বুধবার ● ২৪ জানুয়ারী ২০১৮
প্রথম পাতা » পটুয়াখালী » পটুয়াখালীতে আনসার গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর নামে সীমাহীন তান্ডব
পটুয়াখালীতে আনসার গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর নামে সীমাহীন তান্ডব
পটুয়াখালী প্রতিনিধি :: (১১ মাঘ ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ১০.০৯মি.) পটুয়াখালীর কলাাড়ায় বিধবা মালেকা বেগমকে বেড়িবাঁধের স্লোপের ঝুপড়ি ঘর থেকে নারকীয় সন্ত্রাসী স্টাইলে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ঘরের মালামাল পর্যন্ত সরানোর সময় দেয়া হয়নি। এক যুগেরও বেশি সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের রিভার সাইডের স্লোপে ঝুপড়ি ঘরে থেকে গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে ঝিএর কাজ করে জীবীকা চালাতেন তিনি । এক নাতি চতুর্থ শ্রেণি পড়ুয়া রিমনকে নিয়ে থাকা এই বৃদ্ধা এখন আশ্রয়হীন। এক বাড়িতে আশ্রিত রয়েছেন। তার ভাষায়, ‘চুলার রান্না করা ভাতের পাইল্যা পর্যন্ত সরাইতে পারি নাই।’ মালামাল রাখার সময় চেয়েছিল। কিন্তু কোন কিছুতেই শেষ রক্ষা হয়নি। একইভাবে স্ত্রীসহ তিন সন্তানের জনক আজিম, সাজিমের তিনজনের সংসারসহ বিধবা সাজেদাকে বাঁধের বাইরের ঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এখন এই তিন পরিবার আশ্রয়হারা। অন্যের বাড়িতে অস্থায়ীকালের জন্য আশ্রিত হয়ে আছেন।
মিলন-শাহিনুর দম্পতি জানান, প্রচন্ড শীতের মধ্যে তাঁদের নামিয়ে দেয়া হয়েছে। ভাত খাওয়ার সময় দেয়া হয়নি। একই ভাষ্য বাবুল ভুইয়া-শাহিদা, আমিরুল-কলি দম্পতির। এভাবে ছিন্নমূল ভূমিহীন সাতটি পরিবারকে সিডরের তান্ডবের চেয়েও ভয়াল সন্ত্রাসী স্টাইলে ঝুপড়ি ঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। চরচান্দুপাড়া গ্রামের এসব পরিবারের সঙ্গে কথা না বললে তাদেরকে বসতভিটা থেকে জোর করে উচ্ছেদের অমানবিক দৃশ্য উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। এরা সবাই পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের স্লোপে থাকত। অথচ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাইন বোর্ড টানিয়ে এসব পরিবারকে উচ্ছেদ করে বাঁধের স্লোপের অর্ধেক বরাবর পাউবোর অধিগ্রহণ করা জমিতে কাটাতারের বেড়া দেয়া হয়েছে। চার স্তরের কাটাতার দিয়ে প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার এলাকা বেড়া দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে। এলাকার চিহ্নিত নিজাম হাওলাদার ও টিয়াখালীর আলমসহ ১০/১২ সন্ত্রাসীর এমন নারকীয় উচ্ছেদ কান্ডে সাধারণ মানুষের মাঝে এখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাইনবোর্ড টানিয়ে তাও পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গায় থাকা ভূমিহীন পরিবার উচ্ছেদে এবং জমি দখলের ঘটনায় সরকারের ভাবমুর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে বাঁধের বাইরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বন্দোবস্ত পাওয়া দুই ভূমিহীনের কিছু জমি ক্রয় করেছে। তাও পানির দামে বিক্রিতে বাধ্য করেছে ক্যাডার নিজাম ও আলম।
এছাড়া জমি বিক্রিতে রাজি না হওয়ায় মান্নাফ বয়াতীকে (৫৫) দুই দফা মারধর করা হয়। বহুদফা গালাগাল লাঞ্চিত করা হয়েছে। এখন ভয়ে মান্নাফ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তার ছেলে নুরইসলাম এখন দিশেহারা হয়ে কথা বার্তা বলছেন। এসব পরিবারকে আবার দুই হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাত হাজার টাকা নিতেও বাধ্য করা হয়েছে। গ্রামের মানুষের সকলের প্রশ্ন আনসার বাহিনী সরকারের ? জমি কিনলে ব্যক্তিগত জমি কিনবে। তাতে পানি উন্নয়নবোর্ডের বাঁধের স্লোপ থেকে তাদের উচ্ছেদ করা হলো কেন ? আর সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে এভাবে কেন তাদেরকে আশ্রয়হারা করা হলো। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পশ্চিম চান্দুপাড়া থেকে স্লুইস পর্যন্ত পাউবোর অধিগ্রহণ করা জমিছাড়াও মূল বেড়িবাঁধের রিভার সাইটের স্লোপ দখল করে কাটা তারের চার সারির বেড়া দেয়া হয়েছে। বাঁধের বাইরের জমির মালিক কৃষকরা চলাচল পর্যন্ত করতে পারছেন না। তাদের চলাচলের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আর উচ্ছেদ করা পরিবারের ভিটি, চুলা পড়ে আছে। এসব পরিবার আশপাশের কারও বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে পড়ে আছে। অনেকের ঘরের মালামাল পর্যন্ত লুট করা হয়েছে।
বিধবা জামিনা জানান, তাকে ঘর থেকে গালাগাল করে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। প্রায় এক মাস আগে এভাবে কাটাতার দিয়ে ঘিরে ফেলায় এখন গোটা গ্রামের মানুষ গবাদিপশু নিয়ে বাঁধের বাইরের জমি এবং নদীরপাড়ে ঘাস খাওয়ার জন্য নিতেও পারছে না। দখল করা বাঁধের স্লোপের মাঝখানে একটি ছোট্ট টিনশেড ঘর তোলা হয়েছে। সেখানেও লাগানো হয়েছে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাইনবোর্ড। ওই ঘরটিতে দখলদার হোতা সন্ত্রাসী চক্রের রাতের আসর বসায়। আড্ডা বসে। এখন যারা জমি বিক্রিতে রাজি হচ্ছে না তাঁদেরকে দাবড়ে বেড়াচ্ছে আলম ও নিজাম বাহিনী।
ভীতসন্ত্রস্ত লোকজন কলাপাড়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। এরপর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. তানভীর রহমানের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত রয়েছে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লোপ থেকে উচ্ছেদ হওয়া দরিদ্র পরিবারগুলোকে তাদের ঘরের জায়গায় ফের বসতি স্থাপন করতে দেয়া হয়নি। সরানো হয়নি কাটা তারের বেড়া। কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল খায়ের জানান, তাদেরকে না জানিয়ে কাটাতারের বেড়া দেয়া হয়েছে এবং গরিব মানুষকে উচ্ছেদের ঘটনা তাঁদের জানা নেই। পটুয়াখালী জেলা আনসার এডজুডেন্ট শেখ ফিরোজ আহমেদ জানান, তাদের কোন সদস্য উচ্ছেদ কিংবা সাধারণ মানুষের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরনের সঙ্গে জড়িত নন। তারপরও বিষয়টি তিনি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন। অভিযুক্ত মো. নিজাম উদ্দিনকে কয়েকবার মোবাইল করলেও কথা বলা যায়নি। ইউপি চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামান তারা জানান, তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন। বিষয়টি অমানবিক। তিনিও এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন।