রবিবার ● ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬
প্রথম পাতা » অর্থ-বাণিজ্য » ব্যাট ব্যবসায়ী প্রসাদ মজুমদার এক জন সফল মানুষ
ব্যাট ব্যবসায়ী প্রসাদ মজুমদার এক জন সফল মানুষ
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি :: (১১ পৌষ ১৪২৩ বাঙলা : বাংলাদেশ সময় রাত ১১.২৭মি.) কে এই প্রসাদ মজুমদার : ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার পাড়াগায়ের একটি গ্রাম সালকুপা। সেই গ্রামের হতদরিদ্র বৈদ্যনাথ মজুমদারের পুত্র প্রসাদ মজুমদার (৩৩)। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে পড়া শেষ করে ভর্তি হন পাশ্ববর্তী সাব্দালপুর মুনছুর আলী একাডেমীতে। সেখানে পড়ালেখার পাশাপাশি তাকে বাবার কাজে সহযোগিতা করতে হতো। যে কারনে ঠিকমতো স্কুল করতে পারতেন না। তাই ঠিকমতো পড়ালেখা শেষ করতে পারেননি। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করলেও অর্থের অভাবে এস.এস.সি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি প্রসাদ মজুমদারের।
প্রসাদ মজুমদারের বয়স তখন ১৩ কি ১৪ বছর। মাধ্যমিক স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলের খেলার মাঠগুলোতে ক্রিকেট খেলা করে বেড়াতেন তিনি। পাকিস্থানী ব্যাট দিয়ে খেলতে গিয়ে প্রায়ই ব্যাট ভেঙ্গে যেতো তার। আবার টাকা জোগাড় করে ব্যাট কিনে তারপর খেলা। যা দরিদ্র পরিবারের সন্তান প্রসাদের জন্য ছিল খুবই কষ্টকর। ব্যাটের অভাবে তাই মাঝে মধ্যে বন্ধ হয়ে যেতো তার খেলা।
এদিকে বাবা বৈদ্যনাথ মজুমদার বাড়িতে বসে কাঠ দিয়ে গরুর গাড়ির চাকা তৈরীর কাজ করতেন। বাবার এই কাজে সহযোগিতা করতে হতো প্রসাদ মজুমদারের। কাঠের কাজ করতে গিয়ে একদিন তার মাথায় চিন্তা আসে কিছু কাঠ কিনে বাবার কাজের যন্ত্রপাতি দিয়ে ব্যাট বানিয়ে নিতে পারলে বাজার থেকে আর ব্যাট কিনতে হতো না। টাকার অভাবে ব্যাট কিনতে না পেরে খেলাও বন্ধ হতো না। তাই প্রসাদ মজুমদার নিজের লালন-পালন করা একটি মুরগী বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে কাঠ কিনে তৈরী করেন ব্যাট। প্রথম দফায় ৮ টি ব্যাট তৈরী করেন তিনি।
এরপর একটি সময় প্রসাদ মজুমদার ব্যাট তৈরীকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। আজ তার সংসারে বিরাজ করছে সুখ-সাচ্ছন্দ। অথচ এক সময় ছিল যখন তাদের সংসারে অভাব লেগেই থাকতো, ঠিকমতো তিন বেলা খাবার জুটতো না। প্রসাদ মজুমদারের কারখানায় এখন কাজ করছেন ৫/৬ জন শ্রমিক। তাকে দেখে অনুপ্রানিত হয়ে তাদের পাড়ার আরো ৮/১০ টি পরিবারও এগিয়ে এসেছেন এই ব্যাট তৈরীর কাজে। তাদের পাড়া ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার সালকুপাটি বর্তমানে পরিচিতি পেয়েছে ব্যাট পাড়া হিসেবে।
