সোমবার ● ১৫ জানুয়ারী ২০১৮
প্রথম পাতা » উপ সম্পাদকীয় » হুমকির মুখে অনলাইন গণমাধ্যম শিল্প: ঝুলছে নিবন্ধন প্রক্রিয়া
হুমকির মুখে অনলাইন গণমাধ্যম শিল্প: ঝুলছে নিবন্ধন প্রক্রিয়া
নির্মল বড়ুয়া মিলন :: বাংলাদেশে অনলাইন গণমাধ্যমের যাত্রা ২০০৫ সালের দিকে শুরু হলেও এর পূর্ণতা পেয়েছে ২০১৩-১০১৪ সালের দিকে। ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে যেসব টিভি রেডিও ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল পরিচালিত হয় তাকেই বলা হচ্ছে অনলাইন গণমাধ্যম। অনলাইন গণমাধ্যমই এখন বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বের অন্যতম প্রধান গণমাধ্যম। এছাড়াও বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ-ই প্রথম অনলাইন গণমাধ্যম পরিচালনার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যা সরকার জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা ২০১৭ খসড়া নীতিমালা গত ১৯ জুন ২০১৭ ইংরেজি তারিখ মন্ত্রীসভায় নীতিগতভাবে খসড়া পাশ করেছে। এই খসড়া আইনে জাতীয় সম্প্রচার আইনে প্রস্তাবিত সম্প্রচার কমিশন নামে একটি কমিশন প্রস্তাব করা হয়েছে। জাতীয় সম্প্রচার কমিশন আইন চলতি শীত মৌসুমে জাতীয় সংসদে পাশ হওয়ার সম্ভাবনার কথা সরকারের নীতি নির্ধারকরা বিভিন্ন সময় বলছেন। এই আইন পাশ হলে অনলাইন প্রচার মাধ্যমসমূহকে কমিশনের কাছে নিবন্ধন নিতে হবে। এর ফলে প্রথমবারের মত অনলাইন গণমাধ্যম সরকারের তদারকির আওতায় নেয়া হবে। জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা ২০১৭ মন্ত্রীসভায় পাশ হওয়ার পর এই নীতিমালাটিকে বৈষম্য নীতিমালা বলে আখ্যা দিয়েছেন ষ্টেকহোল্ডাররা । কারণ নীতিমালায় ষ্টেকহোল্ডারদের কোন ধরনের মতামত স্থান পায়নি। এটি আইন আকারে পাশ করা হলে অনলাইন গণমাধ্যম যতটুক সম্প্রসারিত হয়েছে তা পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা যেমন রয়েছে তেমনি জাতীয় সম্প্রচার আইনে প্রস্তাবিত সম্প্রচার কমিশনের অধীনে এগিয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে সরকার তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনলাইন গণমাধ্যমকে নিবন্ধন দেওয়ার জন্য আহবান জানালে ২০১৫ সালের শেষদিকে এবং ২০১৬ সালের প্রথম দিকে ২০২০টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ৫০ এর অধিক অনলাইন রেডিও এবং ২শ’র অধিক অনলাইন টেলিভিশন নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। সরকার প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ পুলিশ, পুলিশের বিশেষ শাখা-ডিএসবি, ডাইরেক্টরেট জেনারেল ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সী (ডিজিএফআই) এবং জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এর চারটি সংস্থার মাধ্যমে তৃনমুল পর্যায়ে যাচাই বাছাই করে এগারো’শ এর চেয়ে বেশি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ৫০টির কাছাকাছি অনলাইন টেলিভিশন, ২০টির মত অনলাইন রেডিও নিবন্ধন পাওয়ার উপযোগী করে একটি তালিকা প্রণয়ন করেছে বলে তথ্যমন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রে জানা যায়। কিন্তু ২ বছরের বেশী সময় অতিবাহিত হলেও তথ্য মন্ত্রণালয় অনলাইন প্রচারমাধ্যম সমূহকে নিবন্ধন প্রদানে নিষ্ক্রিয়তা লক্ষ্য করা গেছে। আগে একটি টেলিভিশন চ্যানেল চালু করতে কোটি টাকা বিনিয়োগ হতো, একটি রেডিও ষ্টেশন তাও কোটি টাকা একটি কাগজের পত্রিকা প্রকাশনায় কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা প্রয়োজন হতো। সেখানে কম খরচে অনলাইন প্রচারমাধ্যম সমূহ মূহুর্তের মধ্যে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার করছে। এটি দেশের জন্য অনায়াশে একটি সুসংবাদ। কিন্তু শুরু থেকে অনলাইন প্রচারমাধ্যম সমূহ অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিগনিত হয়ে আসছে। একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল শুরু করতে কমপক্ষে ৫-৭জন দক্ষ সংবাদকর্মীর প্রয়োজন হয়। কমপক্ষে ২টি ল্যাপটপ ৫টি ডেক্সটপ কম্পিউটার, ৩-৫টি ক্যামেরা, একটি অফিস, দ্রুতগতি সম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন হয়। সংবাদকর্মীদের প্রতিমাসে জনপ্রতি কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা করে সম্মানী লাগে। একটি ওয়েভ সাইট তৈরী করতে ডিজাইন, ডোমেইন, হোষ্টিং ও সার্ভার খরচসহ সব মিলিয়ে একটি নিউজ পোর্টালের মালিককে প্রাথমিভাবে ২০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। তারপর প্রতিমাসে সংবাদ কর্মীদের সম্মানী ভাতা, গাড়ীর তেল খরচ, ইন্টারনেট বিল, বিদ্যুৎ বিল, টেলিফোন বিল, অফিস ভাড়া এবং বছর শেষে ডোমেইন হোষ্টিং নবায়ন করতে হয়। এতে কমপক্ষে বছরে একটি নিউজ পোর্টাল আপডেট রাখতে ১০ লক্ষ টাকা খরচ হচ্ছে। এতকিছুর পর সরকার দীর্ঘ দিন ধরে নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি ঝুলিয়ে রাখায় অনলাইন গণমাধ্যম শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠার প্রধান বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। অনলাইন গনমাধ্যমে কাজ করেন গুটি কয়েক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যরা রয়েছে অর্থনৈতিক হুমকির মুখে। প্রতি দিনই কোন না কোন অনলাইন প্রচারমাধ্যম অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটি যেমন ষ্টেকহোল্ডারদের জন্য সুখবর নয় তেমনি সরকার বা গণতন্ত্রের জন্যও মঙ্গলময় বা সুসংবাদ নয়।
অন্যদিকে অনলাইন গণমাধ্যম দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর কিছু মালিক প্রকাশক রাতারাতি কিছু সংগঠন এর জন্ম দিয়েছে। এসব সংগঠনে গড়ে উঠেছে কোনটিতে ৩জন কোনটিতে ৫জন কোনটিতে ২জন আবার কোনটিকে কেবলমাত্র একব্যাক্তি নিয়ে। অনলাইন গণমাধ্যমের মঙ্গলের কথা বলে সরকারের বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন উছিলাই তাদের উপস্থিত হতে দেখা যায়। এসব সংগঠনের কারণে সরকারের নীতি নির্ধারকরা এবং অনলাইন গণমাধ্যমের ষ্টেকহোল্ডারেরা বিভ্রান্তিতে পরেছে। অনলাইন গণমাধ্যম ওনার্সরদের কেবলমাত্র একটি সংগঠন থাকা উচিৎ। অনলাইন প্রচার মাধ্যমে মালিকদের একাধিক সংগঠন থাকায় ষ্টেকহোল্ডারদের প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে এবং যারা আন্তরিকভাবে এই শিল্পের উন্নয়নে কাজ করতে চায় তারা বিভ্রান্তিতে পড়েছে। সংবাদ কর্মীদের একাধিক সংগঠন থাকতে পারে, কিন্তু মালিকদের একাধিক সংগঠন গড়ে উঠায় গৌরবের চেয়ে প্রশ্ন বেশী। যেখানে বছরের পর বছর এই অলাভজনক প্রতিষ্ঠান অনলাইন প্রচারমাধ্যমের প্রকাশকরা আশায় বুক বেধে টিকিয়ে রেখেছেন সেখানে নিজেদের নেতা হিসেবে জাহির করতে গুটি কয়েক প্রচার মাধ্যমের মালিক অনলাইন গণমাধ্যম এগিয়ে যাওয়ার পথকে বাধাগ্রস্থ করছেন। তার উপর রয়েছে ডোমেইন হোষ্টিং ব্যবসায়ীদের বিড়ম্বনা। এ বিষয়টি মালিকদের কারো কাম্য নয়। এটাও লক্ষণীয় যে, অনলাইন গণমাধ্যমের ষ্টেক হোল্ডারেরা জনগণের কাছে অনলাইন গণমাধ্যমকে মূলধারায় আনতে এবং সরকারের কাছ থেকে নিবন্ধন আদায় করতে অদ্যবধি কোন পদক্ষেপ নিতে পারেননি। গভীরভাবে লক্ষ্য করা গেছে যে, ষ্টেকহোল্ডারদের পাশ কাটিয়ে জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমাল ২০১৭ আইনটি শেষ পর্যন্ত সরকার নিজের মত করে পাশ করবে। ষ্টেক হোল্ডারদের তখন ভুমিকা কি হবে ? এই শিল্পে যারা দিনের পর দিন রাতের পর রাত শ্রম দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে অনলাইন গণমাধ্যম মূল ধারায় আনার জন্য কাজ করছেন এদের সবকিছু কি বিফলে যাবে? কাজেই এদের শ্রম মেধা বিনিয়োগ সফল করতে ষ্টেক হোল্ডারদের ঐক্যমতের কোন বিকল্প নাই।