রবিবার ● ২৪ জুলাই ২০১৬
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন দক্ষ ও শিক্ষিত চালক
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন দক্ষ ও শিক্ষিত চালক
লায়ন মোঃ গনি মিয়া বাবুল :: সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর তালিকায় প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম৷ অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করছে সারা জীবনের জন্যে৷ অথচ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থাকলেও কোনভাবেই তা সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকরি ভূমিকা পালন করতে পারছে না৷ এতে সড়ক-মহাসড়কে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল৷
প্রতিবছর বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ১০ লাখ লোক জীবন হারায় এবং ৫০ লাখ প্রতিবন্ধী হয়৷ বাংলাদেশে সর্বমোট মৃত্যুহারের সর্বোচ্চ শতকরা ১৪ ভাগ মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনায়৷ বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমান প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা৷ যা জিডিপি’র প্রায় শতকরা ২ ভাগ৷ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের গাড়ির সংখ্যা ও মৃত্যুর আনুপাতিক হার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশী৷ আমেরিকায় প্রতি ১০ হাজার গাড়ি দুইজন লোকের মৃত্যু ঘটায়৷ ওরা নিয়ম মেনে গাড়ি চালায়, ওদের রাস্তা সু-পরিসর এবং সেখানে ভূয়া লাইসেন্সের ড্রাইভার নেই ৷ সর্বপরী ওদের ট্রাফিক পুলিশ দুর্নীতিপরায়ন নয় এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত৷ আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার চিত্রটি কেমন দেখা যাক৷ পাকিস্তানের প্রতি ১০ হাজার গাড়ির বিপরীতে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হয় ১৯ জনের, ভারতের ২৫ জনের৷ অথচ বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার গাড়ি ৬০ জনের মৃত্যু ঘটায়৷ বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজার লোকের আছে মাত্র দুটি গাড়ি৷ নেপালে প্রতি ১হাজার লোকের আছে ৯টি গাড়ি, ভারতে ১২টি আর পাকিস্তানে প্রায় ১৪টি৷ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে গাড়ি কম৷ পাকিস্তানে গাড়ির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশী৷ আমেরিকার মত উন্নত দেশের কথা নাইবা আনলাম৷ সেখানে শতকরা ৭৫ জন লোকেরই গাড়ি আছে৷ বিশ্বাস করার মত নয়, আমাদের হাসপাতালগুলো ২৫ ভাগ বিছানা দখলে থাকে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীরা৷
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বাংলাদেশে অত্যন্ত উদ্বেগজনক৷ জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় এটি এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা৷ একজন দক্ষ চালক সড়ক দুর্ঘটনারোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে৷ তবে আমাদের অন্য কারণগুলোও বিবেচনায় আনতে হবে৷ গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটি, সড়কের অবস্থা, পথচারীদের বেপরোয়া চলাচলও সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে৷
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যতই ব্যবস্থা আমরা নিই না কেন, দুর্ঘটনা কমাতে পারবো কিন্তু বন্ধ করতে পারবো না৷ তাই দুর্ঘটনা প্রতিরোধের পাশাপাশি দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু ও পঙ্গুত্ব রোধে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনতে হবে৷ গুরুত্ব দিতে হবে প্রাথমিক ও জরুরী পরিচর্যার৷ দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাগুলোকে চিহ্নিত করে সে অঞ্চলের কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন হেলথ সেন্টার, সাব সেন্টার, উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যকর্মীদের দুর্ঘটনা পরবর্তী করণীয় সম্বন্ধে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে৷ সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত করতে হবে৷
