সোমবার ● ১৫ আগস্ট ২০১৬
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » গাইবান্ধার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হরিজনদের জীবনচিত্র
গাইবান্ধার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হরিজনদের জীবনচিত্র
রাজেস বাঁসফোড় :: যতদুর জানা যায়, ১৯৪৭ এ ভারত বিভাগের আগে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসন পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন শহরের বর্জ্য- আবর্জনা পরিস্কার করার জন্য
ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজনকে নানা সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে এ অঞ্চলে নিয়ে আসে। সেই থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটি বংশপরম্পরায় করে আসছে। অন্তহীন শ্রম দেয়া হরিজন সম্প্রদায়ের লোকজন স্থান বিশেষে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তথা উচ্চবর্ণ ও শ্রেণীর মানুষের কাছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, মেথর, সুইপার, হরিজন বা দলিত নামে পরিচিত।
অনেকের মতে হরিজন বলতে মোট আটটি গোত্রের মানুষকে বোঝানো হয়। বর্ণের
ধারাবাহিকতা অনুসারে এরা প্রাচীন ভারতের শ্রম বিভাজনের ইতিহাস অনুযায়ী শূদ্র বর্ণের অন্তর্গত। এমনিতেই আভিধানিক অর্থে দলিত বলতে মর্দিত বা পিষ্ঠ ইত্যাদি নেতিবাচক শব্দগুলোকে বুঝায়। ব্যাপক অর্থে দলিত শব্দটির ঐতিহ্যগত অর্থ হলো শোচনীয় অবস্থায় পতিত, দারিদ্র জর্জরিত কিংবা অপমান ও অবমাননার শিকার
মানুষ। দলিত শব্দটি ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের মারাঠি ভাষা থেকে এসেছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো প্রকৃতপক্ষেই দলিত জনগোষ্ঠী ধর্মের নামে সামাজিক, অর্থনৈতিক,
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে শোষিত জনগোষ্ঠী। কারো কারো মতে ড. ভিমরাও আম্বেদকার দলিত শব্দটির জনক। হরিজন শব্দটির অর্থ হরির জন বা ঈশ্বরের সন্তান।
এদেরকে হরিজন নাম দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। এই উদ্দেশ্যে যে, ভারতবর্ষের অপরিবর্তনীয় হিন্দু সমাজের কাছে অস্পৃশ্য হিসেবে পরিগণিত এই সব মানুষরা যেন
সামাজিকভাবে যেন একটা ন্যূনতম সম্মানজনক অবস্থান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে।
গাইবান্ধা জেলার ৭টি উপজেলায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাসফোড়, নুনিয়া, ডোম, হেলা, রবিদাস ও পাটনীসহ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীরর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ১০ হাজারের অধিক
জনগোষ্ঠির বাস। গাইান্ধার জেলার এই হরিজন জনগোষ্ঠি অধিকতর জন্মগত ও
পেশার কারণে নানা রকম বৈষম্য, বঞ্চনার ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
গাইবান্ধা জেলার দলিত জনগোষ্ঠি মানুষেরা সকল স্থানে সকল ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম বৈষম বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। গাইবান্ধা জেলা সদরসহ সকল উপজেলায় ও ইউনিয়ন পর্যায়ে জন্মগত এবং পেশার কারণে অষ্পৃশ্যতা এবং অবজ্ঞা ব্যাপক ভাবে বিদ্যমান।
যেন স্বাধীন একটি দেশের মাঝে আর একটি দেশের মানুষ এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজনরা, ভিন্ন ধরনের একটি আইন শুধু হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য জারি আছে।
হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষগুলো হোটেল রেষ্টুরেন্টে প্রবেশের অধিকার পায় না। তাদের খাবার খেতে হয় খবরের কাগজে করে রাস্তায় ও রেললাইনের পাশে কুকুর বা ময়লা আবর্জনার পাশে বসে। হরিজন সম্প্রদায়ের কেউ এর প্রতিবাদ করলে অপমান মারধর ও চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
সাঘাটা উপজেলার বোনারপাড়া গত ১০ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে রাত আনুমানিক ১০টায় বাড়ির সাথে রেল ষ্টেশনের এক দোকানে রুটি কিনতে যায় দলিত বাসফোড় সম্প্রদায়ের এক যুবক রাজেস বাসফোড় সে জানে তাকে দোকানে প্লেটে ও গ্লাসে
খাবার বা পানি খেতে দেওয়া হবে না। তাই সে দোকানদারকে খাবার খবরের কাগজে দিতে বলে। দোকানের কর্মচারী ঠান্ডা রুটি কাগজে মুড়ে দিতে চাইলে রাজেস বাসফোড় গরম রুটি দিতে বলে রুটি গরম আছে কিনা আঙ্গুল দিয়ে ছুয়ে দেখতে চাইলে দোকানদার বাধা দেয় এবং অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করে, প্রতিবাদ করলে দোকদার ও কর্মচারীসহ আশেপাশের সব দোকানের কর্মচারীরা এসে রাজেস
বাসফোড়কে বেধড়ক ভাবে মারধর করে। নিকটস্থ থানায় অভিযোগ করতে গেলে বিচারের কথা বলে অভিযোগ গ্রহণ করেনি পুলিশ। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উদ্যোগ গ্রহণ করেন সমস্যাটি সমাধানের জন্য । তিনি মারধরের জন্য দোকানের সব কর্মচারী ও দোকান মালিকদের তিরষ্কার করেন এবং একজন দোকান মালিককে কান ধরে উঠবস করানোর মাধ্যমে বিষয়টি মিমাংসা করেন।
কিন্তু অস্পৃশ্যতা ও বৈষম্য নিয়ে কোন কথা বলেননি। এরপর রাজেস বাসফোড় ও তার সকল সম্প্রদায়ের প্রায় সকল সদস্য মিলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট এর সুষ্ঠু বিচারের আবেদন করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সকল ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে জানাবেন বলে জানান। কিন্তু ইউএনও সাহেব আজ অবধি কোন সমাধান করেননি । এ রকম ঘটনা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতার স্বাধ বা সাংবিধানিক ভাবে অধিকারগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ সমানভাবে ভোগ করার কথা থাকলেও হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর আজও পরাধীন রয়ে গেছে, স্বাধীন হতে পারেনি। সহ্য ক্ষমতার কবচ কখনো অন্তরে কখনো শরীরে পরে গুটিশুটি মেরে পড়ে আছে সভ্য মুল ধারার পাশাপাশি। এদের অবস্থা দেখেও দেখার কেউ নেই। বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজন।
গাইবান্ধা জেলার হরিজন সম্প্রদায়ের শিশুরা আগের চেয়ে অধিকহারে বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দারিদ্রতা এবং সামাজিক অবজ্ঞা ও উপেক্ষার কারণে তাদের মধ্যে ড্রপ আউটের হার অত্যাধিক। ফলে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ শিক্ষিত মানুষ খুবই নগন্য। দলিতদের মধ্যে নাজুকতর প্রধান এক ক্ষেত্র হল স্বাস্থ্য। তারা যেহেতু চিরস্থায়ী
দারিদ্র থাকেন সেহেতু স্বাস্থের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। হাট বাজার রাস্তা ড্রেন টয়লেট অফিস আদালত পরিষ্কারের কাজ কোন রকম সুরক্ষা ব্যবস্থা করেন, এক্ষেত্রে সরকারি
বেসরকারি কোন রকমের উদ্যোগ বা ভূমিকা কোনদিন ও নেওয়া হয়নি।
এদের মধ্যে মাদক একটি সমস্যা আছেই। গাইবান্ধা জেলার হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে দারিদ্রতার প্রকট অত্যাধিক। আর্থিক অসমার্থ্যরে কারণে তারা ছেলেমেয়েদের শিক্ষা চালিয়ে যেতে পারে না।
ফলে ওই সন্তানেরাও দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের হতে পারে না। বিভিন্ন এনজিওর ঋণ ও চড়া সুদের চক্রে পড়ে সর্বশান্ত নিঃস্ব হচ্ছেন গাইবান্ধা জেলার সব উপজেলার
হরিজন সম্প্রদায়ের সদস্যরা। গাইবন্ধার জেলায় হরিজন জনগোষ্ঠীর মাঝে বেকারত্ব একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সামাজিক অষ্পৃশ্যতা করণে তারা
প্রথাগত কাজের পরিসর ছেড়ে বেরিয়া আসতে পারছেন না। হরিজনদের মধ্যে পারিবারিক পরিসরে তীব্র পুরুষতান্ত্রিকতার বিদ্যমান। সাধারণভাবে নারী সেখানে সামাজিক ও পারিবারিক পরিমন্ডলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখতে পারে
না। বাল্য বিয়ে ও যৌতুকের প্রার্দুভাব হরিজন কলনীগুলো ব্যাপক গাইবান্ধা জেলার হরিজন সমাজের নারীরা দলিত হওয়ার কারণে সামাজিকভাবে ও নারী হওয়ার
কারণে নিজ সম্প্রদায়ে নিজ পরিবারের কাছে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।
গাইবন্ধা জেলার হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষেরা রেল ষ্টেশনের পাশে হাট বাজারের সাথে একত্রিত হয়ে বসবাস করেন। কিন্তু জীবিকা নির্বাহের জন্য বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করেন। গাইবান্ধা জেলার সকল উপজেলায় হরিজন কলনীগুলো ও যেস্থানে ঘর করে বসবাস করেন তার মালিকানাও তাদের নয়। ফলে স্থানীয় প্রশাসন ও লোকজনের দয়া
দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করে তাদের বাসস্থানের অধিকার। গাইবন্ধা জেলার সর্বত্র হরিজন পরিবারগুলো থাকার জায়গা অতিঅপ্রতুল। অনেকে একটি ঘরে পুর পরিবার বসবাস করছে। গাইবান্ধা জেলার সর্বত্র সকল হরিজনরা ভূমিহীন। হরিজন জনগোষ্টির মানুষেরা চিরস্থায়ী এক উচ্ছেদ আতঙ্কে থাকে। অস্পৃশ্যতার কারণে হরিজনদের পক্ষে কলোনীর বাইরে বাসা ভাড়া নেওয়া অসম্ভব। এ জনগোষ্ঠীর প্রায় সকলেই হীনস্বাস্থ্য, ক্ষুধা, বেকারত্ব, অপুষ্টি,জরাজীর্ণ বাসস্থান,দারিদ্র, অভিগম্যতায় বাধা, পানি, পয়ঃনিস্কাশন, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সকল মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
সমাজের একপ্রান্তে পড়ে থাকা লাঞ্ছিত এ জাতিসত্তার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন অন্যান্য সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী থেকে
ভিন্ন ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী। সময়ের কালস্রোতে হরিজনদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক
পরিচয়, ধর্ম, প্রথা, ভাষাসহ সকল ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এদেরকে মেথর, সুইপার, অস্পৃশ্য, অচ্ছুত, দলিত যেভাবে- যেনামেই ডাকুক না কেন বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতির অধিকারী এই জনগোষ্ঠীর আজ পর্যন্ত অবহেলিত এবং বঞ্চিত জনগোষ্ঠী হিসেবেই কোনমতে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। গাইবান্ধার জেলার হরিজন সম্প্রদায়ের সবাই ভোট অধিকার ভোগ করেন। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের আর কোনো অর্জন বা অবদানের সুযোগ একেবারেই নেই। সামাজিক নাগরিক, রাজনৈতিক কোন সংগঠন বা সামাজ কল্যাণ ও উন্নয়নমূলক কোনো কমিটি এবং কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয় না।
সমাজের বিবেকবান মানুষের কাছে আমার প্রশ্ন : মেথর, সুইপার, অস্পৃশ্য, অচ্ছুত, দলিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজন কি মানুষ নয় এবং এদেশের নাগরিক নয় ?
এই জনগোষ্ঠীর প্রায় সকলেই হীনস্বাস্থ্য, ক্ষুধাত্ত, বেকার,(দলিত জনগোষ্ঠীর চাকুরী পায় এখন অন্য জনগোষ্ঠীর লোকজন রাজনৈতিক নেতাদের হাতের ইশারায় বা বড় অংকের ঘুষ লোনদেনের মাধ্যমে) অপুষ্টি,জরাজীর্ণ বাসস্থান,দারিদ্র, অভিগম্যতায় বাধা, পানি, পয়ঃনিস্কাশন, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য সকল মৌলিক নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হরিজনদের প্রতি এটা কি রাষ্ট্রযন্ত্রের মনবাধিকার লংগ্ন নয় ?