শনিবার ● ৫ আগস্ট ২০১৭
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » আঞ্চলিক পরিষদসহ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রায় ১৯ বছর পরিচালিত হচ্ছে অনির্বাচিত সদস্যদের দ্ধারা
আঞ্চলিক পরিষদসহ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ প্রায় ১৯ বছর পরিচালিত হচ্ছে অনির্বাচিত সদস্যদের দ্ধারা
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: (২১ শ্রাবণ ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ১০.৩০মি.) পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি এলাকা, যা তিনটি জেলা, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত। চট্টগ্রাম বিভাগের এই এলাকা পাহাড় ও উপত্যকায় পূর্ণ বলে এর নামকরণ হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি ১৫৫০ সালের দিকে প্রণীত বাংলার প্রথম মানচিত্রে বিদ্যমান ছিল। তবে এর প্রায় ৬০০ বছর আগে ৯৫৩ সালে আরাকানের রাজা এই অঞ্চল অধিকার করেন। ১২৪০ সালের দিকে ত্রিপুরার রাজা এই এলাকা দখল করেন। ১৫৭৫ সালে আরাকানের রাজা এই এলাকা পুনর্দখল করেন, এবং ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত অধিকারে রাখেন। মুঘল সাম্রাজ্য ১৬৬৬ হতে ১৭৬০ সাল পর্যন্ত এলাকাটি সুবা বাংলার অধীনে শাসন করে। ১৭৬০ সালে ব্রিটিস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই এলাকা নিজেদের আয়ত্তে আনে। ১৮৬০ সালে এটি ব্রিটিশ ভারতের অংশ হিসাবে যুক্ত হয়। ব্রিটিশরা এই এলাকার নাম দেয় চিটাগাং হিল ট্র্যাক্ট্স বা পার্বত্য চট্টগ্রাম। এটি চট্টগ্রাম জেলার অংশ হিসাবে বাংলা প্রদেশের অন্তর্গত ছিল। ১৯৪৭ সালে এই এলাকা পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়।১৯৫৮ সালে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে কাপ্তাই হ্রদে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয় । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এটি বাংলাদেশের জেলা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৮০ এর দশকের শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি জেলা - রাঙামাটি, বান্দরবান, ও খাগড়াছড়িতে বিভক্ত করা হয়।
১৯৫৮ সালে কর্ণফুলী নদীর উপর বাঁধ নির্মানের কারণে পাহাড়ে পাহাড়ি - বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর মানুষের সার্বিক জীবনে পরিবেশগত বিপর্যয় নেমে আসে। সমান ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় রাঙামাটি জেলার পাহাড়ি - বাঙ্গালীরা।
১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর প্রধান কার্যালয় সংলগ্ন আর্ন্তজাতিক সম্মেলন কক্ষে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মন্ত্রী সভার সদস্যদের উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষে জাতীয় কমিটির আহবায়ক চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) সভাপতি পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯ (রাঙামাটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন ১৯৮৯, বান্দরবান পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯) ইত্যাদি এবং এর বিভিন্ন ধারাসমূহ সংশোধন করা হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ :
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন-১৯৯৮ (১৯৯৮ সনের ১২ নং আইন) অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়। বিগত ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুসারে ২৭ মে ১৯৯৯ ইংরেজি তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের কর্মপরিধি :
(ক) পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে পরিচালিত সকল উন্নয়ন কর্মকান্ডসহ উহাদের আওতাধীন এবং উহাদের উপর অর্পিত বিষয়াদি সার্বিক তত্বাবধান ও সমন্বয়: (খ) পৌরসভাসহ স্থানীয় পরিষদসমুহ তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন; (গ) পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর কার্যাবলীর সার্বিক তত্ত্বাবধান; (ঘ) পার্বত্য জেলার সাধারন প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন; (ঙ) উপজাতীয় রীতিনীতি, প্রথা ইত্যাদি এবং সামাজিক বিচার সমন্বয় ও তত্ত্বাবধান; (চ) জাতীয় শিল্পনীতির সহিত সংগতি রাখিয়া পার্বত্য জেলাসমুহে ভারী শিল্প স্থাপনের লাইসেন্স প্রদান; (ছ) দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান কার্যক্রম পরিচালনা এবং এনজিও কার্যাবলীর সমন্বয় সাধন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠনের উদ্দেশ্য : প্রশাসনিক ও উন্নয়ন কামকান্ড সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে পাবত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আথ- সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণ।
রাঙামাটি,বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ :
১৯৮৯ সনে পার্বত্য জেলা সমুহে বিভিন্ন অনগ্রসর উপজাতি অধ্যুষিত রাঙামাটি পার্বত্য জেলার সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন কল্পে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন, ১৯৮৯ (১৯৮৯ সনের ১৯ নং , ২০ নং ও ২১ নং আইন দ্বারা অনুযায়ী রাঙামাটি,বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠিত হয়। এ উদ্দেশ্যে রাঙামাটি,বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ বিল, ১৯৮৯, ২৬শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৯ তারিখ মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে। আইনটি ৬ই মার্চ, ১৯৮৯ তারিখের বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। একই বছর ২৫শে জুন অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে চেয়ারম্যান সহ ৩১ সদস্য বিশিষ্ট পরিষদ গঠিত হয়। এদের মেয়াদ শেষ করে তার থেকে অদ্যবধি চলছে মনোানীতদের দিয়ে।
১৯৯৭ সনের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন ও এ জেলার উপজাতীয় অধিবাসীগণসহ সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত রাখা এবং সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার প্রয়োজনে ১৯৯৮ সনের ৯ নং আইন দ্বারা পরিষদের আইন সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধিত আইন অনুযায়ী “রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ”,“বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ” ও “খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ” এ নামে রুপান্তরিত হয়েছে।
রাঙামাটি/বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তরিত বিভাগ সমুহ হচ্ছে :
স্বাস্থ্য বিভাগ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, জেলা প্রাথমিক বিভাগ, মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ, প্রাণীসম্পদ বিভাগ, মৎস্য বিভাগ, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি সাংস্কৃতি ইন্সটিটিউট, জেলা শিল্পকলা একাডেমী, বাজারফান্ড প্রশাসন, টেক্সটাল ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, জেলা সরকারী গণগ্রন্থাগার, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, এফডব্লিউভিটিআ্ই, জেলা সমাজসেবা বিভাগ,হর্টিকালচার সেন্টার, জেলা সমবায় বিভাগ, পর্যটন কর্পোরেশন, জেলা উন্নয়ন কমিটি, জুম চাষ, মৎস্য হেচারী, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ ব্যতীত ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ও অন্যান্য শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় শিল্প বাণিজ্যের লাইসেন্স, জম্ম-মৃত্যু ও অন্যান্য পরিসংখ্যান সংরক্ষণ ও মহাজনী কারবার ইত্যাদি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনে চেয়ারম্যান ও সদস্যরা নির্বাচন করে দায়িত্ব পালনের কথা কিন্তু দীঘ ১৮ বছর ২মাস ১০ দিন ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে অনির্বাচিত সদস্যদের দ্ধারা। ফলে জেলা পরিষদ গুলো হয়ে উঠেছে দুর্নীতির আখড়া। বান্দরবান জেলা পরিষদে একযুগ ধরে একই ব্যাক্তি বহালতবিয়তে। অনির্বাচিত সদস্যদের দিয়ে পরিচালনার কারনে পরিষদ সমুহের সাধারন জনগণের কাছে কোন জবাবদিহিতা নেই।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদসহ রাঙামাটি,বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা তিন জেলা পরিষদের নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়া।