মঙ্গলবার ● ৮ মে ২০১৮
প্রথম পাতা » অপরাধ » রাবি শিক্ষক রেজাউল হত্যায় দুই জঙ্গির ফাঁসি : ৩ জনের যাবজ্জীবন
রাবি শিক্ষক রেজাউল হত্যায় দুই জঙ্গির ফাঁসি : ৩ জনের যাবজ্জীবন
রাজশাহী প্রতিনিধি :: (২৫ বৈশাখ ১৪২৫ বাঙলা: বাংলাদেশ সময় রাত ৯.২৬মি.) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যা মামলায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাদিহীন বাংলাদেশ জেএমবির দুই সদস্যের মৃত্যুদণ্ড এবং তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে তাদের প্রত্যেকের ২০ হাজার টাকা করে অর্ধদন্ড করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শিরীন কবিতা আখতার আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
আসামিদের মধ্যে বগুড়ার শিবগঞ্জের মাসকাওয়াত হাসান ওরফে আব্দুল্লাহ ওরফে সাকিব এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলামের ফাঁসির রায় দিয়েছেন বিচারক। আর নীলফামারির মিয়াপাড়ার রহমত উল্লাহ, রাজশাহী মহানগরীর নারিকেলবাড়িয়া এলাকার আবদুস সাত্তার এবং তার ছেলে রিপন আলীকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
তাদের মধ্যে হত্যার ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ শরিফুল ইসলাম এখনও পলাতক। বাকি চারজন রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন বলে জানান এ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এন্তাজুল হক বাবু।
রায়ে সন্তস প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বাবু বলেন, মাসকাওয়াত ও শরিফুল এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। আর অপরদিনজন পরোক্ষভাবে জড়িত। তারা সবাই জেএমবির সঙ্গে জড়িত। খেলাফত প্রতিষ্ঠান জন্য মুক্তমনা হিসেবে তারা রাবি শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
আইনজীবী বাবু বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রহমত উল্লাহকে গ্রেপ্তারের পর তার ল্যাপটব জব্দ করা হয়। সেখানে রেজাউল কবির হত্যার কৌশল ও জেএমবির কর্মকান্ডের তথ্য পাওয়া যায়। এ হত্যাকান্ডের ব্যাপারে মাসকাওয়াত ও রহমত আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়ে হত্যার দায় স্বীকার করে।
২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল সকালে রাজশাহী নগরের শালবাগান এলাকায় নিজের বাড়ি থেকে ৫০ গজ দূরে কুপিয়ে ও গলাকেটে হত্যা করা হয় রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে। তার ছেলে রিয়াসাত ইমতিয়াজ সৌরভ পরে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে বোয়ালিয়া থানায় এই হত্যা মামলা দায়ের করেন।
বেলা ১২টা ২০ মিনিটে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয় তিন আসামী মাসকাওয়াত, রহমত ও রিপনকে আদালতে হাজির করা হয়। এর আগেই আদালতে হাজির হন জামিনে থাকা আব্দুস সাত্তার। দুপুর ১টায় বিচারক ৪২ পৃষ্টার রায় পড়া শুরু করেন। রায় পড়ার পর ২টার দিকে বিচারক শিরীন কবিতা আখতার আদেশ দেন।
রায় ঘোষনাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে আদালত চত্বরের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। নিহত শিক্ষকের ছেলে, মেয়ে ও ভাই ছাড়াও আদালত চত্বরে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এই রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে রাবির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অধ্যাপক রেজাউলের পরিবার।
ইংরেজি বিভাগের সভাপতি ড. এএফএম মাসউদ আখতার বলেন, ইংরেজি বিভাগের সেন্টিমেন্ট অনুযায়ি আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট। বিজ্ঞ আদালত এই হত্যা মামলার সুষ্ঠু রায় ঘোষণা করেছেন। এখন আমাদের দাবি, অবিলম্বে যেন এই সাজা কার্যকর করা হয়। মামলার রায় যেন বহাল থাকে সেজন্য আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব। আমাদের বিশ্বাস, সেখানেও আমরা ন্যায় বিচার পাবো।
অধ্যাপক রেজাউল করিমের মেয়ে রিজওয়ানা হাসিন শতভি বলেন, আমরা এ রায়ে সন্তুষ্টি জানিয়েছি। তবে আমাদের আশঙ্কা, আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করার পর তাদের শাস্তি যেন কমে না যায়। আমরা পলাতক খুনি শরিফুলকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছি। অতি দ্রুত তাকে গ্রেফতার করে সবার শাস্তি কার্যকর হবে এটাই এখন আমাদের প্রত্যাশা।
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা বলেন, এই হত্যা মামলার সকল আসামীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া উচিৎ ছিল। কারণ তারা শুধু আমাদের প্রিয় মুকুল স্যারকেই হত্যা করেনি, তারা মুক্তবুদ্ধি ও উচ্চ শিক্ষার ধারণাকে খুন করেছে। তবে আদালত যা রায় দিয়েছেন, তাতে আমরা সন্তুষ্ট। এই হত্যা মামলার যে প্রধান আসামী সে পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেফতার করাসহ অবিলম্বে সাজাপ্রাপ্তদের যেন দন্ড কার্যকর করা হয় সেটাই এখন আমাদের দাবি।
বিজ্ঞ আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা। একই সঙ্গে পলাতক আসামি শরিফুলকে গ্রেফতার করে সকলের শাস্তি নিশ্চিতের জোর দাবি জানান তিনি।
ইংরেজির শিক্ষক ‘কোমলগান্ধার’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ‘সুন্দরম’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। দক্ষ সেতার বাদক রেজাউল শালবাগানে একটি গানের স্কুল খোলার জন্যও কাজ করছিলেন।
ব্লগার, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট এবং মুক্তমনা লেখক, প্রকাশক শিক্ষকদের ওপর একের পর এক হামলা, হত্যার মধ্যে রেজাউল হত্যার ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। তদন্তে নেমে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংঘবদ্ধ জঙ্গিরাই অধ্যাপক রেজাউলকে হত্যা করেছে। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষে ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। সেখানে আসামি হিসেবে জেএমবির আট জঙ্গির নাম উল্লেখ করা হয়।
ওই আটজনের মধ্যে খায়রুল ইসলাম বাঁধন, নজরুল ইসলাম ওরফে হাসান ওরফে বাইক হাসান ও তারেক হাসান ওরফে নিলু ওরফে ওসমান অভিযোগপত্র দেওয়ার আগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
এদের মধ্যে ওসমান শিক্ষক রেজাউল করিম হত্যায় সরাসরি অংশ নেন এবং নিজের হাতে কুপিয়ে হত্যা করেন বলে সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়। অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে বাকি পাঁচ আসামির বিচার শুরুর পর ২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে মোট ৩২ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জনের সাক্ষ্য শোনে আদালত। গত ১১ এপ্রিল দুইপক্ষের আইনজীবীর যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে বিচারক মামলাটি রায়ের জন্য রাখেন।