শুক্রবার ● ১৩ অক্টোবর ২০১৭
প্রথম পাতা » অর্থ-বাণিজ্য » ময়মনসিংহে আমন ধানে পচন রোগ : হতাশ কৃষকরা
ময়মনসিংহে আমন ধানে পচন রোগ : হতাশ কৃষকরা
ময়মনসিংহ অফিস :: (২৮ আশ্বিন ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬.২২মি.) ময়মনসিংহে আমন ধানে পচন রোগ ও মাজরা কাটা পোকার আক্রমনে হতাশ হয়ে কৃষকদের মাথায় হাত উঠেছে। জেলার নিন্মাঞ্চল এলাকা ফুলপুর, গৌরীপুর, ঈশরগঞ্জের পশ্চিমাংশ, গফরগাঁওয়ের পূর্বাংশ, ধোবাউড়া, হালুয়াঘাটসহ প্রায় ৬টি উপজেলা এবারের অতিবৃষ্টি, দু’দফায় পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় প্লাবিত হওয়ার পরে আবারো হঠাৎ বৃষ্টিতে রোপনকৃত বীজতলা ও আমন ধানের চারা পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এ অঞ্চলের কৃষকরা অনেক কষ্টে ধান রোপন করে শেষ চেষ্টায় আশায় বুক বাধলেও তাদের আমন ক্ষেতে শীষ বের হওয়ার পর্যায়ে আসার সময়ে দেখা দিয়েছে পচন রোগ ও মাজরা কাটা পোকার আক্রমন। ফলে কৃষকদের উপর এ যেন ‘মরার উপর খাড়া ঘা’ দেখা দেয়ায় তারা হতাশ হয়ে পড়েছে। স্থানীয়ভাবে ক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগ করেও কাজ হচ্ছেনা বলে অভিযোগ করেন অনেক চাষি। এদিকে স্থানীয় কৃষি বিভাগ জানিয়েছে সঠিক নিয়মে সার ও পরিচর্যা না করার কারণে এমনটা হয়েছে।
এ অঞ্চলের বিভিন্নস্থানে মাজরা পোকার আক্রমণ ও পাতা মোড়ানো রোগে আক্রান্ত আমন জমির পরিমাণ দিনদিন বাড়তে থাকায় কাঙ্খিত ফলন নিয়ে মহাচিন্তায় পড়েছে কৃষকরা। সেইসাথে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দায়সারা দায়িত্ব পালনের অভিযোগ জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক কৃষক।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী ময়মনসিংহ জেলায় এবার দুই লক্ষ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে। যা টার্গেটের চেয়েও বেশি। অতিবৃষ্টি, দু’দফায় পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় ময়মনসিংহ জেলার নিন্মাঞ্চলের ৬টি উপজেলায় ৭৪ হেক্টর জমির বীজতলা ও ৭ হাজার ৭৮৫ হেক্টর জমির আমন ধানের চারা তলিয়ে নষ্ট হয়েছে।
এ দিকে ফুলপুর,গৌরীপুর,হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া এলাকায় নয়নাভিরাম সবুজ আমন ধান ক্ষেতে মাজরা পোকার আক্রমণ ও পাতা মোড়ানো রোগের আক্রমন সবচেয়ে বেশি। ফুলপুরে রোপা আমন মৌসুমের মাঝামাঝি আকস্মিকভাবে ক্ষেতে পাতা মরা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ায় ফলন বিপর্যয়ের আশংকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে কৃষক।মৌসুমের শুরুতে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে ইরি-বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই পাতা মরা রোগ এ অঞ্চলের কৃষকদের উপর এ যেন মরণ কামড়। ফুলপুরের উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান বলেন, চলতি মৌসুমে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় নাইট্রোজেনের মাত্রা বেড়ে পাতা নরম হয়ে পাতামরা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এতে ধানের ফলনে তেমন একটা প্রভাব পড়বে না। কিন্তু কৃষকরা তার কথায় বিশ^াস রাখতে পারছেন না। কৃষকদের বক্তব্য-পাতা মরা রোগ তাদের সব স্বপ্ন মিথ্যে করে রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে।
