চলে খলসুনী বিক্রি করে
চাটমোহর প্রতিনিধি :: (৭ শ্রাবণ ১৪২৩ বাংলা: বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬.৫০মিঃ) চলনবিল অধ্যূষিত পাবনার চাটমোহর ও নাটোরের গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলার প্রায় তিন হাজার পরিবারের জীবন জীবিকার নির্বাহ করছে খলসুনী বিক্রি করে। (মাছ ধরার বাঁশের তৈরী ফাঁদ) স্থানীয় ভাষায় একে বাসুন বা ধুদিও বলা হয়। খলসুনী তৈরী করে চলনবিল এলাকার বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি করে থাকেন এসব পরিবারের সদস্যরা।
খলসুনী তৈরীর প্রধান উপকরণ হলো তল্লা বাঁশ, তালের ডাগুরের আঁশ ও সূতা। প্রতি পিস তালের ডাগুর ২০ থেকে ২৫ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। বছরে একটি তালগাছ থেকে ২০ টির মতো ডাগুর পাওয়া যায়। পাতার অংশ দিয়ে পাখা বানানো হয় এবং গোড়ার অংশ মেশিনে পিশে বের করা হয় চিকন আাঁশ। বাঁশ থেকে তৈরী চিকন চিকন শলাকা এ আঁশ দিয়ে বান দেয়া হয়।
বড়াইগ্রাম উপজেলার চামটা গ্রামের মহরম আলী জানায়, এক জোড়া খলসুনী তৈরী করতে বাঁশ, সূতা ও আশ বাবদ খরচ হয় ১শ টাকা। একজন শ্রমিক তিন দিনে দুইটি খলসুনী তৈরী করতে পারেন। তিন দিনের পারিশ্রমিক ৯শ টাকা ধরলে এক জোড়া খলসুনী তৈরীতে খরচ পরে ১ হাজার টাকা। গাড়ি ভাড়া দিয়ে হাটে এনে একজোড়া খলসুনী ১ হাজার ২শ টাকায় বিক্রি করা যায়। তবে আকার ভেদে এক জোড়া খলসুনী ৬শ থেকে ১৫শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে।
পরিবারের নারী পুরুষ ছেলে মেয়ে সবাই খলসুনী তৈরীর এক একজন দক্ষ কারিগর। পরিবারের নারীরা বাড়ির কাজের পাশাপাশি এবং স্কুল কলেজে অধ্যয়নরত ছেলে মেয়েরা পড়া লেখার পাশাপাশি খলসুনী তৈরীর কাজে সহায়তা করে থাকেন।
কোথায় পাওয়া যায় : চলনবিল এলাকার চাটমোহর উপজেলার উত্তর পশ্চিম এলাকার ঝাঁকরা, দয়রামপুর, বড়াইগ্রাম উপজেলার চামটা, দাঁড়িকুশি, ড্যাঙ্গাপাড়া, প্রতাপপুর, শ্রীরামপুর, তারানগর গুরুদাসপুর উপজেলার ধারাবারিষা, খাকরাদহ, চরকাদহ, সিধুলী, তালবাড়িয়া, উদবাড়িয়া ও নয়াবাজার এলাকায় ব্যাপকভাবে সারা বছর খলসুনী তৈরীর কাজ হয়ে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে খুব একটা বিক্রি না হওয়ায় এসময় তৈরীকৃত খলসুনী গুদামজাত করে রাখা হয়। আষাড় মাস থেকে শুরু হয় খলসুনী বিক্রির ভরা মৌসুম।
চলনবিল এলাকার ধারাবারিষা, চাঁচকৈড়, চাটমোহরের অমৃতকুন্ডা, মির্জাপুর, বড়াইগ্রামের জোনাইল ও মৌখাড়া হাটে ভোর বেলা থেকে বিক্রির উদ্দেশ্যে খলসুনী নিয়ে যান বিক্রেতারা। এসব হাটে পাইকারী ও খুচরা ক্রয় বিক্রয় হয় খলসুনী। ঢাকা, সিলেট, টাঙ্গাইল, চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা ও থানা শহর থেকে পাইকাররা এসে কিনে ট্রাকযোগে গন্তব্যে নিয়ে যান।
পাবনার আতাইকুলা এলাকার খলসুনীর ব্যাপারী জামাত আলী রবিবার অমৃতকুন্ডা হাটে এসেছিলেন খলসুনী কিনতে। তিনি জানান, চাটমোহর থেকে পাবনার আতাইকুলায় খলসুনী নিয়ে যেতে আটঘরিয়া, টেবুনিয়া, পাবনা সদর, পাবনা ক্যাডেট কলেজের পাশে বকশীপাড়া এবং আতাইকুলাতে মোট পাঁচটি পয়েন্টে ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় চাঁদাবাজদের।
চলনবিলের অধিকাংশ হাট বাজারে খলসুনী ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের নিকট থেকে রশীদ বিহীন খাজনা নেওয়া হয়। অমৃতকুন্ডা হাটে রশীদ দিলেও রশীদে ইজারার পরিমাণ উল্লেখ করেন না ইজারাদাররা। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে এক জোড়া খলসুনীতে ৩০ টাকা ইজারা বাবদ নিয়ে থাকেন অমৃতকুন্ডা হাটের ইজারাদাররা। তাদের চাহিদা মাফিক খাজনা না দিলে ক্রেতাদের সাথে দূর্ব্যবহার করেন।
নদ নদী ডোবা খাল বিলের স্বল্প পানিতে খলসুনী পেতে হাজার হাজার জেলে চিংড়ি, খলিশা, চাঁদা, গুচি, পুটি, মৌসী, ডানকিনেসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ ধরে হাট বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
খলসুনী প্রস্তুতকারী দাঁড়িকুশী গ্রামের আব্দুল মতিন, চামটা গ্রামের মহরম আলীসহ কয়েকজন জানান, জন্মসূত্রেই তারা খলসুনী তৈরী করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। আষাড় থেকে কার্তিক এ পাঁচ মাস খলসুনী বিক্রির ভরা মৌসুম। শ্রমিক এবং উপকরণের দাম বাড়ায় তাদের খুব একটা লাভ না হলেও অন্যের বাড়িতে শ্রম বিক্রি করতে হচ্ছে না এটাই তাদের কাছে পরম তৃপ্তির ব্যাপার। এ কাজ করে নিজের পারিশ্রমিক হিসেবে দিন ৩শ টাকার মতো থাকছে তাদের, যা দিয়ে কোন মতে খেয়ে পরে দিনাতিপাত করছেন।