বৃহস্পতিবার ● ২৫ মে ২০১৭
প্রথম পাতা » কৃষি » কাপ্তাই হ্রদের তলদেশ শুকিয়ে মাটি ফেটে চৌচির : চরম ভোগান্তিতে দুর্গম এলাকার মানুষ (ভিডিওসহ)
কাপ্তাই হ্রদের তলদেশ শুকিয়ে মাটি ফেটে চৌচির : চরম ভোগান্তিতে দুর্গম এলাকার মানুষ (ভিডিওসহ)
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: (১১ বৈশাখ ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় ভোর ৫.০১মি.) কাপ্তাই হ্রদের পানি অস্বাভাবিক ভাবে শুকিয়ে যাওয়ায় চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন দুর্গম পাহাড়ে বসবাসরত লোকজন। রাঙামাটি পার্বত্য জেলার ১০ উপজেলার মধ্যে রাজস্থলী, কাউখালী, কাপ্তাই ও সদর উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা সড়ক পথে এবং বাকী নানিয়ারচর, বরকল, বিলাইছড়ি, জুড়াছড়ি, লংগদু, বাঘাইছড়ি ও সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের সাথে যোগাযোগের নৌপথই একমাত্র মাধ্যম। হ্রদের পানিতে জড়িয়ে রয়েছে জেলার সর্বস্তরের জীবন জীবিকা। কাঠ, বাঁশ, মাছ, পাথর, বালু, মৌসুমৗ ফল, বনজ সম্পদ ও অন্যান্য অর্থকরী ফসল বহনের নৌপথই একমাত্র মাধ্যম।
কিন্তু হ্রদের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া এবং এ বছর অনাবৃষ্টি ও অতিরিক্ত খরার কারণে হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় জেলা সদরের সাথে উপজেলাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে, ভেঙ্গে পরেছে অর্থনৈতিক কাঠামো। নানিয়ারচর, বরকল, বিলাইছড়ি, জুড়াছড়ি, লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলায় বসবাসরত জনসাধারন পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে। নৌপথ ভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এমনই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে লঞ্চের চালক, শ্রমিক দীর্ঘদিন ধরে অলস সময় পার করছেন। অন্যদিকে মৌসমী ফলের বাগান মালিক ও চাসীদের উৎপাদিত ফসল বাগানেই পচে যাচ্ছে।
২৪ মে বুধবার নৌপথে যাত্রীদের যাতায়াতের রিজার্ভ বাজার লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের যাত্রী উঠানামার পল্টন গুলি ধু ধু বালুচরে পড়ে রয়েছে, সামান্য কিছু উন্নয়নের কাজ চলছে। হ্রদের তলদেশ শুকিয়ে মাটি ফেটে চৌচির, সৃষ্টি হয়েছে বিশাল- বিশাল মাঠ। এসব মাঠে গড়ে উঠেছে ভাসমান দোকানপাট, টার্মিনালের আশে পাশে যেখানে ২০-২৫ ফুট পানি ছিলে যেসব স্থানে জেগে উঠেছে ছোট ছোট টিলা। উপজেলায় যাতায়াতের নৌযান লঞ্চের পরিবর্তে যাত্রীরা যাতায়াত করছেন ছোট ছোট ইঞ্জিন বোট ও নৌকা দিয়ে। উপজেলায় বসবাস করেন এমন যাত্রীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আগে যেখানে ৫-৬ ঘন্টায় যাতায়াত করা যেত সেখানে সময় ও ভাড়া দিতে হচ্ছে দ্বিগুন। পায়ে হেটে তাপদাহের মধ্যে মানুষকে পাড়ি দিতে হচ্ছে ত্রিশ থেকে চল্লিশ কি.মি পথ। হ্রদে কোথাও কোথাও পানি আছে মাত্র ১/২ ফুট। বরকল উপজেলা পর্যায়ে বসবাসকারী মো. নজরুল ইসলাম সিএইচটি মিডিয়াকে জানান, আগে যেখানে দিনে এসে রাঙামাটি জেলা শহরে কাজ শেষ করে উপজেলা সদরে ফেরত যাওয়া যেত সেখানে বর্তমানে সময় ব্যয় হচ্ছে তিন দিন। সরকারী অফিস আদালতে কোন কাজ থাকলে অথবা কোন কাজে আসলে একদিন আগে আসতে হয়, করতে হচ্ছে অতিরিক্ত ব্যয়। উপজেলা পর্যায়ে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। সব মিলিয়ে রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর, বরকল, বিলাইছড়ি, জুড়াছড়ি, লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলার জনসাধারনের জীবন যাপনে পরেছে বিরাট প্রভাব।