এদিকে গৌরীপুরের ভাংমামারী ইউনিয়নের বারুয়ামারী গ্রামের কৃষক মোঃ আবদুল্লাহ বলেন, ‘বিষ দেই, ওষুধ দেই, পোকাও মরে না, রোগও ভালা(ভাল) হয় না। ধানের গাছ আগা(উপর) থেকে মরা ধরছে।’ তবে ওই এলাকার কৃষক আবদুল খালেকের আমন ধান ক্ষেতে গোড়া থেকে মরা ধরছে। তিনি জানান, ৪ কাঠা জমি গোড়া থেকে পুড়ে সাফ হয়ে গেছে। কালচে রং ধারণ করেছে আবদুল মজিদের প্রায় ১৩০ শতাংশ জমি। হাবিবুর রহমান হবির রোপিত ১৪০ শতাংশের আমন ধানক্ষেত পোকার আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে । মজিদেরও এক একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। পাতা মরা রোগে ইয়াকুব আলী, কিসমত আলী, হারুন মিয়া, বিলু মিয়ার কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৪৫০ শতাংশ জমির ফসল। লালমারী বিলের প্রায় ৩শ’ একর জমির ফসলই পুড়ে গেছে। এ এলাকার শতাধিক কৃষকের স্বপ্নের ফসল হারিয়ে যাবার উপক্রম হওয়ায় তাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে।
গৌরীপুরের বারুয়ামারীর কৃষক আবুল কাসেম, ডৌহাখলা ইউনিয়নের সিংজানী গ্রামের মামুন মিয়া, চরশ্রীরামপুর গ্রামের আবদুল জলিল, পায়রা গ্রামের জয়নাল আবেদিনের জমি ছাড়াও রামগোপালপুর ইউনিয়নের পুম্বাইল, ধুরুয়া ও নওয়াগাঁও গ্রামের অনেক কৃষকের ধানক্ষেতের সবুজ শীষে কালচে রং দেখা দিয়েছে ।
গৌরীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোঃ সাদিকুর রহমান জানান, কিছু এলাকায় বিএলবি ব্যাকটেরিয়া ও বাদামি গাছ ফড়িংয়ে আক্রমণ দেখা দিয়েছে।
এ দিকে হালুয়াঘাট উপজেলার সন্ধ্যাকুড়া গ্রামের কৃষক কাসেম আলী জানান, তাদের সর্বমোট প্রায় ৫ একর জমিতে আমন ধানের চারা রোপন করার পর প্রায় এক একর জমির ধানে পাতা মোড়ানো রোগ আক্রমণ করেছে। তিনি এ ব্যাপারে কৃষি অফিসের লোকজনের কোনো তদারকি নেই বলে অভিযোগ করেন।একই গ্রামের মোহাম্মদ আলী জানান, আবাদকৃত এক একর জমির বেশিরভাগ ধান গাছ বাদামি রঙে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জয়রামকুড়া গ্রামের কৃষক দিলীপ রিসিল জানান, ১২ কাঠা জমিতে আমন চারা রোপণ করার পর বেশিরভাগ ক্ষেত পাতা মোড়ানো রোগে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একই গ্রামের ওমর আলী জানান, প্রায় ৩ একর জমিতে আমন ধানের আবাদ করার পর এখন পোকার আক্রমণে গাছের সবুজ পাতা বাদামি হয়ে যাচ্ছে।
অপরদিকে ধোবাউড়া উপজেলার ঘুষগাও ও বাঘবেড় ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের আমন ক্ষেতে পাতা মোড়ানো রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানে-স্থানে পাতা বাদামি রঙ ধারণ করেছে। দ্রুত রোগ দমন করতে না পারলে এবার ভালো ফলন না পাওয়ার আশঙ্কা করছেন পোকায় আক্রান্ত জমির কৃষকরা।
ময়মনসিংহের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল মাজেদ জানান, দু’দফা বন্যায় বীজতলা ও রোপণকৃত আমন ধানের চারা নষ্ট হলেও সময় থাকায় কৃষকরা নতুন করে বীজতলা তৈরী ও চারা রোপণ করতে পারায় বন্যার ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে নিতে পেরেছে। তবে আমন ক্ষেতে মাজরা পোকা ও পাতা মোড়ানো রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে জানান, এতে কৃষকদের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। এ রোগের আক্রমণ প্রাথমিক পর্যায়ে,ক্ষতিগ্রস্থ্য জমিতে অনুমোদিত কীটনাশক ও বাঁশের কঞ্চি বা গাছের ডাল পুঁতার নির্দেশ দেন এই কৃষি কর্মকর্তা। সেইসাথে এ নিয়ে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তা ও উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান ।