বৃহস্পতিবার ● ১ ডিসেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » বৈষম্যহীন নীতি পরিহার করে সমমর্যাদার ভিত্তিতে পার্বত্য চুক্তি সংশোধন করে ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে তুলে ধরুন
বৈষম্যহীন নীতি পরিহার করে সমমর্যাদার ভিত্তিতে পার্বত্য চুক্তি সংশোধন করে ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে তুলে ধরুন
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: ১৯৫৮ সালে কর্ণফুলী নদীর উপর বাঁধ নির্মানের কারণে পাহাড়ে পাহাড়ি - বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর মানুষের সার্বিক জীবনে পরিবেশগত বিপর্যয় নেমে আসে। সমান ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় রাঙামাটি জেলার পাহাড়ি - বাঙ্গালীরা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর ১৯৭২ সালে তৎকালিন বাকশাল এর প্রার্থী হিসাবে উপেন্দ্র লাল চাকমা’র পরিবর্তে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে মনোনয়ন দেয়।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দেশে সরকার গঠন করে। এই স্বাধীনতা যুদ্ধে ইচ্ছে ও আকাঙ্খা থাকা সত্ত্বেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণকে বিশেষ ভাবে পাহাড়ি জনসাধারনকে ব্যাপকভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়নি। এর পেছনে ছিল তৎকালীন রাঙামাটি জেলার ডেপুটি কমিশনার বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামের গভীর ষড়যন্ত্র। যা আজ পর্যন্ত চলমান রয়েছে।
স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ একক জাতিরাষ্ট্র গঠনের নামে দেশে সংখ্যালঘু জাতিগুলোর ওপর বাঙালী জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেয়। এই বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রচনা করা হয় বাংলাদেশের সংবিধান।
১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (মঞ্জু) স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি দিতে গেলে তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ও তাঁর সাথে থাকা প্রতিনিধিদেরকে চরমভাবে অপমাণিত করেন। তিনি তার নিকট পেশ করা স্মারকলিপি ছুঁড়ে ফেলে দেন এবং লারমাকে উপদেশ দিয়ে বলেন, “তোমরা তোমাদের জাতিগত পরিচয় ভুলে যাও এবং বাঙালি হয়ে যাও”। শুধু তাই নয়, তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, লারমা তুমি বেশী বাড়াবাড়ি করো না। প্রয়োজনে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক…দুই…দশ লাখ বাঙালী ঢুকিয়ে দিয়ে তোমাদের জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলে দেয়া হবে। ১৯৭৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী রাঙামাটিতে সফরে এসে পুরাতন ষ্টেডিয়াম মাঠে এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমার একইভাবে পাহাড়িদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন ‘আমরা এখন সবাই বাঙালী। আমি আজ থেকে তোমাদেরকে বাঙালীতে প্রমোশন দিলাম’। জুম্ম জনগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঐ দম্ভোক্তি ও পাহাড়ি নেতাদের অপমানের প্রতিশোধ নেন ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে। এই নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের আসন সমূহে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি ঘটে। জনগণ আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রত্যাখ্যান করে রায় দেন। এরপর ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও জুম্ম জনগণ আওয়ামী লীগ প্রার্থীদেরকে পরাজিত করেন। মোট কথা ১৯৯১ সালের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কোন প্রার্থী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত হতে পারেনি।
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জুম্ম জনগনের প্রতি তাঁর পিতার বৈষম্য নীতি পরিহার করে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর প্রধান কার্যালয় সংলগ্ন আর্ন্তজাতিক সম্মেলন কক্ষে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মন্ত্রী সভার সদস্যদের উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে জাতীয় কমিটির আহবায়ক চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) সভাপতি পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
এ চুক্তি অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী খাগড়াছড়ি ষ্টেডিয়ামে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে শান্তিবাহিনীর ৭৩৯ জন সদস্যের প্রথম দলটি সন্তু লারমার নেতৃত্বে তৎকালিন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট অস্ত্রসমর্পন করে। ততত ত
পরবর্তীতে ১৬ ও ২২ ফেব্রুয়ারী ৪ দফায় শান্তিবাহিনী মোট ১৯৪৭ জন অস্ত্র সমর্পন করে। ২৭ ফেব্রুয়ারী উপজাতীয় শরনার্থীদের সর্বশেষ দলটি উপেন্দ্র লাল চাকমার নেতৃত্বে মাতৃভূমিতে ফিরে আসে। মোট ৬ দফায় ১২ হাজার ৩শ ২২ পরিবারের ৬৩ হাজার ৬৪ জন শরনার্থী দেশে ফিরে আসে।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ৬ মে স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন সংশোধন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন সংসদে পাশ হয়। ১৫ জুলাই ১৯৯৮ এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয় গঠন করা হয় এবং খাগড়াছড়ির তৎকালিন আওয়ামীলীগের দলীয় সংসদ সদস্য কল্প রঞ্জন চাকমাকে ১ম পার্বত্য মন্ত্রনালয়ের পূর্নমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। তৎ
১৯৯৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সরকার জনসংহতি সমিতির প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমাকে চেয়ারম্যান করে ২২ সদস্যের পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করে। ১৯৯৯ সালের ১২ মে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) দায়িত্বভার গ্রহনে আঞ্চলিক পরিষদের কার্যক্রম শুরু হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) দায়িত্বভার গ্রহনের পর থেকে সাবেক এই গেরিলা এবং প্রবীন রাজনৈতিক নেতা ১৮ বছরের ভিতর পার্বত্য অঞ্চলের স্থায়ী ভাবে এবং অস্থায়ী ভাবে বসবাস করা বাঙ্গালীদের আস্থা অর্জনে তিনি সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেননি। এককথায় বলতে গেলে পার্বত্য শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের ভিতর দুরত্ব। একারণে পার্বত্য শান্তিচুক্তি তার কাঙ্থিত লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়নি।
শুক্রবার ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ১৯ বছর পূর্তি।
এ উপলক্ষে রাঙামাটি,খাগড়াছড়ি ও বান্দারবানে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করার প্রস্তুতিমুলক সভা করেছে আওয়ামীলীগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (চুক্তি পক্ষের সন্তু লারমা গ্রুপ)।
এদিকে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী আঞ্চলিক সংগঠন ইউনাটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (সংস্কারপন্থী কট্টরপন্থী সুধাসিন্ধু গ্রুপ) এবং রাঙামাটি,খাগড়াছড়ি ও বান্দারবানের স্থানীয় সকল বাঙ্গালী সংগঠনগুলো পার্বত্য চুক্তি বিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষনা করেছে ।
পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে বিশ্বাস অবিশ্বাস ও টানাপোড়নের মধ্যে দিয়ে এবার পার্বত্য চট্টগ্রামে পালিত হচ্ছে শান্তি চুক্তির ১৯বছর পূর্তি। এবারপার্বত্য শান্তি চুক্তির উষালগ্ন থেকে অদ্যবদি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, বাংলাদেশ সরকার, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রমে বসবাসরত বাঙালীদের সকল দাবিদাওয়ার প্রতি উদাসীন। পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হলেও পাহাড়ে বৈষম্যনীতির কারণে আদৌ শান্তি ফিরে আসেনি। নিমৃ
এখনো উভয়ের হাতে সময় রয়েছে, বৈষম্যহীন নীতি পরিহার করে সমমর্যাদার ভিত্তিতে প্রয়োজনে পার্বত্য চুক্তি সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জন করে পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ী- বাঙ্গালী উভয় জনগোষ্ঠীর কাছে পার্বত্য চুক্তিকে ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে তুলে ধরা।
লেখক: নির্মল বড়ুয়া মিলন
প্রধান সম্পাদক
সিএইচটি মিডিয়া টুয়েন্টিফোর ডটকম