বাংলাদেশের একমাত্র জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ প্রকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এ প্রকল্প থেকে যেকোন সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কাপ্তাই হ্রদে যাত্রীবাহী লঞ্চের একজন মালিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের পর থেকে পানির নাব্যতা ও গভীরতা বজায় রাখার জন্য হ্রদের তলদেশ অদ্যবধি ড্রেজিং করা হয়নি। এমএন মার্গো লঞ্চের মালিক মো. নাসির উদ্দিন বলেন, লঞ্চ মালিক সমিতি, স্থানীয় প্রশাসন ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে আবেদন নিবেদন করেও কোন লাভ হয়নি। জরিপ হয়েছে অনেকবার কিন্তু কাজ শুরু হয়নি কখনো। এসব দেখার কোন কর্তৃপক্ষ রয়েছে বলে মনে হয়না বলে এই লঞ্চ মালিক জানান।
বরকল ছোট হরিনায় কর্মরত সরকারী এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিএইচটি মিডিয়াকে বলেন, রাঙামাটি শহর থেকে বড় হরিণা ঠেগামুখ স্থলবন্দর পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদ ড্রেজিং করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা অনেকবার এ পথে যাতায়াত করেছেন, সমীক্ষা চালিয়েছেন, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পিছনে মনোরঞ্জনের জন্য পানির উপরে মঞ্চ বানিয়ে উপজাতীয় শিল্পীদের নৃত্যসহ মনোমুগ্ধকর অনেক অনুষ্ঠান এ হ্রদের বুকে আয়োজন করা হয়েছে, কিন্তু হ্রদ ড্রেজিং এর কাজ শুরু হয় নি। মাঝখান থেকে অনর্থক আমাদের তহবিলের টাকা নষ্ট হয়েছে বলেন তিনি”। সরকারী এ কর্মকর্তা জোর দিয়ে বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আন্তরিক হয়ে উদ্যোগ নিলে কাপ্তাই হ্রদের নাব্যতা বাড়ানো ও হ্রদের তলদেশ ড্রেজিং করা সম্ভব হবে।
ছোট হরিনা বাজারের একজন ব্যবসায়ী জানান, মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় চাল, ডাল, লবণ, চিনি ইত্যাদি রাঙামাটি শহর থেকে আগে খুব সহজে লঞ্চে করে আনা যেত, কিন্তু কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে যাওয়ার ফলে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে এসব ভোগ্যপণ্য ছোট ছোট নৌকায় করে শ্রমিকদের অতিরিক্ত খরচ দিয়ে এনে বিক্রি করতে হচ্ছে, এতে গ্রাকদের অতিরিক্ত টাকা খরচ হচ্ছে। আমরাও লাভের আশা ছেড়ে দিয়ে আগামী দিনের ব্যবসার আশায় কেবলমাত্র ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছি।
কাপ্তাই হ্রদে অতিরিক্তভাবে পানি কমে যাওয়ার সুযোগে এক শ্রেণীর লোভী লোকজন হ্রদের পাড় অবৈধভাবে দখল করে গড়ে তুলছে স্থাপনা।
ট্যুরিষ্ট বোট মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক এনামুল হক বলেন, রাঙামাটি শহরটি মূলত পর্যটন শহর হিসেবে পরিচিত। কাপ্তাই হ্রদকে ঘিরে পর্যটক বাহী ইঞ্জিন বোট, ফাইবার বোট, দেশীয় নৌযান চালক ও মালিকরা পরেছেন অর্থনৈতিক সংকটে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২/১ বছরের মধ্যে এপথে ইঞ্জিন বোটসহ লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দিতে হবে। স্থানীয় মৎস্য শিকারীরা সরকারী নির্দেশনায় কাপ্তাই হ্রদে মাছ শিকার বন্ধ থাকায় তারা পাচ্ছেন সরকারী খাদ্য সহায়তা না হলে এসব জেলেদের পরিবার পরিজন নিয়ে দিন যাপনে কষ্টসাধ্য হয়ে যেত। যারা নৌপথে মৌসুমৗ ফল বিক্রয়ের জন্য পণ্য বাজারে তুলছেন তাদেরকেও গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত শ্রমিক খরচ। হ্রদের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সে তুলনায় বাগান মালিকদের পণ্য উৎপাদনের খরচ ও উঠানো যাচ্ছেনা বলে জানা গেছে। ১৯৬০ সালে রাঙামাটিতে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের পরে হ্রদের তদারকি ও রক্ষণা-বেক্ষণের জন্য গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সরকারী একাধিক প্রতিষ্ঠান, এদের মধ্যে- বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, রাঙামাটি জেলা প্রশাসন ও কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। কাপ্তাই হ্রদ দীর্ঘ ৫৭ বছর ড্রেজিং বিহীন রয়েছে এবং হ্রদের সম্পদ রক্ষণা-বেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতে উল্লেখিত কোন কর্তৃপক্ষকে দেখা যায়না বলে সুবিধাভোগীদের অভিযোগ।