যেভাবে শুরু ব্যাট তৈরীর কাজ : প্রসাদ মজুমদার জানালেন এই অঞ্চলের দোকানগুলো থেকে বেশী দামের ব্যাট ক্রয় করতেন তিনি। পাকিস্থানী ব্যাট পাওয়া যেতো সে সময়। কোটচাঁদপুর শহরের সর্কার স্পোর্টস থেকে তারা ব্যাট ক্রয় করে খেলা করতেন। বেশী মুল্যের ব্যাট হলেও বেশী দিন ব্যবহার করা যেতো না। একটু জোরে বল লাগলেই ভেঙ্গে যেতো সেই ব্যাট। একদিন সাব্দালপুর স্কুল মাঠে খেলা করছিলেন তারা। দুইদিন পর রয়েছে কোটচাঁদপুর শহরে একটি ম্যাচ।
এমন সময় সাব্দালপুর মাঠ থেকে ব্যাট ভেঙ্গে যায়। সে সময় হাতে কোন পয়সাও নেই, নতুন ব্যাট ক্রয় করবেন। তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলেন প্রসাদ মজুমদার। কোটচাঁদপুরের ম্যাচে আর অংশ নেওয়া হলো না। ব্যাটের অভাবে তিনি অংশ নিতেও পারেননি ওই ম্যাচে। আরেকদিন তাকে একটা ব্যাট ক্রয় করার জন্য ঘুরতে হয়েছে বেশ কয়েকজনের কাছে। গ্রামের তখন ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। সেই ম্যাচে অংশ নিতে হবে, কিন্তু ব্যাট ভেঙ্গে পড়ে আছে। অংশ গ্রহনের উপায় নেই। তারপর বন্ধুদের কাছ থেকে পয়সা ধার করে ব্যাট ক্রয় করেন। এভাবে নানা সময় ব্যাটের জন্য কষ্ট করতে হয়েছে প্রসাদ মজুমদারকে।
প্রসাদ মজুমদার বলেন, ১৯৯৮ সালের গল্প। মাথায় তখন একটা ব্যাটের চিন্তা প্রবল ভাবে কাজ করছে। বাবার সাথে গরুর গাড়ির চাকা তৈরীর কাজ করছেন। কিন্তু কাজে তার মন ঠিকমতো বসছিল না। সারাক্ষন চিন্তা ব্যাট তাকে ক্রয় করতেই হবে। এমন সময় মাথায় চিন্তা আসে ব্যাট আর ক্রয় করবেন না। নিজেই তৈরী করবেন। কিন্তু কাঠ পাবেন কোথায়। বাবার চাকা তৈরীর কাঠ দিয়ে তো ব্যাট হবে না। মনে মনে বুদ্ধি আটলেন প্রসাদ মজুমদার। বাড়িতে একটা মুরগী লালন-পালন করতেন।
মা কালীদাসী মজুমদারকে বলে সেই মুরগি বিক্রি করে দেন। সেখান থেকে ১৪০ টাকা পান প্রসাদ। যা দিয়ে ৮ খন্ড কাঠ ক্রয় করেন। বাড়িতে বসে ওই ৮ খন্ড কাঠ দিয়ে তৈরী করেন ৮ টি ব্যাট। যার একটি দেন পাশ্ববর্তী রাজাপুর গ্রামের রানা, আরেকটি দেন সাব্দালপুর গ্রামের আরিফ হোসেনকে। নিজে দুইটি দিয়ে খেলা করতে থাকেন। তার নিজের তৈরী ব্যাট বেশ কিছুদিন ব্যবহার করা যায়। প্রসাদ মজুমদার জানান, ৪ টি ব্যাট কাজে লাগানোর পর বাকি ৪ টি নিয়ে তিনি যান কোটচাঁদপুর শহরের সেই সকার স্পোর্টস-এ। দোকানের মালিক গোলাম মোস্তফা এর সাথে কথা বলে ব্যাট চারটি বিক্রির জন্য রেখে আসেন। এরপর তার ওই চারটি ব্যাট ব্যবহারকারীরা আবারো ওই ব্যাট খুজতে আসেন। বিষয়টি দোকান মালিক তাকে জানানোর পর আগ্রহ বেড়ে যায় ব্যাট তৈরীর। শুরু হয়ে যায় কাঠ কিনে ব্যাট তৈরী করে বাজারে বিক্রি।
ব্যবসার প্রথম দিক : প্রসাদ মজুমদার জানান, প্রথম দিকে বাবা বৈদ্যনাথ মজুমদারের ব্যবহারের র্যান্দা, হাতুড়ী, সীল, করাত, বিন-বাটাল, বাটাল, মাটামসহ নানা যন্ত্র দিয়ে চলতো তার ব্যাট তৈরীর কাজ। প্রতিদিন ৫/৬ টি ব্যাট তৈরী করে বাজারে বিক্রি করতেন। আস্তে আস্তে তার তৈরী করা ব্যাটের চাহিদা বেড়ে যায়। কোটচাঁদপুর শহরের সকার স্পোর্টস ছাড়াও নতুন নতুন ঘর থেকে বায়না আসতে থাকে। কালীগঞ্জে লাবনী ষ্টোর ছাড়াও যশোর, ঝিনাইদহ, ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর অর্ডার আসতে থাকে। তিনি পেশা হিসেবে নিয়ে নেন এই ব্যাট তৈরীর কাজ। শুরু হয় গাছ কেনা, ফাড়াই করে তা দিয়ে ব্যাট তৈরী। জীবন গাছের কাঠ দিয়ে এগুলো তৈরী করেন প্রসাদ মজুমদার।
একটি সময় এসে নিজে সকল যন্ত্রপাতি ক্রয় করে নেন। বাড়িতে করাতকল বসিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন ব্যাট তৈরীর কারখানা। সাথে ষ্ট্যাম্পও তৈরী করেন তারা। এভাবে ৪ বছর কাজ করার পর প্রতিবেশীরাও এগিয়ে এসেছেন ব্যাট তৈরীর কাজে। প্রসাদ মজুমদার ছাড়াও তাদের পাড়ার কৃষ্ণ মজুমদার, দীপক মজুমদার, পরিমল মজুমদার, পরিতোষ মজুমদার, অশোক মজুমদার, প্রদীপ মজুমদার, সংকর মজুমদারসহ ১০ টি পরিবার এই পেশা বেছে নিয়েছেন। যারা প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ শত ব্যাট তৈরী করছেন।
ব্যবসার খবর : প্রসাদ মজুমদার জানিয়েছেন, প্রথম যখন তিনি ব্যাট তৈরী শুরু করেন তখন তার ব্যাটের চাহিদা থাকলেও বিক্রি করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে তৈরী হওয়া এই ব্যাট যতই ভালো হোক দোকানদাররা নিতে চাইতো না। যে কারনে অনেক দোকানে রেখে আসতে হতো। বিক্রির পর টাকা দিতেন তারা। এভাবে বাজার দখল করতে হয়েছে তার। এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তার ব্যাটের অর্ডার আসে, কিন্তু তারা সরবরাহ করে পারেন না। তিনি জানান, প্রথমে ব্যাট বিক্রি করে ৫০/৬০ টাকা পিচ দরে বিক্রি করেছেন, বর্তমানে ১৭০/১৮০ টাকায় বিক্রি করেন। সে সময় একটি ব্যাট তৈরী করতে খরচ হতো ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, আর এখন খরচ হয় ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা।
এখন তাদের ব্যাট বিক্রিতে দোকানীদের আগ্রহ বেড়েছে। ঢাকা, চট্রগ্রাম, রাজশাহী, খুলনাসহ দেশের সব এলাকায় যাচ্ছে তাদের ব্যাট আর ষ্টাম্প। বেশীর ভাগ সময় দোকানীরা তাদের কাছে আগাম অর্ডার দেন। সে ক্ষেত্রে তাদের দোকানের মনোগ্রাম দিয়ে ব্যাট তৈরী করতে হয়। যেমন ঢাকার ব্যবসায়ী জেনটেক ষ্পোর্টস এর মালিক যে ব্যাটগুলো তাদের দিয়ে তৈরী করান সেগুলোর নাম থাকে জেনটেক। এছাড়া তারা কিছু নিজস্ব নামে ব্যাট তৈরী করেন। যেমন মারুতী, নাইক, সিএ, এসএস, বিডিএমসহ অন্যান্য। এখন তাদের তৈরী করা ব্যাট নিতে দোকানীরা বাড়িতে চলে আসেন। এখন তিনি ব্যাট বিক্রি করে প্রতিদিন যা আয় করছেন সংসার খরচ মেটানোর পর মাসে ২০ হাজার টাকা জমাতে পারছেন। মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তান নিয়ে বর্তমানে তার সংসার সচ্ছল ভাবে চলছে। আশা করছেন আগামীতে আরো বড় কারখানা গড়ে তোলার।
