বৃহস্পতিবার ● ২৩ নভেম্বর ২০১৭
প্রথম পাতা » চট্টগ্রাম বিভাগ » পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা,লামা-আলীকদমে বিপুল তামাক চাষ
পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা,লামা-আলীকদমে বিপুল তামাক চাষ
লামা প্রতিনিধি :: (৯ অগ্রহায়ন ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ৯.৫৭মি.) পরিবশের ক্ষতি করেই চলেছে তামাক কোম্পানীগুলো। প্রতিবারের ন্যায় এবারও তামাক চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তারা। বিশেষ করে বান্দরবানের লামা ও আলীকদম উপজেলায় এমন প্রভাব বেশি। বিগত মৌসুমের ন্যায় চলতি মৌসুমেও ১২ হাজার ৬০০ একর ফসলি জমিতে পরিবেশের ক্ষতিকারক তামাক চাষের ভয়াল বিস্তারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে পুঁজিবাদী তামাক কোম্পানী।
ইতোমধ্যে কোম্পানীগুলো তাদের রেজিষ্ট্রেশনভুক্ত প্রায় সাড়ে ৪ হাজার চাষীকে প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে বীজ, পলিথিন, কীটনাশক, সার ও ঋণ প্রদান করেছে। এখন ফসলি জমি, মাতামুহুরী নদীর চর ও বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমিতেও তামাকের বীজতলা করা হয়েছে। গত দুই তিন বছর ধরে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে তামাক চাষীরা। তবুও থামছেনা এ চাষের ভয়াল বিস্তার। তবে গতবারের তুলনায় এবারে তামাক চাষের পরিমাণ অনেকাংশে কম হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। বিকল্প না থাকায় বাধ্য হয়ে তামাক চাষ করছেন কৃষকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইতোমধ্যে সরকার তামাক চাষে নিরূৎসাহিত করার নীতিমালা গ্রহণ করেছে। কিন্তু কয়েকটি তামাক কোম্পানী সরকারের নিরূৎসাহিত করার নীতিকে বৃদ্ধঙ্গুলী দেখিয়েছে। লামা উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকা এবং আলীকদম উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে তাদের অবাধ ব্যবসা চলছে। লোভনীয় ফাঁদে পড়ে গত ২২ বছর ধরে আশংকাজনক হারে তামাক চাষের বিস্তার ঘটেছে। ফলে উপজেলা দুটিতে অন্যান্য কৃষিজাত দ্রব্য ও রবিশস্যের ফলন উৎপাদন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। চলতি মৌসুমে আবুল খায়ের ট্যোবাকো, ঢাকা ট্যোবাকো, নিউএইজ ও বিএটিবি কোম্পানীগুলোর সার্বিক সহযোগিতায় তামাক চাষের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেষ করে জমিতে তামাক রোপনের কাজ শুরু করেছে কৃষকরা।
সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, লামা বন বিভাগের বমু সংরক্ষিত বনাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকার বাড়ির আঙিনা ও স্কুলের মাঠ থেকে শুরু করে সর্বত্রই তামাক বীজতলা করা হয়েছে। বীজতলায় উৎপাদিত চারা এখন জমিতে রোপনের কাজ শুরু করেছে কোন কোন চাষি। আবার অনেকে তামাকের জন্য জমি প্রস্তুতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
চাষীরা সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে বলেন, মৌসুমের শুরুতেও বৃষ্টি হওয়ার কারণে তামাক বীজ তলা ও জমি তৈরিতে বিলম্ব হয়েছে। তাই এখন দম ফেলার সময় নেই। ছোট থেকে বড় সব বয়সের নারী পুরুষই তামাক চাষ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন।
কৃষি অফিস সূত্র মতে, চলতি মৌসুমে কোম্পানীগুলো লামা উপজেলায় প্রায় ১ হাজার হেক্টর ও আলীকদম উপজেলায় প্রায় ৬০০হেক্টর জমিতে তামাক চাষের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে বেসরকারী হিসেব মতে এর পরিমাণ অনেকগুন বেশি হবে বলে ধারনা করছেন সংশ্লিষ্ট চাষীরা।
কোম্পানীগুলো তাদের সঠিক পরিসংখ্যান দিয়ে রেজিস্ট্রেশনকৃত তামাক চাষীর সংখ্যা ও কত একর জমিতে তামাক চাষ হবে তা বরাবরই কৌশলগতভাবে চাপিয়ে যায়।
