বৃহস্পতিবার ● ৩ ডিসেম্বর ২০১৫
প্রথম পাতা » জাতীয় » আমার মুক্তিযুদ্ধে যোগদান
আমার মুক্তিযুদ্ধে যোগদান
আমার মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পটভুমি ৬৯ সালের গণ আন্দোলন থেকেই সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে প্রতিরোধ আন্দোলন ও পরবর্তীতে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের সুচনাতে যে কজন সামরিক অফিসার যোগদান করেছিলেন আমি তাদের একজন। প্রতিরোধ আন্দোলনের শুরুতে সরাসরি অন্য কোন সামরিক অফিসার যোগ দিয়েছিল কিনা আমার জানা নেই। তবে আমি ১লা মার্চ, প্রকৃত অর্থে ৬৯ এর গণ আন্দোলনের সুচনা থেকেই প্রতিরোধ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম। সে সময়ের অনেকগুলো ঘটনার মধ্যে মাত্র একটির কথা উল্লেখ করে আমি সরাসরি মার্চে চলে আসবো। কারণ সে ঘটনার সাথে ৭১ এর একটি বড় ঘটনা সম্পর্কিত।
৬৯ এর গণ অভ্যূত্থানের সময় আমরা বাঙ্গালী সামরিক অফিসারেরা কি করতে পারি সে বিষয়ে আলোচনা করার একটা উদ্যোগ আমি নিয়েছিলাম এই জন্যে যে, প্রয়োজনে যাতে বাঙ্গালী সৈনিকদের অর্গানাইজ করে আমরা কোথ (অস্ত্রাগার) গুলো দখল করে নিতে পারি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শক্তি যোগানোর জন্যে। মূলত আমার এই চিন্তার সাথে অন্যদের সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে আমি গোপন আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কুমিল্লা সেনা নিবাসের তৎকালিন সিনিয়র মোষ্ট বাঙ্গালী অফিসার এর কাছে আমার চিন্তাটির কথা ব্যক্ত করতে গিয়ে মস্তবড় হোচট খেলাম। তিনি আমাকে সাট আপ করালেন এই বলে, “ডোন্ট ডিসকাস পলিটিক্স, ইটস্ এ ডার্টি সাবজেক্ট।” কিন্তু দূঃখের বিষয় হলো এই তথা কথিত ডার্টি সাবজেক্টের প্রথম শিকার হলেন তিনি নিজেই, ৭১ এর মার্চ মাসে পাকিস্তানিদের হামলার সূচনাতেই। তিনি যদি আন্দোলনের গতি প্রকৃতির সাথে সম্পৃক্ত থাকতেন তাহলে এভাবে বেঘোরে নিহত হতেন না। যাই হোক অন্যান্য আরও অনেকের সাথে আলোচনা করেও কোথ দখল করার বিষয়টি নিয়ে আমি আর এগুতে পারি নি।
তখন থেকেই আমার অনুভতি ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন হতেই হবে। তাই ৭১ এর প্রথম দিকে যখন রাজনৈতিক উত্তেজনা বিরাজ করছিল তখন আমি আমার রেজিমেন্টের সাথে পশ্চিম পাকিস্তান না গিয়ে মায়ের গুরুতর অসুস্থতার অজুহাতে এক মাসের ছুটি নিলাম। পহেলা মার্চের সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষনায় যে গণরোষ প্রদর্শিত হয়েছিল তার সাথে আমিও শরিক হলাম। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় শরিক হলাম। তখনকার সব রাজনৈতিক সমাবেশে আমার উপস্থিতি ছিল অবধারিত। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যেকটি কথায় পলে পলে শিহরিত হলাম। সরকারি কর্মচারিদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আদেশকে শিরধার্য করে নিলাম। আর মাথায় ঘুরছিল যুদ্ধ করতে হলে কিভাবে কোথায় দিয়ে শুরু করবো।
ইয়াহিয়া-ভূট্টোর প্লেন আক্রমণ করার প্রয়াস
ইয়াহিয়া-ভূট্টো চক্রের আলোচনা প্রহসন প্রত্যহ শ্বাস রুদ্ধকর অবস্থায় প্রত্যক্ষ করতে থাকলাম। আলোচনা যখন ব্যর্থ হতে চলেছে তখন মাথায় একটা খেয়াল চাপলো; ইয়াহিয়া-ভূট্টোর প্লেনকে গুলি করে ভুপাতিত করবো। ঢাকার মনিপুরি পাড়ার যে বাড়িতে আমি থাকতাম সেখান থেকে প্লেন উড্ডয়নের দৃশ্য প্রতিনিয়ত দেখা যেত। টেক অফ করে মনিপুরি পাড়ার ওপর দিয়ে প্লেন যেত খুব নিচু অবস্থায়; যেহেতু ‘টেক অফ পয়েন্ট’ থেকে মনিপুরি পাড়া খুব কাছে। রানওয়ের মাথা বরাবর মনিপুরি পাড়ার ভেতর থেকে গুলি করলে তা লাগানো যাবে এবং তাতে প্লেনের ফুয়েল ট্যাংকে আগুন ধরে ক্রাশ করবে এই ধারণার বশবর্তী হয়ে কাজ করা শুরু করলাম।
