শুক্রবার ● ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৯
প্রথম পাতা » অর্থ-বাণিজ্য » চলনবিলে ধান ও চালের বাজারে অসংগতির ফলে ব্যবসায় স্থবিরতা : ৭০ শতাংশ মিল চাতাল বন্ধ
চলনবিলে ধান ও চালের বাজারে অসংগতির ফলে ব্যবসায় স্থবিরতা : ৭০ শতাংশ মিল চাতাল বন্ধ
চাটমোহর (পাবনা) প্রতিনিধি :: চলনবিল এলাকার কৃষকেরা কিছু দিন পূর্বে জমি থেকে আমন ধান, বীনা সেভেন, ব্রীধান উনচল্লিশ, স্বর্ণাসহ বিভিন্ন জাতের ধান কেটে ঘরে তুলেছেন। ধানের ভর মৌসুমের পর পর প্রতি মন বোনা আমন ধান ৭শ ৫০ টাকা বা এর কিছু কম বেশি দামে বিক্রি হলেও এখন তা ৬শ ৩০ থেকে ৬শ ৪০ টাকায় নেমে এসেছে। একই সময় প্রতি মন ব্রীধান-উনত্রিশ ৮শ ৬০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ৮শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ধানের দাম বাড়তে পারে এ আশায় ভর মৌসুমে চলনবিল এলাকার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, সিংড়া, তাড়াশ, উল্লাপাড়ার পশ্চিমাংশসহ আশ পাশ এলাকার ধান চাল ব্যবসায়ীরা বেশি দামে ধান কিনে এখন কম দামে চাল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। ধানের বাজারের সাথে চালের বাজারের অসংগতির ফলে এ এলাকার ব্যবসায়ীরা ক্ষতি গ্রস্থ হচ্ছেন। পাশা পাশি চালের ক্রেতা সংকট দেখা দেওয়ায়, এ এলাকার নদ নদীতে নৌচলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, কয়েক মাস যাবত ক্রমাগত লোকসান হওয়ায় চলনবিল এলাকার ৭০ শতাংশ মিল চাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ব্যবসা বানিজ্যে স্থবিরতার পাশাপাশি কয়েক হাজার চাতাল শ্রমিক বেকার হয়ে পরেছেন।
এ ব্যাপারে গুরুদাসপুর মিল চাতাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক শেখ বলেন, গুরুদাসপুরে প্রায় দুই শত মিল চাতাল রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ থেকে ৭৫ টি সচল আছে। ক্রমাগত লোকসানের মুখে বাঁকি গুলো বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েক মাস যাবত এলসির মাধ্যমে ভারত থেকে আমাদের দেশে স্বর্ণা, বালাম, মিনিকেট চাল আমদানীর ফলে এ অবস্থা বলে বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, ধানের ভর মৌসুমে কাচা ভেজা ধান ৭শ থেকে ৭শ ১৫ টাকায় বিক্রি হয়। পক্ষ কাল পরে মন প্রতি ধানের দাম ৫০ টাকা বেড়ে যায়। সর্বশেষ গত শনিবার চাঁচকৈড় হাটে প্রতি ৩৮ কেজি ব্রীধান উনচল্লিশ ৭শ ২০ টাকা থেকে ৭শ ৪০ টাকায়, ব্রীধান উনত্রিশ ৭শ ৪০ থেকে ৭শ ৫০ টাকায়, বোনা আমন ৬শ ৭০ থেকে ৭শ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি বস্তা ধান সিদ্ধ শুকানো ক্রাসিং বাবদ ৭০ টাকা খরচ হয়। সর্টিং প্রতি কেজি ১ টাকা। সর্টিং এর সময় কিছু ঘাটতি হয়। কয়েক মাস যাবত ধান কিনে চাল করে প্রায়শই লোকসান হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। গত এক সপ্তাহে চালের বাজার প্রতি কেজিতে কমেছে দুই-তিন টাকা। চালের নি¤œগতির এ বাজারে আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। অনেক ব্যবসায়ী সরকারি বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে এখন কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। বর্তমান চালের ৫০ কেজির বস্তায় ১শ৫০ টাকার মতো লোকসান যাচ্ছে। এ ছাড়া কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার জীবন যাপন করছেন।
চাটমোহর উপজেলা মিল চাতাল মালিক সমিতির সভাপতি প্রফেসর আব্দুল মান্নান বলেন, চাটমোহর উপজেলায় ৬৮ টি মিল চাতাল রয়েছে। এর মধ্যে ১০ থেকে ১২ টি সচল আছে। সচল মিলগুলোর মধ্যে ৭ থেকে ৮ টি মিল সামান্য কিছু করে ধান সিদ্ধ করে কোন রকমে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রমগত লোকসানের মুখে বাঁকিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। মিল চাতাল মালিকরা এক সপ্তাহে যে ধান কিনছে পরের সপ্তাহেই এক থেকে দেড়শ টাকা দাম নেমে যাচ্ছে। বাজারে চাউলের কোন ক্রেতা নেই বললেই চলে। অব্যহত লোকসানের ফলে মালিকরা নতুন করে ধান ক্রয় করে চাল তৈরি করতে রাজি নয়।
তিনি আরো বলেন, এমন পরিস্থিতিতে কোন মিল চাতাল ব্যবসায়ী এই ব্যবসা করতে চাইবে না। লাভের আশায় মিল চাতাল চালু করলেই লেবার খরচসহ অন্যান্য অনেক খরচ অবধারিত হবেই। যদি বার বার এমন লোকশান হয় তবে অনেক ব্যবসায়ী মূলধন হারিয়ে ঋণের চাপে পথে বসা ছাড়া উপায় নেই।
চাটমোহরের চালের বৃহত মোকাম মির্জাপুর হাটে ধান চালের ব্যবসা করেন মির্জাপুর গ্রামের আজিজল ফকির। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার মির্জাপুর হাটে প্রতি মন ব্রীধান উনত্রিশ ৮শ টাকায় এবং বোনা আমন ৬শ ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক মাস পূর্বে প্রতি মন ব্রীধান উনত্রিশ ৮শ ৬০ টাকায় এবং বোনা আমন ৭শ ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক মাস পূর্বে যারা ধান কিনে রেখেছেন এখন দাম কমে যাওয়ায় তারা লোকসানের মুখে। এ ছাড়া এ এলাকার চাল নৌপথে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, রাজবাড়ি, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, নরসিংদীসহ দেশের অন্যান্য এলাকায় পাঠানো হতো। নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে এখন ছোট ছোট নৌকায় প্রথম ভাঙ্গুড়ার নৌবাড়িয়া ও এর চেয়ে অপেক্ষাকৃত বড় নৌকায় চাল নিয়ে ফরিদপুরের নারাণপুরে বড় ট্রলারে লোড করা হচ্ছে। ফলে বাড়ছে চালের পরিবহন খরচ। মির্জাপুর ও এর আশপাশ এলাকার শতাধিক মিল চাতাল থাকলেও পঁচিশ-ত্রিশটি চাতাল সচল আছে। ক্রমাগত লোকসান হওয়ায় বাঁকিরা ব্যবসা বন্ধ রেখেছে। সব মিলিয়ে আমরা এখন নাজুক অবস্থা পার করছি।
একতা রাইস মিলের সত্তাধিকারী নিমাই ঘোষ বলেন, এ এলাকায় চালের ক্রেতা এখন খুব কম। প্রতি বস্তা চালে ১শ টাকা লোকসান যাচ্ছে। প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অনেকে চাল বিক্রি করতে পারছেন না। গত বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে কিছু লাভ হলেও তার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সাত-আট মাস যাবত লোকসান যাচ্ছে আমাদের।