বিশ্বস্ত সূত্র মতে, চলতি মৌসুমে লামা আলীকদম উপজেলার বিভিন্ন স্থানে আবুল খায়ের ট্যোবাকো কমপক্ষে ৭০০ চাষীর মধ্যে ২২০০ একর জমি, নাসির ট্যোবাকো প্রায় ৩৫০ জন চাষীর মধ্যে ১০০০ একর, ঢাকা ট্যোবাকো প্রায় ১৫০০ চাষীর মধ্যে ৩৮০০ একর, বিএটিবি প্রায় ১০০০ চাষীর মধ্যে কমপক্ষে ২৫০০ একর এবং নিউজএইজ টোব্যাকো কোম্পানীর ৫৫০ চাষীর মধ্যে ১৬০০একর জমিতে তামাক চাষ করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে।
এছাড়াও তামাক কোম্পানীগুলোর রেজিষ্ট্রেশন বহির্ভূত তামাক চাষীর সংখ্যাও কমপক্ষে দেড় হাজার হবে বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা। আর এরাও প্রায় ৫০০ একর জমিতে তামাক চাষ করবেন। এ হিসেবে উপজেলা দুটিতে প্রায় ১২ হাজার ৬০০একর ফসলি জমিতে তামাক চাষের প্রস্তুতি চলছে বলে স্থানীয় তামাক চাষীরা জানিয়েছেন।
কোম্পানীর পক্ষ থেকে এসব চাষিদের আগে ভাগেই অর্থ, সার, বীজ, পলিথিন, কীটনাশকসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও প্রদান করা হয়েছে। রেজিষ্ট্রেশনভূক্ত এসব চাষী মৌসুম শুরুর আগেই চড়া মূল্যে ফসলি জমিগুলো অগ্রিম লাগিয়ত নেয়। ফলে সবজি চাষিরা জমি নিয়ে বিপাকে পড়েন। সবজি চাষি হায়দার আলী, শাহ জাহান মিয়াসহ আরো অনেকে সিএইচটি মিডিয়া টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধিকে জানান, তামাক চাষিদের অগ্রিম লাগিয়তের কারণে সবজি চাষের জন্য জমি পাওয়া যায়না। আর পাওয়া গেলেও মূল্য বেশি হওয়ায় অনেক সময় জমি লাগিয়ত নেয়া সম্ভব হয়না।
তামাকের ক্ষতিকর নিকটিনের কারনে এলাকার হাজার হাজার মানুষ দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।অনেক সময় চিকিৎসা ব্যায়বহুল হয়ে যাওয়ার কারনে চিকিৎসা খরচ যোগাড় করতে না পারার কারনে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে মানুষ। স্বজনরা চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার থাকেনা।
পরিবেশ বিষেজ্ঞরা সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে জানান, বার বার একই জমিতে তামাক চাষের ফলে যেমন এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মাটির উর্বরতা ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি রবিশস্যের উৎপাদনে নেপথ্যচারী হিসেবে নানা অন্তরায় সৃষ্টি করে যাচ্ছে। জনস্বার্থে তামাক চাষ বন্ধে সাংবাদিক আলাউদ্দিন শাহরিয়ারসহ ৩ জন বাদি হয়ে ২০১০ সালে বান্দরবান চীপ জুড়িসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলা করলে আদালত ওই বছর পুরো জেলায় মাত্র ১ হাজার একর জমিতে তামাক চাষের অনুমতি দেয়। পরবর্তী বছর থেকে সম্পূর্ণভাবে তামাক চাষের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
কিন্তু কোম্পানীগুলো আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এখনও তামাক চাষ অব্যাহত রেখেছে। এ বিষয়ে টোব্যাকো কোম্পানীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা কোন ধরণের মন্তব্য করতে রাজি হননি।
লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূরে আলম সিএইচটি মিডিয়া প্রতিনিধিকে বলেন, সরকারী ভাবে তামাক চাষ বন্ধে সুনির্দিষ্ট কোন আইন না থাকায় এ চাষের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছেনা। তবে চাষীদেরকে তামাক চাষে কোন ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছেনা বরং চাষীদেরকে এ চাষে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, গত বছরের চেয়ে চলতি মৌসুমে অনেকটা কম জমিতে তামাক চাষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে করে এ মৌসুমে রবি শস্যের আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও জানান তিনি।