তখনকার দিনের পিআইএ’র শ্রমিক ইউনিয়ন আন্দোলনে খুব সক্রিয় ছিল। শ্রমিক ইউনিয়ন সভাপতি জনাব রেদওয়ান (বর্তমানে মৃত) আমার প্রস্তাবে অতি উৎসাহের সাথে সম্পৃক্ত হলেন। বিস্তারিত আলোচনা হল। রেদওয়ান দায়িত্ব নিলেন অস্ত্র যোগাড় করার। আমি দায়িত্বও নিলাম যথাযথ স্থান নির্বাচন ও গুলি করার। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ফ্লাইট সিডিউল বের করার দায়িত্ব নিলেন রেদওয়ান ও তার সহকর্মীরা। আমি র্যাকী করা শুরু করলাম। স্থানও নির্ধারন করলাম। ফ্লাইট উঠা নামার দৃশ্য আরও মনযোগ সহকারে পর্যবেক্ষন করতে থাকলাম । টান টান উত্তেজনা; ইয়াহিয়া-ভূট্টো চক্রকে আক্রমন করতে যাচ্ছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অস্ত্র আসে আসে করে আর এলো না। ইয়াহিয়া ভূট্টো আমার নাকের ডগার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল।
ক্র্যাক ডাউনের পরবর্তী রাতে আমার অবস্থানের বাড়িতে, রানওয়ে রক্ষায় নিয়োজিত, পাকিস্থানি সৈনিকেরা অতর্কিতে গুলি চালায় এবং একটু পরে এসে আমাদের বাড়িটি ঘিরে ফেলে। সবাইকে বের করে বেধে ফেলে। এক আত্মীয় আমার সামরিক পরিচয় দিতে নিচু গলায় বললে, আমি তাকে এ ব্যাপারে আর কিছু না বলার জন্য চোখে ইশারা করি। পরিচয় পেলে আমাকে হয়তো এই কাহিনী বলার জন্য বেচে থাকতে হতো না। তারা বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে কিছুক্ষন খোজাখুজি করে এবং আরো কিছু অপকর্ম করে যা আমি আর উল্লেখ করতে চাই না। যাহোক সম্ভবত তাদের অপরাধ বোধের কারনে বা অন্য কোন কারনে তারা আমাদেরকে হত্যা করলো না।
পরবর্তী সুযোগেই ঢাকা থেকে বের হয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য, কুমিল্লার বর্ডার এলাকায় পৌঁছা। এই এলাকায় আমার কাছে ট্রেনিং প্রাপ্ত একটা মোজাহিদ কোম্পানীর সৈনিকদের বসত বাড়ি। তৎকালে প্রতি বছর আমার রেজিমেন্টের তত্বাবধানে এই সব বাংগালী মোজাহিদদের রিফ্রেসার ট্রেনিং হত। সচারাচার আমিই তাদের ট্রেনিং ইন চার্জ থাকতাম। এই মোজাহিদদের সংগঠিত করে আমি যুদ্ধে লিপ্ত হব এই পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকা থেকে বের হয়ে পড়লাম।
সরাসরি কুমিল্লা যাওয়া সম্ভব হয়নি বিধায় চাঁদপুরে পৌছালাম। সেখানে ফ্লাইট লেঃ (অবঃ) এবি সিদ্দিক এমপিএ ও জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এমএনএ এর দেখা পেলাম। আমার পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করতেই সিদ্দিক সাহেব বললেন, তোমার বর্ডার এলাকায় যাওয়ার দরকার নেই, এখানে বিভিন্ন ফোর্সের লোকজন সমবেত হয়েছে, তুমি তাদের পরিচালনার দায়িত্ব নাও। আমি তৎক্ষনাতই রাজি হয়ে গেলাম এবং সে মত কাজ শুরু করলাম। প্রায় ২০০/৩০০ সদস্য পেলাম। আমি দায়িত্ব নিতে না নিতেই হঠাৎ চাঁদপুরে একদিন এয়ার এটাক হল। আমি আমার অসংগঠিত ফোর্স ও কিছু পুরনো অস্ত্র নিয়ে যথাসাধ্য তাদের পতিরোধ করতে চেষ্টা কলরাম। চাঁদপুর আমরা বেশ কিছুদিন মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম।
এর মধ্যে বিএসএফ এর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার উদ্দেশ্যে সেখানকার এক ছাত্র নেতাসহ ভারতে যাই। আমার ভারতে অবস্থান কালে চাঁদপুরের পতন হয়। আমি পুনরায় চাঁদপুরে প্রবেশ করে ছত্রভঙ্গ সৈনিকদের অনেককে একত্রিত করে কুমিল্লা-লাকসাম সড়কে অবস্থান নেই। লাকসামের কাছে বাগমারায় আমার বাহিনীর সাথে পাকিস্তানিদের প্রচন্ড লড়াই হয়। প্রথম দফায় তারা পরাস্ত হয়ে পিছু হটে যায়। পরে শক্তি বৃদ্ধি করে আমাদের অবরোধ ভাংতে সক্ষম হয়। আমরা পিছু হটে গিয়ে ভারতের সোনামুরায় গিয়ে অবস্থান নেই। অতপর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হলে আমি মতিনগর সাব সেক্টর কমান্ডার নিয়োজিত হই।
লেখক:কর্নেল (অব) মোহাম্মেদ দিদারুল আলম, বীর প্রতীক।