মঙ্গলবার ● ২১ নভেম্বর ২০১৭
প্রথম পাতা » কক্সবাজার » বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইস্যুতে সক্রিয় রোহিঙ্গারা
বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইস্যুতে সক্রিয় রোহিঙ্গারা
উখিয়া প্রতিনিধি :: (৭অগ্রহায়ণ ১৪২৪ বাঙলা : বাংলাদেশ সময় রাত ১.১৯মি.) মিয়ানমার সরকারের সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী মগদের অমানবিক নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে ৬ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা। নতুন করে আসা রোহিঙ্গারাও বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে ইউরোপ সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এসব রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয় পত্র জালিয়াতি করে ও পাসপোর্ট বানিয়ে দিয়ে সমাজের কিছু জনপ্রতিনিধি ও দালালচক্ররা মোটা অংকের ফায়দা লুটছে এমন অভিযোগ প্রশাসনের কাছে রয়েছে।
২৫ আগষ্ট থেকে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই সুযোগ বুঝে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার কৌশল নিচ্ছে। আর তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে দেশীয় দালালচক্র। রোহিঙ্গাদের বাঙালি পোষাক পরিয়ে জন্মসনদ ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রের যোগান দিয়ে পাসপোর্ট তৈরির চেষ্টা করছে তারা। তাছাড়া অতীতে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে তাদের অনেকেই স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে মিশে গেছে। স্থানীয় ভাষা এবং চেহারায় মিল থাকায় কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে তাদের আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় যাওয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পরিচয়ে সেখানে অবস্থান করছে। সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে অনেক রোহিঙ্গা আটক হয়। এ ছাড়াও প্রতি বছর হজ্ব ও ওমরাহ ভিসায় অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে পাড়ি জমায়। সৌদি সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি সদয় হওয়ায় সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে রোহিঙ্গারা। শুধু সৌদি আরবেই এখন ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা রয়েছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীর সংখ্যাও হাজার হাজার।
এদিকে রোহিঙ্গারা যাতে অবৈধ পন্থায় পাসপোর্ট তৈরি করতে না পারে সে জন্য কঠোর অবস্থানে রয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের যথাযথ প্রক্রিয়ায় স্বদেশে ফেরত পাঠানো সহ তারা যাতে কোন ধরনের অপরাধ কর্মকান্ডে জড়াতে না পারে সে জন্য তাদেরকে নিবন্ধনের আওতায় আনা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করতে গেলে ৭ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপরই প্রশাসনের সর্বস্তরে কঠোর নজরদারি রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। তবে এবারই প্রথম নয়, এর আগে কমপক্ষে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ চলে গেছে।
পাড়ি জমানো উল্লেখ্যযোগ্য দেশ গুলোর মধ্যে রয়েছে মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, অষ্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কিংডম কুয়েত, ইরাক, ইরান, কাতার, জর্দান, ওমান, সিঙ্গাপুরসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গা রয়েছে। বিদেশে গিয়ে রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এবং তাদের অপরাধের দায়ভার বর্তাচ্ছে বাংলাদেশের ওপর। সংশ্নিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সেবায় নিয়োজিত ড্যাব এর অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পের সামনে দেখা হয় রোহিঙ্গা যুবক আবু তৈয়বের সাথে। এআরবি রোহিঙ্গা নিউজ নামের একটি কার্ড ঝুলিয়েছে গলায়। হাতে মুভি ক্যামেরা। প্রতিবেদককে দেখে কার্ডটি লুকানোর চেষ্টা করছিল বারবার। বাড়ি কোথায় জানতে চাওয়া হলে বাংলায় অষ্ট্রেলিয়ায় বলে জানায়। নাম জিজ্ঞেস করা হলে আবু তৈয়ব। মুহুর্তেই কৌশলে হাজারো মানুষের ভিড়ে আড়ালে চলে যায়।
আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রমে দায়িত্বরত কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আবুল কালাম মো. লুৎফর রহমান জানান, রবিবার (২০ নভেম্বর) পর্যন্ত কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি আশ্রয় ক্যাম্পের ৭টি বায়োমেট্রিক কেন্দ্রে ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৫৭২ জন রোহিঙ্গার নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। ২৫ আগষ্টের পর থেকে রোববার পর্যন্ত ৬ লাখ ৩০ হাজার ১৭৫ জন মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশের কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে অনুপ্রবেশ করেছে বলেও তিনি জানান।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন বলেন, কক্সবাজারে বিভিন্ন পয়েন্টে হাইওয়ে পুলিশের ২টি সহ মোট ১৩টি চেকপোষ্ট করা হয়েছে। এসব পয়েন্ট থেকে এ পর্যন্ত ৩৭ হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে বালুখালী ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে।
যেহেতু বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন চলছে। এখন আর সেটি করা এতো সহজ নয়। রোহিঙ্গারা সন্ত্রাস ও সমাজবিরোধী কাজ করলে তাদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। ইতিমধ্যে সরকারের নির্দেশে পুলিশের পক্ষ থেকে এই বার্তা রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রচার করা হয়েছে এবং অব্যাহত আছে। পাশাপাশি তারা যাতে পাসপোর্ট তৈরি করতে না পারে সে জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসন সতর্ক রয়েছে। এ ব্যাপারে কেউ রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানান, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সামজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য বিশাল সমস্যা। মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। তাই কক্সবাজার জেলার বাসিন্দাদের জন্য জন্ম নিবন্ধনের পাশাপাশি পুলিশ ভেরিফিকেশনে কঠোর হতে বলা হয়েছে।
গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর হামলার পর বাংলাদেশে ৬ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে। তাদের মধ্যে অনেকেই চট্টগ্রাম বিভাগ থেকেই অন্যান্য বিভাগে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন সময়ে কৌশলে পাসপোর্ট তৈরির সুযোগ নিলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হচ্ছে।
কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা শুধু পর্যটন জেলা কক্সবাজারের নয়, গোটা বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি। বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার অবস্থান। তাই তাদের গতিবিধির ওপর নজরদারি জোরদার এবং নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে চলাচলে সীমাবদ্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এমনটি জানিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা।