শুক্রবার ● ৫ মে ২০১৭
প্রথম পাতা » প্রধান সংবাদ » হালুয়াঘাটের সিলপাঁটা’র বাইন্যারা পেশা বদলে বাধ্য হচ্ছে
হালুয়াঘাটের সিলপাঁটা’র বাইন্যারা পেশা বদলে বাধ্য হচ্ছে
ময়মনসিংহ অফিস :: (২২ বৈশাখ ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ১০.৩২মি.) ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট উপজেলার ২ নং জুগলী ইউনিয়নের ঘিলাভূই গ্রাম। এই গ্রামের শতাধিক পরিবার সিলপাঁটা কাটার সাথে জড়িত থাকায় স্থানীয়ভাবে বাইন্যা পাড়া হিসেবে তাদের পরিচিতি । প্রায় ১২০ বছর যাবত সিলপাঁটা কাটিয়ে জীবন ধারন করছে এ পরিবারগুলো। বহু বছর আগে মাত্র তিনজন বাইন্যা সিলপাঁটার কাজ এই পাহাড়ি এলাকায় আরম্ভ করলেও, বর্তমানে শতাধিক পরিবার এ পেশার জড়িত রয়েছে।
এই পেশাটিকে তারা তাদের ঐতিহ্য হিসেবে মনে করে থাকেন। শুধু হালুয়াঘাট নয়, সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সিলপাঁটা কাটিয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এই বাইন্যারা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলেন “এই সিল কাটাই-পাঁটা কাটাই”——। কারও যদি সিলপাঁটা কাটানোর প্রয়োজন পড়ে তাহলে তাদেরকে ডেকে সিলপাঁটা কাটিয়ে সামান্য তম মজুরি দিয়ে থাকেন। সিলপাঁটা হচ্ছে মরিচ,হলুদ, ধনে, জিড়া গুড়া করার পাথরের তৈরি একটি সনাতন যন্ত্র। যা দিয়ে মহিলারা পাঁটার উপর মরিচ,হলুদ,জিরা,ধনেসহ রান্নার যাবতীয় মসলা রেখে সিল দিয়ে পিষে গুড়া করে। তারপর রান্নাকে সুস্বাধু করার জন্যে তা ব্যবহার করে থাকেন।
ঘিলাভূই গ্রামের সিলপাঁটা কাটানো এই বাইন্যা বাড়িতে গিয়ে বিচিত্র রকমের তথ্য পাওয়া যায়। ৬০ বছর ধরে সিলপাঁটা কাটিয়ে সোরহাব (৭২) সংসার চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমরা ১২০ বছর আগে থেইক্যা (থেকে) এই কাম করতাছি, আমার দাদা করত, জেডা করত, আব্বা করত, এখন আমিও এই কাজ করি। একসময় সিলপাডা (সিলপাঁটা) কাডাইয়া (কাটিয়ে) হারাদিনে পাঁচ টেহা (টাকা) কামাইছি। এক একটা পাডায় (পাটায়) বারো পয়সা, চার-আনা, আডানা (৫০ পয়সা) লইছি।
তিনি আরো বলেন,ময়মনসিংহের ত্রিশালের ধানীখলা নামক এলাকা থেকে হালুয়াঘাটে এসে বসতবাড়ি তৈরী করেন জহুর, বাহাদুর, অমর ব্যাপারী সর্বপ্রথম এই সিলপাঁটা কাটানোর কাজ আরম্ভ করেন। এখন তা শতাধিক পরিবারে দাঁড়িয়েছে। এই প্রবীণ সিলপাঁটা কাটানো বাইন্যা ছোরহাব আরও বলেন, তার কিছু দুঃখের কথা। এখন আর সংসার আগের মতো চলছেনা। খাইয়া না খাইয়া দিন যাইতাছে। মঙ্গলবার গেছিলাম গ্রামে। মাত্র ১৫০ টেহার(টাকা) মত পাইছি। মানুষ আর এখন আগের মত সিলপাঁটা কাডায়না । সেলিনা (৩৫) নামে এক বাইন্যার স্ত্রী বলেন, এহন(এখন) মরিচ বাইট্যা খায় কেডা, এহন পেয়াজ, রসুনের গুড়াও পাওয়া যায় ফলে আমাদের চাহিদাও কইম্যা গেছে। জসিমদ্দিন (৫৫) নামে আরেক পুরাতন বাইন্যা বলেন, ব্যবসা বানিজ্য খুব কম, শইল (শরীর) চলেনা, মাঝে মাঝে যাই, আমরা সবাই দুর্বল হয়ে গেছি। একইভাবে ভাইন্যা জয়নাল (৬০), রফিকুল(৩৫), জুলহাস(৩২), বিল্লাল(২৫), ছমির(৭২), ইদ্রিস আলী(৪৫), সেলিনা(৩৫) সহ প্রত্যেক বাইন্যাই একই কথা বলেন, আমরা এই বাইন্যা বাড়ির সবাই সিলপাডা কাডাই, কিন্তু ন্যায্য মুজুরী পাই না। কেউ কেউ আবার সিলপাঁটা কাটানোর ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্য ব্যবসা নেমে পড়েছেন। নতুনদের এই পেশায় আগ্রহ নেই।
জুগলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেন, সিলপাঁটা এখন অনেক কমে গেছে। যেদিন থেকে মানুষ বাজার থেকে মরিচ, হলুদের গুড়া কিনে খাওয়া শুরু করছে, সেদিন থেকেই সিলপাঁটার প্রয়োজন কমে গেছে। হালুয়াঘাট আকনপাড়া গ্রামের মোবাইল ব্যাবসায়ী বাবুল দেবনাথ বলেন,বিভিন্ন কোম্পানীর গুড়া মসলা অর্থাৎ মরিচ-হলুদ- ধনিয়ার গুড়াই সিলপাটার বারোটা বাঁজিয়েছে। নয়তো সিলপাঁটা কাটানোর সাথে জড়িত এইসব বাইন্যাদের জীবন ভালোই চলতো।