মঙ্গলবার ● ২০ আগস্ট ২০১৯
প্রথম পাতা » গবেষনা » এবারের ঈদযাত্রায় ২৫০দুর্ঘটনায় ২৯৯ নিহত, ৭৮৮ আহত : যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ
এবারের ঈদযাত্রায় ২৫০দুর্ঘটনায় ২৯৯ নিহত, ৭৮৮ আহত : যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ
ঢাকা প্রতিনিধি :: বিগত ঈদুল আযহায় দেশের সড়ক মহাসড়কে ১৯৯ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৫৩ জন নিহত, ৭৬৫ জন আহত হয়েছে (প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক)। সড়ক, রেল ও নৌপথে সম্মিলিতভাবে ২৫০ টি দুর্ঘটনায় ২৯৯ জন নিহত ও ৭৮৮ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।
আজ ২০ আগষ্ট, মঙ্গলবার সকালে নগরীর জাতীয় প্রেস ক্লাব জহুর আহম্মেদ হল মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জি এম কামরুল ইসলাম, এসপিপি (অবঃ) এই তথ্য তুলে ধরেন। সংগঠনটির দুর্ঘটনা গবেষণা ও মনিটরিং সেল এই প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এবারের ঈদে সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের ঈদ প্রস্তুতি নিয়ে নানা কথা শুনলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। রেলপথে সময়সূচির ভয়াবহ বিপর্যয়, অনিয়ম, সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশ পথে ভাড়া নৈরাজ্য, ফেরী ও লঞ্চ চলাচলে বিঘœ, সদরঘাটসহ নৌ টার্মিনাল গুলোতে ভোগান্তি, লোভ ও শৈথিল্যেও বিপর্যয়, নারী যাত্রীদের হয়রানীর মধ্যেদিয়ে শেষ হলো ঈদুল আযহার ঈদ আনন্দ যাত্রা। এবারের ঈদ আনন্দ যাত্রায় স্বস্তি না থাকলেও দুর্ঘটনা কম ছিল তবে ঈদ ফিরতি যাত্রায় ভয়াভহ দুর্ঘটনায় রূপ নেই। যাত্রা পথে বাস, লেগুনা, নৌকা ও বিরতি রেস্তুরায় ধর্ষণের শিকার হয়েছে চার নারী যাত্রী। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ২১ জেলার ৬৩৫ কিলোমিটার সড়ক-মহাসড়কে দুর্ভোগ বেশি হয়েছে। প্রবল স্রোত ও বাতাসের কারনে পদ্মায় ফেরী পারাপারে বিঘ্নিত হওয়ায় লঞ্চে যাত্রীদের চাপ বেড়েছিল। ভোগান্তি এড়াতে আকাশ পথে যাত্রী সাধারণের চাহিদা বেশি থাকায় উচ্চমূল্যেই বিক্রি করেছে অভ্যন্তরীণ রুটের বিমানের টিকিট, ফ্লাইটের সংখ্যাও ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
ঈদযাত্রা শুরুর দিন ৬ আগষ্ট থেকে ঈদ শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরা ১৮ আগষ্ট পর্যন্ত বিগত ১৩ দিনে সড়ক, রেল ও নৌ পথে সর্বমোট ২৫০ টি দুর্ঘটনায় ২৯৯ জন নিহত ও ৭৮৮ জন আহত হয়েছে। সড়ক পথে ১৯৯ দুর্ঘটনায় ২৫৩ জন নিহত ও ৭৬৫ জন আহত, নৌপথে ২১ দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত, ৫১ জন নিখোঁজ ও ২৩ জন আহত হয়েছে। উল্লিখিত সময়ে রেলপথে ট্রেনে কাটা পড়ে পূর্বাঞ্চলে ২১ জন ও পশ্চিমাঞ্চলে ৯ জনসহ মোট ৩০ জন নিহত হয়।
চলতি বছরের ঈদুল ফিতরে ১৮৫ সড়ক দুর্ঘটনায় ২২১ জন নিহত ৬৫২ জন আহত হয়েছিল, নৌ-পথে ৪ জন, ট্রেনে কাটা পড়ে ২২ জন নিহত হয়েছিল। ঈদুল আযহায় তুলনামুলক ভাবে দুর্ঘটনা, নিহত ও আহতের সংখ্যা বেড়েছে।
যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের দুর্ঘটনা গবেষণা ও মনিটরিং সেলের সদস্যরা দেশের বহুল প্রচারিত বিশ্বাসযোগ্য ১৮টি জাতীয় দৈনিক, ৬টি আঞ্চলিক দৈনিক ও ১০টি অনলাইন নিউজপোর্টালে প্রকাশিত তথ্য মনিটরিং করে এ প্রতিবেদন তৈরি করে।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায় মোট যানবাহনের ৬৬টি বাস, ৬২টি মোটরসাইকেল, ৩৩টি ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ও পিকআপ, ১৪টি কার-মাইক্রো, ৪৫টি নছিমন-করিমন, ভটভটি-ইজিবাইক, অটোরিকশা, ২৬টি অন্যান্য যানবাহন এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল। দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬১টি গাড়িচাপায়, ৭৪টি সংঘর্ষ, ৩০টি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে, অন্যান্য কারণে ৩৪টি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়।
এবারের ঈদে নেত্রকোনার চল্লিশা এলাকায় সারিন্দা হোটেলে বাসের যাত্রা বিরতিতে স্বামীর সামনে এক তরুণীকে গণধর্ষণ করে হোটেলের ম্যানেজারের নের্তৃত্বে আরো ৫ যুবক, চট্টগ্রামে কোতোয়ালী থানার চট্টগ্রাম ক্লাবের সামনে চলন্ত বাসে এক গৃহবধুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে, এছাড়া বরিশালের বানারীপাড়া এলাকায় এক তরুণী লেগুনা যাত্রীকে ধর্ষণ করেছে লেগুনার চালক ও হেলপার, বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীতে নৌকায় এক স্কুল ছাত্রীকে ধষৃণ করা হয়েছে।
একই সময়ে রাজধানীর বাসাবো এলাকায় সিএনজি অটোরিক্সার নিচে চাপা পড়ে সিআইডির এএসআই আনোয়ার হোসেন স্বপন, দিনাজপুর ঘোড়াঘাটে ট্রলি চাপায় অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার আবদুল হাকিম, রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ইনভেষ্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের কর্মকর্তা তসলিম হোসেন, নাটোরের বড়াইগ্রামে পিপরুল ইউনিয়ন যুবদলের সহ-সভাপতি শহিদুল ইসলাম বাবু, ট্রাঙ্গাইলের মির্জাপুরে নৌবাহিনীর করর্পোরাল নাজমুল হোসেন, কুমিল্লা দেবিদ্বারে মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, সিরাজগঞ্জে বাসের চাপায় দৈনিক সাতমাথা পত্রিকার সাংবাদিক দম্পতি নিহত হয়। এছাড়াও বড়াইগ্রাম সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশিদ, বৈশাখী টিরি প্রতিনিধি রফিকুল ইসলাম, আনন্দ টিভির প্রতিনিধি মানিক ঘোষ দুর্ঘটনায় আহত হয়।
যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ১. যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, ২. উপরন্ত ওভারটেকিং এর মানসিকতা, ৩. নগর পরিবহনের অনেক ফিটনেসবিহীন বাস দূরবর্তী রুটে চলাচল, ৪. বৈধ চালক সংকট, ৫. নির্ঘুম অবস্থায় বিরামহীন গাড়ী চালানো, ৬. অতিরিক্ত ট্রিপ দিতে মালিকদের চাপ, ৭. অতিরিক্ত যাত্রী চাপ ও যাত্রীদের তাড়াহুড়ার মানসিকতা, ৮. দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, ৯. মহাসড়কে ছোট যানবাহন অবাধে চলাচল, ১০. আইনের কার্যকর প্রয়োগ না করা, ১১. ঈদ ফেরত যাতায়াতে মনিটরিং ব্যবস্থার শিতিলতা, ১২. নৌযানের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সামগ্রী না থাকা এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।
সুপারিশমালা: (১) যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ, (২) চালকদের সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান (৩) চালকদের বিশ্রাম ও কর্মঘন্টা মানার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার শতভাগ বাস্তবায়ন (৪) বৈধ চালক তৈরি করা, (৫) হালকা গাড়ি চালানো লাইসেন্স নিয়ে ভারী গাড়ি চালাচ্ছেন এমন চালকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া, (৬) মহাসড়কে নছিমন-করিমন, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা বন্ধে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত শতভাগ বাস্তবায়ন করা, (৭) মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন চলাচল বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া, (৮) রেশনিং পদ্ধতিতে ছুটির ব্যবস্থা করা, (৯) যাত্রী ও পথচারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা, (১০) ঈদযাত্রায় সরকারি-বেসরকারি সংস্থার স্টাফবাস যাত্রী বহনে ব্যবহার করা এবং প্রয়োজনে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে যানবাহন ভাড়া করা, (১১) ঈদ ফেরত যাতায়াতে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা, (১২) রেলের ছাদে রেলিং এর ব্যবস্থা করা, (১৩) মোটর সাইকেল চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপদ করা, (১৪) স্কাউট সদস্যদের সাথে বিএনসিসি-সহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়োগ প্রদান, (১৫) যাত্রী বীমা চালু করা।
এই সময় উপস্থিত ছিলেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ, পুলিশ কল্যাণ এসোসিয়েশনের সভাপতি ডিএ তায়েফ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক মোখলেছুর রহমান, সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের যুগ্ন সম্পাদক হানিফ খোকন, ড্রাইভার্স ট্রেনিং সেন্টারের চেয়ারম্যান নুর নবী শিমু, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দীন চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল্লাহ আল যুবায়ের, অর্থ সম্পাদক সায়মুন নাহার জিদনী ও আবুল বাশার হাউলাদার প্রমুখ।