বৃহস্পতিবার ● ১৭ নভেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » বিশ্বনাথে বিলুপ্তির পথে কাকতাড়ুয়া
বিশ্বনাথে বিলুপ্তির পথে কাকতাড়ুয়া
মো. আবুল কাশেম, বিশ্বনাথ ( সিলেট ) প্রতিনিধি :: (৩ অগ্রহায়ন ১৪২৩ বাঙলা : বাংলাদেশ সময় রাত ১১.১৬মি.)
ক্রিকেট খেলায় আম্পায়ারের ওয়াইড বল সংকেত প্রদান করার মতো দুই হাত প্রসারিত করে মাসের পর মাস মানুষের প্রতিকী রূপ ধারণ করে বিভিন্ন প্রকার ফসলি জমিতে দাঁড়িয়ে থাকা বস্তুটির নাম কাকতাড়ুয়া। যা সময়ের আবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে।
গ্রাম বাংলার বিভিন্ন প্রকার ফসলি জমিতে পশু-পাখি তাড়ানোর জন্য মানুষের প্রতিকী রূপ নিয়ে একটি কাকতাড়ুয়া জমির মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। দূর থেকে দেখলে যেন মনে হয় কোনো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।
আর এই কাকতাড়ুয়াদের দেখে ওই ফসলে কোনো প্রকার পশু-পাখির উপদ্রব ঘটে না। ফলে ফসলও নষ্ট হয় না। এই নির্ভরতায় গ্রামের কৃষাণ-কৃষাণিরা জমিতে যখন কোনো ফসলের বীজ বপন করেন তখন একটি করে কাকতাড়ুয়া দাঁড় করিয়ে রাখেন। এটি বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে যখন জমিতে আলু, পেঁয়াজ, শসা, খিরা, বেগুন, মরিচ, টমেটো এ জাতীয় ফসল রোপণ করা হয় তখনই এই কাকতাড়ুয়াদের ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কালের পরির্বতে আজ বিশ্বনাথে হারিয়ে যাচ্ছে কাকতাড়–য়া। আগের মতো গ্রামাঞ্চলের ফসলি জমিতে দেখা যায় না কাকতাড়ুয়া।
কাকতাড়ুয়া অন্যান্য পশু-পাখিকে ভয় দেখানোর জন্যে জমিতে রক্ষিত মানুষের প্রতিকৃতি বিশেষ। এর মাধ্যমে পশু-পাখিকে ক্ষেতের ফসল কিংবা বীজের রক্ষণাবেক্ষণের লক্ষ্যে নিরুৎসাহিত করা হয়। ফসলের জন্য ক্ষতিকর পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যেই মূলত জমিতে কাকতাড়ুয়া দাঁড় করানো অবস্থায় রাখা হয়। অনেক ক্ষেত্রে শুধু কাকদের ভয় দেখানোর জন্য অন্য একটা কাক মেরে উঁচু জায়গায় ঝুঁলিয়ে রাখা হয়।
সাধারণত এটি এক প্রকার ফাঁদ হিসেবেও ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে কাকতাড়ুয়া তৈরি করা হয়। সনাতনি ধারায় এটি মানুষের দেহের গঠনের সঙ্গে মিল রেখে পুরনো, পরিত্যক্ত কয়েকটি কাপড় দিয়ে কিম্ভূতকিমাকার বা সঙের ন্যায় সাজানো হয় একে। তারপর কৃষক কর্তৃক জমির মাঝামাঝি স্থানে গর্ত খুঁড়ে খুঁটি হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাখে। এর মাধ্যমে বাতাসের দোলায় কাপড় হাল্কা দুলতে থাকে এবং কাক অথবা চডুইজাতীয় পাখির উৎপাত ও সাম্প্রতিক বীজ বপনের ফলে তাদের খাদ্য সংগ্রহ করা থেকে বিরত রাখার প্রয়াস চালানো হয়।
বসন্তকালে বাগানে কাকের উৎপাত জনিত সমস্যা সৃষ্টি হয় বেশি। কাছাকাছি অবস্থান করায় এ পাখিটি রোপিত বীজ জমিতে নেমে খেয়ে ফেলে। আধুনিক কাকতাড়ুয়া হিসেবে সচরাচর ফাঁদ মানবাকৃতির প্রতিকৃতির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশে কাকতাড়ুয়ার সহজ যে চেহারা দেখা যায়, তা হলো একটা খাড়া লম্বাকৃতির দন্ডের উপরের এক-তৃতীয়াংশে ভূমি সমান্তরালে আড়াআড়ি করে আরেকটি দন্ড বেঁধে দু’পাশে হাত ছড়িয়ে দাঁড়ানো মানুষের আকৃতি তৈরি করা হয়, তারপর এই আকৃতির গায়ে জড়িয়ে দেয়া হয় পুরোন পাঞ্জাবি, কিংবা শার্ট-লুঙ্গি। লম্বাকৃতি দন্ডের উপরের মাথায় রেখে দেয়া হয় দইয়ের পাতলা সানকির মতো মাটির পাতিল। এতে পাতিলের তলা বাইরের দিকে বেরিয়ে থাকে আর একটা মানুষের গোলাকার মুখের আকৃতির মতো দেখায়। কেউ কেউ সেই পাতিলের তলাকে আরো বেশি বাস্তবসম্মত করতে সেখানে চোখ-মুখ এঁকে মানুষের আদল স্পষ্ট করেন। তবে অনেক স্থানে ধর্মীয় কিংবা স্থানীয় আজন্ম লালিত বিশ্বাসের প্রেক্ষিতে পাতিলের তলায় বিভিন্ন শুভ-নকশা আঁকা দেখা যায় কখনো গোল গোল বুটি, কখনো চারকোনো ছক ইত্যাদি এঁকে মাটির সানকি দিয়ে ফসলের সু-উৎপাদন কামনা করা হয়। এছাড়াও কেউ হাতের সঙ্গে একটা পুরোনো ঝাড়ু, পুরোনো স্যান্ডেল বেঁধে রাখেন।
এ বিষয়ে স্থানীয় কারিকোনা গ্রামের কৃষক ওয়াব আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে প্রায় ফসলি জমিতে এই কাকতাড়ুয়ার ব্যবহার দেখা যেতো। এখন জমির চাষাবাদও কমে গেছে তাই কাকতাড়ুয়াদের খুব একটা দেখা যায় না। হয়ত কালেভদ্রে কেউ একজন কাকতাড়ুয়া লাগায়।