এই পেশায় অন্যদের কথা: ব্যাট তৈরীর সাথে জড়িত অন্যদের মধ্যে আছেন মজুমদারপাড়ার প্রদীপ মজুমদার। তিনি জানান, তাদের পূর্ব-পুরুষের পেশা কাঠের কাজ। সেই কাঠ দিয়ে ব্যাট তৈরী শুরু করেন প্রসাদ মজুমদার। অল্পদিনে অনেক সাফল্য পেয়েছেন প্রসাদ। তাই দেখে তারাও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এখন তাদের পাড়ার অনেকেই এই কাজ করছেন। যারা সকলের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসছে। প্রদীপ মজুমদার আরো জানান, প্রায় ১০ বছর তিনি এই কাজ করছেন। তারা দুই ভাই এই ব্যাট তৈরীর কাজ করেন। এখন সারাদিন চলে তাদের ব্যাট তৈরীর কাজ। চাহিদা অনুযায়ী মাল সরবরাহ করাই কঠিন হয়ে যায় বলে জানান প্রদীপ। বছরের প্রায়ই সব সময় ব্যাট তৈরী ও বিক্রি হয়। তবে ৬ মাস চলে সবচে বেশী কেনাবেচা।
আরেক কারিগর কিশোর মজুমদার জানান, তাদের গোটা পাড়ায় এখন ব্যাট তৈরী হচ্ছে। গোটা অঞ্চলে তাদের গ্রামটি ব্যাট গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তারপরও পুজির অভাবে আশানুরুপ এবং দোকানীদের চাহিদা মতো ব্যাট তৈরী করতে পারছেন না। এ ক্ষেত্রে সহজ শর্তে ঋণ পেলে তাদের ব্যাবসার আরো প্রসার ঘটাতে পারতেন। পাশাপাশি দেশের বড় বড় শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলে পৌছে দিতে পারতেন সালকুপার ক্রিকেট ব্যাট।
বড় বড় ব্যবসায়ীদের কথা : ঢাকার গুলিস্থানে রয়েছে জেনটেক স্পোর্টস। প্রতিষ্ঠানটির মালিক রওশন জামিল জানান, অনেক দিন থেকে তার এই ব্যবসা। তিনি দেশের প্রায় সব জেলাতে ক্রিকেট খেলার সামগ্রী সরবরাহ করে থাকেন। রওশন জামিল জানান, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের সালকুপা গ্রামের ব্যাট দেশীয় ব্যাটের মধ্যে সবচে বেশী চাহিদা। এই ব্যাট সারা দেশে খুবই জনপ্রিয়। তিনি বলেন, ব্যাট তৈরীর কারিগররা তাদের মাল সাপ্লাই দিয়ে পারেন না। কারন তাদের কারখানা ছোট। পুজির অভাবে তারা কারখানা বড় করতে পারে না। আরেক ব্যবসায়ী কোটচাঁদপুরের সকার স্পোর্টস এর মালিক গোলাম মোস্তফা জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে গিয়েও দেখেছেন সেখানে কোটচাঁদপুরের তৈরী ব্যাট বিক্রি হচ্ছে। এই দেখে তার খুব ভালো লাগে।
প্রশাসনের কথা : এ ব্যাপারে কোটচাঁদপুর শহরের কয়েকটি ব্যাংকের সাথে কথা বললে তারা জানান, অবশ্যই তারা ঋন পাবেন। এ জাতীয় শিল্প খাতে ঋন দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তিনি সংশ্লিষ্টদের যোগাযোগের অনুরোধ জানান।