শনিবার ● ২৪ মার্চ ২০১৮
প্রথম পাতা » শিরোনাম » আতিয়া মহলের দুর্বিষহ যন্ত্রনা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে ওরা
আতিয়া মহলের দুর্বিষহ যন্ত্রনা এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে ওরা
সিলেট প্রতিনিধি :: (১০ চৈত্র ১৪২৪ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় বিকাল ৩.০৪মি.) ‘আতিয়া মহল, দেশব্যাপী আলোচিত এক নাম, জঙ্গীবিরোধী অভিযানের লোমহর্ষক ভয়াবহতার রেশকাটলেও এখনো কাটেনি সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়িস্থ ‘আতিয়া মহলে’ সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ কমান্ডোদের জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলাকালে আতিয়া মহলের অদূরেই দুই দফার বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। নিহত হয় সাতজন। বোমা বিস্ফোরণে নিহতদের পরিবারে এখনও কান্না থামেনি। আহতদের অনেকে এখনোও স্পিন্টারের যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন।
গেল বছর ২০১৭ সাল ২৪ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালানো হয়। সেনা কমান্ডোদের ১১১ ঘন্টার অভিযান শেষে আতিয়া মহল থেকে চার জঙ্গির লাশ উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীতে এদের মধ্যে একজনের পরিচয় মর্জিনা বলে ডিএনএ পরীক্ষায় নিশ্চিত হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বাকিদের পরিচয় এখনও সনাক্ত হয়নি।
আতিয়া মহলে কমান্ডোদের অভিযান চলাকালেই পাশেই একটি সড়কে দুই দফা বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন সাতজন। নিহতরা হলেন র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান আবুল কালাম আজাদ, সিলেটের জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম, আদালতে পুলিশের পরিদর্শক চৌধুরী মো. আবু কয়ছর, ছাত্রলীগ নেতা ওয়াহিদুর রহমান অপু, জান্নাতুল ফাহিম, ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম ও খাদিম শাহ।
অভিযানের পর সবকিছু স্বাভাবিক হলেও স্বাভাবিক হতে পারেনি নিহতের পরিবাএ। নিহতদের পরিবারে এখনও নিরব কান্না চলছে। স্বজন হারানোর ব্যথা নিয়ে পরিবারগুলো এখনও শোকে মুহ্যমান।
বিস্ফোরণে নিহত হয়েছিলেন মদন মোহন কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, ছাত্রলীগ নেতা ওয়াহিদুর রহমান অপু। তার বাবা প্রয়াত সিরাজুল ইসলাম আউয়াল ছিলেন নগরীর ২৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। অপুর মা সুলতানা আক্তার বলেন, ‘আমার চার সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে ছিল অপু। সে নিহত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন। কিন্তু সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় সংসার চলে না।’ তিনি তার বড় মেয়ে ফজিলাতুন্নেসার সরকারি কোন চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান।
বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন দক্ষিণ সুরমা উপজেলা ছাত্রলীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক জান্নাতুল ফাহিম। দক্ষিণ সুরমার কুচাইয়ে তাদের বাড়ি। তার বাবা কামাল আহমদ কাবুল কুচাই ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘আমরা সরকার থেকে ১০ লাখ টাকার অনুদান পেয়েছি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। তিনি স্বজন হারানোর বেদনা বুঝেন। আমাদের পরিবারের কথা যেন তিনি ভুলে না যান। সিলেটে সফরে এলে আমাদের বাড়িতে তাঁকে আসার অনুরোধ জানাচ্ছি।’ কামাল আহমদ শক্ত হাতে জঙ্গি দমনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়ে বলেন, জঙ্গিদের কারণে আর কেউ যেন স্বজন না হারায়।
বোমা বিস্ফোরণে নগরীর দাড়িয়াপাড়ার ডেকোরেটর ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম নিহত হন। তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোণায়। দাড়িয়াপাড়ায় প্রাইম ডেকোরেটর্সের মালিক ছিলেন তিনি। তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার বলেন, ‘পাঁচ মাস ১৭ দিনের মেয়ে আফিফা শাহরিন নাবিলাকে রেখে মারা যান শহীদুল। আমরা কোন সরকারি সহায়তা পাইনি। বাচ্চাকে নিয়ে ভাসুর ও দেবরের বাসায় থাকি। সরকার যদি আমাদের আর্থিক অনুদান দেয়, তবে আমরা খুবই উপকৃত হব।’
এদিকে ওই বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছিলেন। আহতদের অনেকেই স্প্রিন্টারের যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন। আহতদের মধ্যে ছিলেন নগরীর ঝালোপাড়ার জুয়েল আহমদ ও নুরুল আলম পাপ্পু। তারা বলেন, ‘আহত হওয়ার পর কিছুদিন ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। কিন্তু টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারেনি। শরীরে স্প্রিন্টারের যন্ত্রণা নিয়েই আমরা আছি।’
এখনও আতঙ্ক: পাঁচ ও চারতলা দুটি ভবন নিয়ে আতিয়া মহল। জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলাকালে পাঁচতলা ভবনে ৩০টি পরিবার এবং চারতলা ভবনে ১৮টি পরিবার ছিল। সেনা কমান্ডোরা অভিযানের মধ্যেই তাদেরকে নিরাপদে বাইরে বের করে এনেছিলেন। অভিযান শেষে এসব পরিবারের মধ্যে চারটি আতিয়া মহলে রয়ে গেছে। বাকিরা ভয় আর আতঙ্কে এখানে আর ফিরেননি। রয়ে যাওয়া চারটি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এখনও সেই দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে ফিরে।
দুজন ভাড়াটিয়া বলেন, ‘আমরা সেই আতঙ্কের দিনগুলো এখনও ভুলতে পারিনি। বাচ্চারা উচ্চ শব্দ শুনলেই ভয়ে কেঁপে ওপে। আমরা ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠি।’