দেশে বৈধ গাড়ীর সংখ্যা ১৩ লাখেরও বেশী৷ কিন্তু এই গাড়ির জন্য বৈধ চালকের সংখ্যা মাত্র ৮ লাখ৷ বাকী গাড়ি যাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, তাদের লাইসেন্স বৈধ নয়৷ অনেকের একাধিক লাইসেন্সও আছে ৷ স্বাভাবিকভাবেই এই অবৈধ লাইসেন্সধারী গাড়ী চালকরা গাড়ি চালাতে গিয়ে আইনের ধার ধারে না, সঠিক ভাবে প্রশিৰিত নন এমন চালকের সংখ্যাও কম নয়৷
সম্প্রতি হাইকোর্ট এক রায়ে, গাড়ী চালকের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এস.এস.সি পাশ নির্ধারণ করে। এই সিদ্ধান্ত পাঁচ বছরের মধ্যে কার্যকর করার পদক্ষেপ নিতে হবে৷ মহাসড়কে রোড ডিভাইডার তৈরী ও পথচারী চলাচলের প্রয়োজনীয় স্থানে আন্ডারপাস ও স্কুল সিলেবাসে ট্রাফিক নিয়ম অন্তভূর্ক্ত করার নির্দেশনাও দিয়েছে আদালত৷ নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারকে মোটরযান আইনে বিভিন্ন অপরাধে সাজা ও জরিমানা বৃদ্ধি করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে৷ একই সঙ্গে দুর্ঘটনা রোধে আদালতের নির্দেশে গঠিত কমিটির সুপারিশগুলি কার্যকর করতে হবে৷
চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো, দ্রুত গাড়ি চালিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা, সরকারি অব্যবস্থাপনায় গাড়ী চালানোর অনুমতিপত্র প্রদান ইত্যাদি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ৷ এইসব দুর্নীতির দায় কি শুধুমাত্র চালকদের উপরই বর্তাবে ? নাকি সংশ্লিষ্ট পরিবহন কোম্পানীগুলোকেও দুর্ঘটনার দায়ভার নিতে হবে ?
কোম্পানীর অধীনে যেসব চালকরা গাড়ি চালান সেসব ক্ষেত্রে পরিবহন কোম্পানীগুলোও তাদের দায় থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন না৷ দেখতে হবে গাড়ির ফিটনেস ছিল কিনা ? তারা কতোটা শারীরিকভাবে এবং মানসিকভাবে গাড়ি চালানোর জন্য প্রস্তুত ? এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পরিবহন কোম্পানীগুলোকে যাত্রার পূর্বে অবশ্যই যাচাই করে নিতে হবে৷
বর্তমান সরকার ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০২০ সালের মধ্যে মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে৷ এ পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি সড়ক বিভাগ মহাসড়কের ১৪৪টি স্থানকে দুর্ঘটনা প্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করে এর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৬৫ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে৷ ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য বিভাগীয় এলাকায় ‘ইমপ্রুভমেন্ট অব রোড সেফটি অ্যাট ব্যাক স্পটস অন ন্যাশনাল হাইওয়েজ’ শীর্ষক প্রকল্পটির সিংহভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে৷
আমাদের দেশে ড্রাইভিংকে এখনও নিম্নমানের পেশা হিসেবে দেখা হয়৷ বাস ও ট্রাক ড্রাইভাররা দিনের ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১৬-১৮ ঘন্টাই পরিশ্রম করেন৷ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এভাবে পথেঘাটে থাকতে থাকতে তাদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরী হয়৷ তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন৷ যার ফলে তারা তাদের পেশায় মনোনিবেশ করতে পারেন না৷ এটিও দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ৷
ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে চালকদের পেশাগত মানোন্নয়নের পাশাপাশি তাদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে৷ এছাড়া চালকদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে৷ ট্রাফিক আইন মেনে ভালভাবে গাড়ি চালাতে চালকের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা আবশ্যক৷ এই সকল বিষয়ে গাড়ির মালিক ও শ্রমিক সংগঠন এবং সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে৷ সহনীয় মাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে প্রয়োজন দক্ষ ও শিক্ষিত গাড়ী চালক৷ এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী৷
লেখক : শিক্ষক, কলাম লেখক, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক